মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

দীপঙ্কর বেরা



বৃষ্টির স্রোত  


বিকেলের দিকে গামলার মত সারা আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে শন শন শব্দে দূরে থেকে ধেয়ে এল মুষল ধারা বৃষ্টি । গাছের পাতায় টপ টপ পুকুরে টগবগ মাঠে উঠোনে টিপ টিপ টিনের চালে ঝমঝম গোপলাদের খড়ের চাল বেয়ে ঝরঝর শব্দে হতে লাগল আষাঢ়ের বৃষ্টি । 
একটু দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না । জল সব মাটি ধুয়ে নিয়ে নিজেই তার গতি তৈরী করে গব গব করে পুকুরে পড়ছে । সেই পুকুরের ও পারে একটা লোক মানব জ্যেঠু হবে বোধহয় ছাতা নিয়ে বড় শিরিষ গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে আছে । পুরো ভিজে যাচ্ছে তবুও না ভেজার আপ্রাণ চেষ্টা করছে । 
খড়ের চাল টপকে গোপলাদের ঘরও ভিজে একসা । চারদিকে যে জল যাওয়ার রাস্তা তাই টপকে জল ঢুকে পড়ছে ঘরে । তাকে আটকাচ্ছে আর ঘরের অন্যান্য জিনিস এমনকি দাদা দিদি ও গোপলার বইপত্র সামলাছে গোপলার মা বাবা দাদা দিদি । ঘরের ভেতরে ফুটো চালের ফোঁটা ফোঁটা জল আটকাতে নানান বাসনপত্র রাখা । তাতেও কিছু হচ্ছে না । ঘরের সামনে পলিথিনের পর্দা দেওয়া তাই সরিয়ে বার বার আকাশ ঝরা টিপ টিপ ঝরঝর বৃষ্টির ফোঁটার নানান কারুকার্য দেখতে ব্যস্ত । বাধা দিচ্ছে সবাই । খুব ইচ্ছে আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখতে কেমন করে নামছে বৃষ্টির ফোঁটার রাশি দলবেঁধে । কিন্তু মাঝে মাঝে গা শিউরে যায় চকমকি আলো আর কান ফাটানো বিদ্যুতের শব্দে । 
ঘরের সামনে দিয়ে চলছে গোপলার উচ্ছ্বাস নদী । ছোট কিন্তু বয়ে নিয়ে যাচ্ছে শুকনো ঘাস পাতা ছেঁড়া কাগজ মাটি খড় কুটোডালপালা আরো কত কি ধারা বর্ষণের এই গতিতে গোপলার নিজের জীবনে কত কি আনন্দের অবিরাম স্রোত বয়ে যাচ্ছে । 
হাতের কাছে বাবার বাজার করা ফর্দটাকে নৌকোর মত করে হাত বাড়িয়ে ফেলতে না ফেলতে সাঁই করে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল । তাই দেখতে মুখ বাড়াতেই হাত পা তো ভিজল সেই সাথে মাথাটা ভিজে গেল । আর সারা বাড়ি রে রে করে তেড়ে এল । মা আঁচল দিয়ে মাথা মোছাতে লাগল । মায়ের এই আঁচলের গন্ধে গোপলা একেবারে বিভোর হয়ে যায় । বুঝতে পারে মায়ের হৃদয় যেখান থেকে সারাক্ষণ ভালোবাসার বারিধারা এই বৃষ্টির মত ঝরতেই আছে । 
গাছগুলো সৈনিকের মত বৃষ্টিতে অবগাহন করছে নিজের মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে । একটু দূরে অন্য বাড়ির কত ময়লা গোপলাদের সামনে ঢেলে রাখা ছিল । বাবা মায়ের সাথে কত ঝগড়া । গোপলাদেরও গন্ধে অতীষ্ঠ হতে হত । আজ তা প্রায় ধুয়ে মুছে একসা । যদিও জানে আবার ওরা ফেলবে তবুও সরে গেল অনেক মাটি । এবার কি ঢালতে পারবে ?বাবা বলছে - ওরে বাস ! কত বৃষ্টি এবার থাম । তবে মাঠের ফসল প্রাণ পেল । কিন্তু আমাদের যে ঘর ভেসে গেল । ফুটো চালের নীচে জল ধরার মত আর বাসন নাই । 
তাই দেখতে গোপলার বেশ মজা । ঘরে টপ টপ আর বাইরেও একটানা ।
মা বলছে - দেখো এ বছর ভাল ফসল হবে । খুব গরম ছিল এবার কেঁপে ঝেঁপে দারুন বৃষ্টি । পুকুরটা ভরে গেল বোধ হয় । খুব মাছ উঠে আসবে । বৃষ্টি থামলেই যাব । 
স্রোতের উল্টোদিকে মাছগুলো বেশ উঠে আসতে পছন্দ করে । জোর বৃষ্টির পরে অল্প অল্প নামা জলে পুকুর থেকে উঠে আসা পুঁটি কই শিঙি আরো কত এ সব গোপলা দেখেছে । কিন্তু একটাও নিজের হাতে ধরতে পারে না বলে দাদা দিদি খুব প্যাঁক দেয় । কেমন ফসকে যায় । তাই গোপলা আর যাবে না । 
একটু দূরে গাছের উপর দিকে তাকাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল । পাখির বাসা । জোর টপ টপ বৃষ্টির সাথে বেশ ঝোড়ো হাওয়া কিছুতেই কমছে না । গতকাল বিকেলেই পাশের বাড়ির বিকি দেখে এসেছে বাসতে ডিম আছে । সেই বাসা বোধহয় আর নেই । এ মা ডিমগুলো !
এতক্ষণের ঝমঝম বৃষ্টির মজাটাই মাটি । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে একেবারে কালো । ঝেপে আছে চারদিকে । শনশনে হাওয়াকে কে থামাতে পারে তারই কথা নানান ভাবে গোপলা ভাবতে লাগল । বাবা মা দাদা দিদি সব এতক্ষণে ভিজে চুপসে চুপ করে বসে । বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষা করছে । থেমে গেলে দিদি এদিক ওদিক মরা ডালপালা সাথে আম জাম পেলে কুড়িয়ে আনবে । 
গোপলা বৃষ্টির টানে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না । বেরিয়ে পড়ল । চট করেই ভিজে একসা । আর উঠোন বেশ পিচ্ছিল । গাছের বাসা দেখতে উপরে তাকাতেই পড়ে গেল । কাদায় মাখামাখি । সেই প্রচন্ড বৃষ্টিতে মাকেই বেরিয়ে আসতে হল । প্রায় পাঁজকোলা করে ছপছপ পায়ে গোপলাকে নিয়ে মা ঘরে ঢুকলো । কেন বাইরে গেলি এত বৃষ্টিতে জ্বরে ভুগবি যে । ছেলেটা দিনে দিনে বাঁদর হচ্ছে । চুপ করে গোপলা অঝোর বৃষ্টির মত নীরবে পাখিটার মত মায়ের কোল আর আঁচলে নতুন প্রাণ খুঁজতে লাগল । 
  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন