মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

সন্মাত্রানন্দ


মণিচিত্রথারু


একটি ছবিকে অনুসরণ করছিলাম আমি কয়েকদিন ধরে । আমার এই অনুসরণ করাকে তিরস্কার করেছিলেন একজন রুচিবাতিক বন্ধু, আমার অবশ্য তাতে পরিতাপ হয় না । আমি আসলে গল্পটিকে অনুসরণ করছিলাম । মালয়ালম ভাষা দিয়ে শুরু -- মণিচিত্রথারু (১৯৯৩) । মণি মুত্থমের লেখা স্ক্রিপ্ট, তাঁরই লেখা গল্পটি । মনস্তাত্ত্বিক ভীতিরসাত্মক গল্প । সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের অবসিত কিছু পৃষ্ঠা, আর সাম্প্রতিক কৌতুক । এ গল্প কন্নড় ভাষায় রূপ নেয় 'আপ্তমিত্র' নামের ছবিতে ২০০৪ এ, আর তামিল ও তেলুগুতে 'চন্দ্রমুখী' নামে ২০০৫এ । কাহিনীতে কিছু অমুখ্য পরিবর্তন আসে, স্থূলরুচি হয়ে ওঠে রজনীকান্তসুলভ মোটা দাগের অভিনয়ে । সবথেকে খারাপ রূপ নেয় বাংলা ছবিতে 'রাজমহল' শিরোণামে ওই একই বছর । অবশেষে অনেক হাত ফিরে হিন্দীতে রূপ পায় 'ভুলভুলাইয়া' হয়ে ২০০৭ এ । এবার মানরক্ষা হয় কিছুটা নয়, অনেকটাই । তবে মালয়ালম ফিল্মটিই আমার মতে সেরা ।

দেড়শ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক রাজদরবারের নর্তকী ভালোবাসে এক নর্তককে । কিন্তু তাদের এই প্রণয়কে সহ্য করেন না রাজা, নর্তকী যার রক্ষিতা । নাচের এক আসরে রাজা হত্যা করেন প্রণয়িযুগলের একজনকে ( মালয়ালমে নর্তকীকে, হিন্দীতে নর্তককে -- কন্নড়ে নর্তকীর গায়ে আগুন লাগানো হয়, অন্য ভাষায় হত্যাকান্ড অনুষ্ঠিত হয় তরবারির আঘাতে) এবং অন্যজন আত্মহত্যা করে । রাজাও শেষ হয়ে যান কালবশে অথবা অপঘাতে ।

সেই রাজবাড়ির শেষতম পুরুষ এক যুবক প্রবাস থেকে সস্ত্রীক ফিরেছেন । আত্মীয়স্বজনের বাধাসত্ত্বেও পুরোনো সেই বাড়িটিতে আশ্রয় নিয়েছেন, তরুণী বধূটির কৌতুহল ত্রিতলের বন্ধ দরোজা ঘরটির প্রতি । এখানেই না কী থাকত সেই রাজা, অন্য ঘরে সেই নর্তকী, বাসগৃহের এক পাশের বাতায়নপথে না কী দেখা যেত সেই প্রেমিক নর্তকের ঘর... আজ সেখানে তাকে এক কবি...আর বন্ধ দরোজার ওপাশে না কী শোনা যায় ঘুঙুরের ঝুমঝুম... নাচের বোল, গানের কলি, চাপা ক্রুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস...

মেয়েটি মণিচিত্রিত বন্ধ দরোজা খুলে ফেলে একদিন, তারপর থেকে নর্তকীর ব্যবহৃত বেশবাস, অলঙ্কার নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে মানসিক অসুস্থতার ভিতর দিয়ে মাঝে মাঝেই হয়ে উঠতে থাকে সার্ধশতবর্ষ আগের সেই অপরিতৃপ্ত নর্তকী । কীভাবে তাকে স্বাভাবিক করে তোলা হল এক মনোরোগবিদ এবং এক তন্ত্রোপাসকের হস্তক্ষেপে, দেড়শ বছর আগের সেই হারিয়ে যাওয়া নৃত্যসন্ধ্যার পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে, সে এক রোমাঞ্চকর, প্রতিহিংসাময়, বিষাদময় কাহিনী, অন্তিমে যার শুভ্রহাস্যের ছটা ।

অনেকদিন দক্ষিণদেশে থাকায় মালয়ালম, তামিল, তেলুগু বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমার । দেখছিলাম শুধু একটি শক্তিশালী কাহিনীবয়ন কেমন করে বারো বছর শাসন করে সিনেমাকে । দেখছিলাম শোভনা চন্দ্রকুমার পিল্লাইয়ের মত ঋদ্ধিময়ী ভারতনাট্যমশিল্পীর প্রতিস্পর্ধী অভিনয় । আর দেখছিলাম, নানা প্রদেশের প্রথাপদ্ধতির ভিতর দিয়ে সংলাপ বদলে যায় কী ভাবে ।যাঁরা হিন্দী ভুলভুলাইয়া দেখেছেন, তাঁদের বলব, মূল মালয়ালম ছবিটি দেখতে, যদি না আপনাদের অবস্থা আমার রুচিবাতিক বন্ধুর মত হয় ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন