মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

শঙ্খসাথি পাল


ইচ্ছাবৃষ্টি
 

বিদেশ থেকে আসি বললেই যে আসা যায় না, এই সহজ সরল সত্যিটা গত তিনদিন ধরে কাউকে বোঝাতে পারছে না জুঁই ।সব আত্মীয় স্বজন কেমন যেন বাঁকাভাবে দেখছে তাকে অথচ তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায় ।মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে থেকে কী মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কাজ শেষ করেছে, সে নিজেই জানে ।এই যে  সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে পড়া, বিদেশে কাজের সুযোগ অ্যাকসেপ্ট করা - সব তো মায়েরই স্বপ্ন ছিল ।কিন্তু মায়ের স্বপ্নপূরণ করতে গিয়ে শেষদিনে আর মায়ের কাছেই থাকা হল না জুঁই-এর ।
       আজ আত্মীয় স্বজনদের ভিড় অনেকটাই কমে এসেছে ।বাবা নিজের ঘরে ।অনেকদিন পর পারিজাত কাকু এসেছে আজ ।বাবার সাথে কথা বলছে ।জুঁই মায়ের ঘরে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে চলে যাওয়া মায়ের ফেলে যাওয়া চিহ্নগুলো ।তানপুরাটায় হাত বুলিয়ে ফিরে যাচ্ছে অতীতে ।আবছা সে সব স্মৃতি ।বাবা তখন দেরাদুনে থাকতো বোধহয় ।প্রতি সন্ধ্যায় ছাদের ফুলবাগানে পারিজাত কাকু মাকে গান শেখাতো ।কিছুই বুঝতো না তখন জুঁই গানের, কিন্তু ভেসে যেত সুরের মূর্চ্ছনায় ।
        মায়ের ড্রেসিং টেবিলে সেই হাতির দাঁতের ছোট্ট বাক্সটা আজও রয়েছে কৌতুহলে সেটা খুলতেই বেশ অবাক হলো জুঁই ।বাক্সের ভিতরে একটা রূপোর সিঁদুর কৌটো আর লাল টুকটুকে একটা ছোট্ট ডায়েরি ।ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা... "তোমায় দিলেম ছুটি..." ।নাহ, আর তেমন কিছু নেই ।মাঝের দিকে একটা পাতায় লেখা একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত... 

" কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া
চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি।
ভেবেছিনু কোথা তুমি স্বর্গের দেবতা,
কেমনে তোমারে কব প্রণয়ের কথা।
ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি
চিরজন্ম সঙ্গোপনে পূজিব একাকী--
কেহ জানিবে না মোর গভীর প্রণয়,
কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়।
আপনি আজিকে যবে শুধাইছ আসি,

কেমনে প্রকাশি কব কত ভালোবাসি॥"


তারপর নেই, কিছু নেই ।শেষের দিকে পাতার পর পাতা জুড়ে একটাই কথা লেখা বারবার , "বৃষ্টি আসুক....." 
        জুঁই জানে না কার জন্য এত ভালোবাসা মা যত্ন করে রেখে দিয়ে গেছে।বড্ড অস্থির, অসহায় লাগে নিজেকে?! এ কেমনতর রূপকথা?! কখনো তো মায়ের কোথাও শূন্যতা দেখে নি সে ।তবে মা এত বৃষ্টি চেয়েছিল কেন?! কেনই বা সে সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল ।জুঁইরা তো যখন তখন রেইনমেশিন দিয়ে বৃষ্টি এনে দিতে পারে ।ইসস.. মা-কে যদি বৃষ্টি এনে দিতে পারতো...... 
       কখন যে সন্ধ্যে নেমেছে বুঝতেও পারে নি জুঁই ।পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে পারিজাত কাকুর ভেঙে যাওয়া গলায় মায়ের সেই প্রিয় গান, " এই করেছ ভালো, নিঠুর হে, নিঠুর হে, এই করেছ ভালো ।
এমনি ক'রে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো ।।
আমার এ ধুপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,
আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো ।।
যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার ।
অন্ধকারে মোহে লাজে চোখে তোমায় দেখি না যে,
বজ্রে তোলো আগুন ক'রে আমার যত কালো ।।"

অজানা রূপকথাটি জ্যোৎস্নার আলোয় জ্বলজ্বল করছে জুঁই-এর সামনে, আর সেই আলোয় চিকচিক করছে পারিজাত কাকুর চোখের জল ।বাঁধ ভাঙা বৃষ্টি নামছে জুঁই-এর চোখেও ।মা তো যে সে বৃষ্টি চাই নি তবে, এতো তার স্বপ্নের ইচ্ছাবৃষ্টি - দেবতা জ্ঞানে পূজা করে প্রেমের নিষ্পাপ কান্না ।আকাশের যে তারাটি দূর থেকে দেখছে তাদের, তাঁকে ফিসফিস করে বলে জুঁই - "দেখো মা, তোমার বৃষ্টি এসেছে আজ..... "

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন