মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

যুগান্তর মিত্র


আয় বৃষ্টি, আয় 
_________ 
 

দোতলার ব্যালকনি থেকে রামুদাকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেই সারা শরীর কেমন যেন শিরশির করে উঠল রুচিরার কাল সন্ধ্যার সেই ঘটনাটা মনে পড়ে গেল কেন যে এমন ঘটল কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সে 
সাদামাটা জীবনের দুই পা কাটা রামু ক্রমে নিজের একটা অদ্ভুত গুণের জন্য বেশ পরিচিত হয়ে গেল পাড়ায় বেপাড়ায় আচমকাই এই গুণটা রামু অর্জন করেছে রামুকে এখন একডাকে সবাই চেনে সে এখন সবার রামুদা 
একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করত সে মাইনে খুব বেশি ছিল না তাই অফিস যাওয়ার আগে সকালে ক্লাশ সিক্স-সেভেন-এইটের ছেলেমেয়েদের অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়াত পড়াতে পড়াতে রোজই দেরি হয়ে যায় ফলে দৌড়ে ট্রেন ধরা প্রায় অভ্যেস হয়ে গেছিল তার এইরকম একদিন দৌড়ে ট্রেন ধরতে গিয়ে বিরাট একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেল ট্রেন আর প্ল্যাটফর্মের ফাঁক দিয়ে গলে গেল রামুর শরীর সবাই হইহই করে উঠল মানুষের চিত্কার-চেঁচামেচিতে ট্রেনও থেমে ছিল কিছুক্ষণ তারপর যখন ট্রেন বেরিয়ে গেল প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে, তখন দেখা গেল রামুর নিথর শরীর পড়ে আছে লাইনের ফাঁকে একটা পা কোমড় থেকে কাটা, অন্যটা হাঁটুর উপর থেকে সারা গা ছড়ে গেছে কিছুক্ষণ পরে রেলের সংশিষ্ট কর্মীরা যখন তার শরীরে হাত রাখল প্রথম, তখনই রামুর শরীর নড়ে উঠল তারাই তাকে নিয়ে গেল রেলের হাসপাতালে প্রায় মাসখানেক পরে রামু যখন ক্রাচে ভর দিয়ে বাড়ি ফিরল, ততদিনে জেনে গেছে তাকে আর রাখবে না কোম্পানি কর্মশক্তিহীন কর্মচারী তাদের দরকার নেই এর কিছুদিন পরেই দেড় বছর আগে বিয়ে করা বউ বাপের বাড়ি গেল সেই যে গেল আর ফেরেনি 
দুই পা কাটা পড়া, চাকরি চলে যাওয়া, বউ ছেড়ে যাওয়া সবমিলিয়ে রামুর মানসিক অবস্থা এমন ধাক্কা খেল যে মাথাটাই বিগড়ে গেল বৃদ্ধ বাবা-মা একে-তাকে ধরে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করালেন মাস ছয়েক সেখানে কাটানোর পর অন্য এক রামু ফিরে এল সবসময়ই মুখে হাসি লেগে থাকে পাড়ার ক্লাব অন্যান্যরা চাঁদা তুলে রামুকে লটারির টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা করে দিল বয়স্ক বাবা-মা আর এক দূর সম্পর্কের পিসিকে নিয়ে গড়ে ওঠা সংসারের ভার আবার কাঁধে তুলে নিল রামু 
~ কী গো বিনোদ দাদা, বৃষ্টির খবর কী? 

রামুর কথা শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিনোদ বলে, কই আর বৃষ্টি ভাই, আকাশে মেঘের চিহ্নই তো নাই 
~ তা বৃষ্টি হলে ভালোই হায় কী বলো? তা এনে দেবো নাকি বৃষ্টি? 

চোখ সরু করে রামুকে দেখে বিনোদ নিবারণ আর বরুণকে নিয়ে মাঠে কাজ করছিল তারাও অবাক হয়ে দেখে রামুকে বিনোদ নিবারণকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, রামার মাথাটা কি আবার গেছে নাকি রে? 
~ তা তো জানি না বাবা তেমন খবর তো শুনি নাই তয় মনে হয় গেছেই 

ওরা তাকিয়ে দেখে রামু আকাশের দিকে তাকিয়ে দু'হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখ বন্ধ জোরে জোরে বলছে, আয় বৃষ্টি, আয় বৃষ্টি আয়আয় বৃষ্টি, আয় বৃষ্টি, আয় 
কিছুক্ষণ পরে রামু চেঁচিয়ে বলে, চিন্তা কোরো না বৃষ্টি এল বলে 
~ যত্তসব পাগলের কারবার ! কামকাজের সময় ম্যালা ইয়ার্কি করিস না বাড়িত যা রামা 

কোনো কথা না-বলে মুচকি হাসে রামু তারপর যেমন এসেছিল সেভাবেই ক্রাচে ভর দিয়ে চলে যায় 
আশ্চর্যের ব্যাপার হল সত্যিই কিছু সময় বাদে তুমুল বৃষ্টি এল সঙ্গে ছিল এলোপাতাড়ি ঝড় বিনোদ নিবারণরা সেই কথা বলে বেড়াল সবাইকে কেউ কেউ বলল এসব কাকতালীয় ব্যাপার ! এভাবে বলা যায় নাকি? সবাইকে অবাক করে দিয়ে রামু আবার একদিন বলে দিল, আজ যতই মেঘ থাকুক, বৃষ্টি কিন্তু হবে না তবে কাল শিলাবৃষ্টি হবে এবারও তার কথা মিলে গেল 
হেডমাস্টার সুদীপবাবু একদিন লটারির টিকিট নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে রামু, তুই যে এসব বলে দিতে পারছিস, তা এর রহস্যটা বল তো বাপ? কোন্ বিজ্ঞানে এসব বলিস? 
~ জানি না স্যার, আমি কিচ্ছু জানি না কে যেন আমাকে দিয়ে এসব বলায় 

~ আর কী কী বলায় শুনি? চরম অবিশ্বাসে তিনি জিজ্ঞাসা করেন 

~ ক্রাচ মাটিতে ফেলে বসে পড়ে রামু একমুঠো মাটি হাতে নিয়ে কানের কাছে ধরে তারপর বলে, আজ আপনার ছেলে ফিরবে স্যার এই এখুনি মাটিতে আপনার ছেলের আসার সংবাদ শুনতে পাচ্ছি 

চোখ বড় বড় করে হেডমাস্টার বলেন, আজ আসবে ? এখন? কী সব বলিস তুই ! কালই তো কথা হল আগামী মাসের আগে আসবে না ওর অফিস এখন ছুটি দেবে না কথা শেষ হওয়ার আগেই দূরে চোখ যায় হেডমাস্টারের আর দেখতে পায় সত্যিই তাঁর ছেলে আসছে দিল্লি থেকে প্লেনে চলে এসেছে বাবাকে সারপ্রাইস দেবে বলে আগে কিছুই জানায়নি 
এরপর থেকে সকলের রামুদা হয়ে গেল ভবিষ্যৎবক্তা তবে সবাইকে ভবিষ্যতের কথা বলে না কোনো কোনো লোকের প্রশ্ন শুনে একদম চুপচাপ থাকে তারা নিরাশ হয় কিন্তু রামু নির্বিকার আবার কাউকে একবারেই যা বলার বলে দেয়, আর অব্যর্থভাবে মিলেও যায় 
এইসব ঘটনা বেশ কয়েকবছর আগেকার রুচিরা তখন সবে ক্লাশ নাইনে পড়ে রামু যখন ক্রাচ নিয়ে চলাফেরা করত, তখন দেখা যেত তার শরীর আর হাঁটুর উপরে থাকা পা-টা ক্রাচের মাঝে দুলছে একবার রামুকে আসতে দেখে বাপিদা বলেছিল, দেখ ছুটকি, রামুদার পা-টা কেমন সামনে বন্দুকের মতো উঠছে আর নেমে যাচ্ছে 
~ ধ্যাত্ বাপিদা, এভাবে বোলো না! কত কষ্ট বলো তো রামুদার? 

~ সে আর বলতে, কম কষ্ট নাকি? দুটো পা নেই যাও মাঝের পা আছে, তাও কাজে লাগানোর উপায় নেই 

কথাটা বলেই বাপি খ্যাক খ্যাক হাসে রুচিরাও সেই হাসিতে যোগ দিয়ে লুটিয়ে পড়ে তুমি না বড্ড অসভ্য বাপিদা 
এইসব কথার মাঝেই রামুদা একদম কাছাকাছি চলে এসেছে বাপিরে, যার জ্বালা সেই বোঝে তুই আর কী বুঝবি ! রামু সরাসরি বাপিকে কথাটা বলে এত আস্তে বলা কথা তো তার শোনার কথা নয় ! তাহলে বলল কী করে ওকে ! রামুদা কি মনের কথাও পড়তে পারে? মাথা নীচু করে কথাটা ভাবতে ভাবতে সেখান থেকে সরে যায় বাপি আর রুচিরাও মাথা নীচু করে থাকে রামুর দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারে না 
~ ছুটকি, একদিন আমাকে তোর দরকার হবে সেদিন বলিস, তোর জন্য বৃষ্টি এনে দেবো সেই বৃষ্টিতে তুই ভিজে যাবি আমিও ভিজব তোকে আমি বৃষ্টি আনা শিখিয়ে দেবো 

কথাটার মধ্যে খারাপ একটা ইঙ্গিত আছে কি? ভাবে রুচিরা কিন্তু এইমাত্র যা ঘটে গেল তার সামনে, সে এক লজ্জাজনক ঘটনা তাই রামুদার কথার কোনো জবাব দিতে পারেনি সেদিন 
আজ এতদিন পরে রামুদার কথা মনে পড়ছে তার বিয়ে করেছে ভালোবেসে প্রিতমকে কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস পর থেকে প্রিতমের ছাড়া-ছাড়া ভাব লক্ষ্য করে রুচিরা ধীরে ধীরে রুচিরা টের পায় প্রিতম অন্য একজনের প্রেমে পড়েছে তার সাক্ষ্যও কিছু কিছু পেয়েছে কিন্তু প্রিতমকে কিচ্ছু বলেনি অপেক্ষা করেছে প্রিতম নিজেই কবে বলে! এই অপেক্ষা আর ঔদাসীন্যের মাঝেই হু হু করে ঢুকে পড়ে অরিজিত্ সেই অরিজিৎকে আজ আসতে বলেছে এবাড়ি বাবা-মা গেছে মামার বাড়িতে এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইছে রুচিরা 
বিকেলের আলো মরে এসেছে সেইসময়ই রামুদার আচমকা আবির্ভাব 
~ ছুটকি, কেমন আছিস? দোতলার বারান্দায় তাকিয়ে বলল রামু 

~ ভালো আছি রামুদা তুমি কেমন আছো? 

~ আমিও ভালো আছি রে আজ তোর মনের মানুষ আসবে ? চোখ নাচিয়ে রামু বলে 

অবাক হয় রুচিরা ইঙ্গিতে রামুকে দাঁড়াতে বলে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আসে কাছে আসতেই রামু বলে ওঠে, এই দেখ, এইভাবে দু'হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিকে ডাকতে হয় তোর মনের গভীরে মেঘ জাগাতে হবে ছুটকি সেই মেঘটা আকাশে চলে যাবে তোর ইচ্ছেশক্তিতে সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি হবে কোনো মন্ত্র নেই শুধুই ইচ্ছেশক্তি আর কাউকে বলিস না কিন্তু ক্রাচে ভর দিয়ে চলে যেতে যেতে বলে যায় রামু 
একটু পরেই অরিজিত্ আসে সারা দুপুর যে অপেক্ষায় রুচিরার ভেতরটা তোলপাড় করছিল, সেই টানটা কেমন যেন মিইয়ে গেল অরিজিতের বউ আর ছেলের কথাও জিজ্ঞাসা করল রুচিরা খানিকটা যেন নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্যই 
~ আজ থাক না রুচি ওদের কথা আজ শুধু তুমি আর আমি 

মুখে আলতো হাসির আলখাল্লা ঝুলিয়ে রাখে রুচিরা 'আচ্ছা তাই হোক' বলে সে অরিজিতের দিকে বলটা গড়িয়ে দেয় তুমিই বলো আজ আমি শুনি 
অরিজিতের কিন্তু বলাতে তেমন মন নেই সে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে থাকে রুচিরাকে রুচিরা এবার একটু নড়েচড়ে ওঠে তারপর অরিজিৎকে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে যায় সেখানে দু'হাত ছড়িয়ে রামুদার শেখানো বিদ্যে প্রয়োগ করে অরিজিৎ অবাক হয়ে দেখে আশ্চর্যজনকভাবে আচমকা বৃষ্টি নেমে আসে সেই বৃষ্টি রুচিরা সারা শরীরে মেখে নেয় অরিজিৎকেও ডাকে প্রথমে অরিজিৎ রাজি না-হলেও রুচির জোরের কাছে হার মানে অরিজিৎ খানিকক্ষণ ভিজেই রুচিকে কোলে তুলে চিলেকোঠায় নিয়ে আসে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে একটা একটা করে সমস্ত পোশাক খুলে ফেলে নিজের আর রুচির রুচিরা বাধা দেয় না তুমুল শরীর মিলে যেতে থাকে বৃষ্টির ঝমঝমের সাথেই 
হঠাৎই রুচিরা উপলব্ধি করে, তার স্তনে আলতো কামড় দিচ্ছে অরিজিৎ নয়, অন্য কেউ যেন ক্লিন সেভ অরিজিৎ, কিন্তু বুকের সুডৌল মাংপিণ্ডে খোঁচা খোঁচা দাড়ির জ্বলুনি অনুভব করে সঙ্গে সঙ্গেই দুলে ওঠে রুচিরার সারা শরীর পরক্ষণেই বুঝতে পারে, রামুদার কাটা হাঁটু তার কোমড়ে আঘাত করছে বিস্ময় নিয়ে ভালো করে দেখে অরিজিতেরও আর-একটা পা কোমড় থেকে নেই কে ? রামুদা? ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রুচিরা অরিজিতের পিঠ আঁকড়ে ধরে বলে, কথা বলো অরি শুধু করে যাচ্ছ কেন? কথা বলো প্লিজ 
~ ছুটকি, ছুটকিবহুদিনের খিদে রে আমি আর পারছিলাম নাঅবিকল রামুদার গলায় কথা বলছে অরি 

ধাক্কা মেরে নিজের উপর থেকে অরিকে ফেলে দেয় রুচিরা হতভম্ব অরিজিৎ উঠে দাঁড়ায় তারপর কিছুক্ষণ রুচির দিকে তাকিয়ে থেকে আর কিছু না-বলে জামাপ্যান্ট গলিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় তার চোখেমুখে অপমানের ছাপ 
আজ রামুদাকে একইসময়ে আসতে দেখে প্রথমটায় লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে রুচিরা তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে দোতলা থেকেই চিত্কার করে ওঠে, রামুদা, রামুদা, দাঁড়াও তোমাকে আমার খুব দরকার 
তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে রুচিরা মনে হচ্ছে যেন অন্তত কাল ধরে সে নেমেই চলেছে, আর কার ফিসফিস কণ্ঠস্বর ভেসে বেড়াচ্ছে তার কানে, আয় বৃষ্টি, আয় বৃষ্টি, আয়
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন