মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

অর্ঘ্য দত্ত



অন্য বর্ষণ  


জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এই সকাল দশটাতেই খাঁ-খাঁ করা গরম। কাসারা যাওয়ার লোকাল ট্রেনে জানলার ধারে একা বসেছিল ঘিয়ে রঙের চুড়িদার-কুর্তা আর অন্যমনস্ক রোদ চশমাটি। সমস্ত স্টেশনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চলেছে প্রায় ফাঁকা ট্রেনটা। কল্যান পেরোনোর পর স্টেশনগুলোও ক্রমশ যেন জনবিরল হতে থাকে। তেমনি একটা স্টেশন, খাড়াওলি থেকে কাছা দিয়ে রানিরঙের শাড়ি আর নাকে বিশাল নাকছাবি পরা এক মহিলা এক ঝুড়ি শসা মাথায় নিয়ে ঠিক ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে লাফ দিয়ে ওঠেই তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, 'কাঁকড়ি ধা ধা রুপাইয়া' দু-চার জন যাত্রী দশ টাকা দিয়ে বিট-নুন মাখানো ফালি করে কাটা শসা কিনে খেতে শুরু করলো ট্রেনে বসেই। রোদচশমাটিতে এসবের ছায়াও পড়ে না।  জানলার রডে মাথা রেখে শ্রাবণী তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। চলন্ত ট্রেনের বাইরে দ্রুত সরে সরে যেতে থাকে ঢেউ তোলা রুক্ষ পাথুরে ধু ধু প্রান্তর। শ্রাবণী টের পায় ঝরা কাঠাল পাতার মতো নানান টুকরো-টাকরা স্মৃতি  পাক খেয়ে খেয়ে ক্রমশ ঘূর্ণি তুলছে ওর উঠোনজুড়ে। দীর্ঘ দহনে জ্বলা ঘাস-গুল্মের শবের হলদে ছোপ ছোপ দাগ ডিঙিয়ে যেন ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ উঠে আসছে। যদিও জানলার বাইরে তীব্র তাপে কাঁপছে হাওয়া।  কাঁপছে ন্যাড়া গাছ। রেল লাইনের ধারে কাছে-দূরে নিচু চালের দেহাতি গ্রামের ছবিগুলো রুপালি রৌদ্রে তিরতির করে কাঁপছে। গতকাল রাত থেকে শ্রাবনীর ভেতরেও কেঁপে কেঁপে উঠছে থম মেরে থাকা ভারি মেঘ। সাদা মেঘের ভেলা নয়। পেঁজা তুলোও নয়। কালো। ঠোঁট ফোলানো। ভরসন্ধ্যায় মা ঘুটে-কয়লার তোলা উনুনে আঁচ ধরালে যেমন কালো ধোঁয়া রান্নাঘরের ছোট জানলা গলে  কলপাড়ের পেয়ারা গাছটাকে জড়িয়ে থম মেরে থাকতো, তেমনি।   নিজেও সবসময় বুঝতে পারে না কেন এমন হয়, কেন তেমনি করে 'মেঘও জড়িয়ে থাকে শ্রাবনীকে!
কাল রাতে ঋতুর সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই ওর এই এলোমেলো অবস্থা। আসলে এতদিন তো শ্রাবণী যা বলেছে মেয়ের কাছে তাই ছিল বাতিঘরের ইশারার মতো অমোঘ। কোনোদিনও অমান্য করেনি। এই প্রথম তার ব্যত্যয় হল। কলিগ রাজেন্দ্র যাদবকে বলে আজকের জন্য ওয়াটার কিংডমের তিনটে পাস জোগাড় করে রেখেছিল শ্রাবণী। ভেবেছিল ঋতু হোস্টেল থেকে ভোরে বেরিয়ে সকাল দশটার মধ্যে চলে এলে ঋতুরই ছোটবেলার বন্ধু পাশের ফ্ল্যাটের ভূমিকাকে নিয়ে ওরা তিনজন গরাইয়ে ওয়াটার কিংডমে যাবে। রাজেন্দ্রর নিজেরও সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, আমল দেয়নি। ওরা তিনজন সারাটা দিন সেখানে নানারকম জল-খেলায় হৈ হৈ করে কাটিয়ে রাতে বাইরে ডিনার করে ফিরবে। পরের দিন সকালে শ্রাবণী অফিসে এবং ঋতু চাইলে ফিরে যাবে হোস্টেলে। থানে স্টেশন থেকে তিন-চার ঘন্টার তো ব্যাপার। ঋতুর প্রায় প্রতিটা জন্মদিনেই, বিশেষ করে অরিণের সাথে পাকাপাকি বিচ্ছেদের পর থেকে, শ্রাবণী এমনই সব হৈ-হৈ করে বাইরে কাটানোর পরিকল্পনা করে যাতে মেয়েটা কখনো বাবার অভাব অনুভব না করতে পারে। গতবছরও ঋতুর স্কুলের দুটি বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ওয়াটার কিংডমে এসেছিল। কী মজাই না করেছিল মেয়েটা! অথচ গতকাল রাতে যখন ফোন করে আসতে বললো কী ঠান্ডা উদাসীন প্রতিক্রিয়া সেই মেয়ের! এবছর জন্মদিনে তার নাকি বাড়ি আসা হবে না। অন্য পরিকল্পনা আছে!
--
না, না, মা।  'গট সাম আদার প্লান। প্লিজ!
--
গতবারও তো গিয়েছিলি। ভুলে গেছিস কত আনন্দ করেছিলি। বলেছিলি আবার আসবি, তাই তো আমি... কাল ভোরে রওনা দিয়ে সকালে চলে আয়। চাইলে পরশু সকালেই ফিরে যাস।
--  
নোপ্। নো ওয়ে। তুমি বরং ওখানে যে টাকাটা খরচ করতে সে টাকাটা আমাকে দিও। জানো বাপী আমার অ্যাকাউন্টে দশহাজার টাকা জমা করেছে, আমার বার্থ ডে গিফ্ট
-- কে? কে বললি?
--
বাপী। আবার কে! শ্রী অরিণ দে। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠেছিল ঋতু।
শ্রাবণীর মনে হচ্ছিল নিজের হাতের স্মার্ট ফোনটা মেঝেতে আছাড় মারে। অরিণের থেকে টাকা নিয়েছে ঋতু!  একা হাতে এই মেয়েকেই বড় করতে গিয়ে শত অসুবিধাতেও যার থেকে কখনো একটি পয়সাও নেয়নি! ওর নীরবতা টের পেয়ে ঋতু হাসি থামিয়ে বলে,
--
প্রতিবারই তো বাপী দিতে চায় আর শুধু তুমি দুঃখ পাবে বলে আমি রিফিউজ করি, মা। এবারে অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস দেওয়াতে বাপী সঙ্গে সঙ্গে ট্রান্সফার করে দিল। আমি কাল সকালেই এটিএম থেকে তুলে নেব।
শ্রাবণী কানে ফোন চেপে রেখেই বুঝতে পারছিল ওর উঠোনে খড়কুটো উড়তে শুরু করেছে, ঝড়ো হাওয়া বইছে শন্ শন্। মেঘ জমছে।
--
কী করবি তুই এত টাকা দিয়ে? দরকার তো আমাকে বলিসনি কেন? এদিকে তো বলছিস বাড়ি আসবি না। তোর কলেজ পাড়ার গন্ডগ্রামে না আছে কোনো মল না তো ম্যাকডোনাল্ডের একটা আউটলেট। তাহলে?
ভেতরে ভেতরে ভয় হচ্ছিল শ্রাবণীর। কোনো ড্রাগ-ট্রাগের নেশায় জড়িয়ে পড়ল না তো মেয়েটা! ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা সবে মিটেছে, তাও যে মেয়ে কিছুদিন আগেও মাকে ছাড়া একটা রাত কোথাও থাকতে পারতো না সে এখন হোস্টেল ছেড়ে বাড়িই আসতে চাইছে না!  আজকাল কাগজে এই বয়সি ছেলেমেয়েদের নানান নেশার কথা পড়ে। বুকটা কেঁপে ওঠে ওর। ঋতু ফোনের ওপার থেকে মার দুশ্চিন্তাটুকু আঁচ করেই বোধহয় বলে,
--
মা, তুমি বরং কাল অফিস ডান্ডি মেরে আমার এখানে চলে এসো না!
--
তোর হোস্টেলে? কাল তো কলেজও খোলা।
--
না। হোস্টেলে আসতে হবে না। তবে কাল কলেজেও যাবো না। অন্য একটা জায়গায় যাব। তোমাকেও নিয়ে যাব। তুমি এক কাজ করো, কাসারা থেকে নাসিক যাওয়ার শেয়ার ট্যাক্সি নিয়ে গোন্ডে চলে এসো। আমি হাইওয়ের ধারে অপেক্ষা করবো।
--
কোথায় যাবি?
--
ডেটিং-এ। বলেই হি হি করে হেসে ওঠে আঠেরোর ঋতু।
শ্রাবণীর মনে হয়, মাত্র একবছরেই কত পাল্টে গেছে তার মেয়েটা। যেন অন্য কোনো অচেনা মানুষ। কবে এত বড় স্বাধীন হয়ে গেল ঋতু? বাড়িতে মার কাছে না এসে কলেজ কামাই করে কার সঙ্গে কাটাবে জন্মদিন? কার পাল্লায় পড়ল ওর একমাত্র ভরসা এই মেয়ে! অরিণকেও আবার জন্মদিন বলে ডেকে আনবে না তো!  এতদিন বাদে বাপ সোহাগ দেখাতে এলে আমি ছেড়ে দেব না, মনে মনে বলে শ্রাবণী। মুখে বলে,
--
ঠিক আছে, আমিই আসছি তোর কাছে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছে যাব।
--
আমার জন্মদিনে যে খরচ করতে সেই টাকাটা আমাকে ক্যাশে দিও মা। প্লিজ। কালই।
--
আচ্ছা, ঠিক আছে ঠান্ডা গলায় বলে ফোনটা কেটে দিল শ্রাবণী। যে ঋতুর জন্য একটা ট্রেন্ডি ঘড়ি কিনে রেখেছে সেটাও আর ফোনে বলতে ইচ্ছে করলো না। গত এগারো বছর ধরে একা বড় করেছে যে মেয়েকে, যার সব অভাব মেটানোর চেষ্টা করেছে, আজ তার এমন কী প্রয়োজন পড়ল যে মা অসন্তুষ্ট হবে জেনেও অরিণের থেকে টাকা নিয়ে নিল! এমনকি ওকেও অম্লান বদনে বলে দিল ক্যাশ টাকা গিফ্ট করতে। কেন? কী করবে টাকা দিয়ে? সারারাত ছটফট করেছে শ্রাবণী। ভালো করে ঘুমাতে পারেনি দুশ্চিন্তা অভিমানে। কিছুদিন আগেই কলেজে পড়া ছেলে মেয়েদের মাদকাসক্তি নিয়ে লেখা পড়েছিল, সে কথাই মনে পড়ছিল শুধু। মনে পড়ছিল, কোথায় যাবে প্রশ্ন করাতে ঋতু হেসে বলেছিল 'ডেটিং' এদিকে আবার ওকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে বলছে। কিছুই বুঝতে পারে না ও।  মনে হচ্ছে যেন মেয়ে যতদিন ছোটো ছিল, অনেক ভালো ছিল


কাসারা স্টেশনের বাইরে থেকে নেওয়া নাসিক যাওয়ার শেয়ার ট্যাক্সি যখন গোন্ডে পেট্রলপাম্প পেরিয়ে হাইওয়ে থেকে বাঁ দিকের প্রথম সরু রাস্তাটার মুখে নামিয়ে দিয়ে গেল তখন ঠিক পৌনে বারোটা বাজে। রোদ যেন চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে। দূরে গ্রামের দিকে চলে যাওয়া কালো মাটির সরু পথটার ধারে একটা বাদামি পাতার গাছ একলা দাঁড়িয়ে ছায়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। পাশে একটা ছাপরার গুমটি দোকান। সামনে চেরা কাঠের বেঞ্চ। দুটি হতদরিদ্র মানুষ বেঞ্চে না বসে শূন্য দৃষ্টিতে পথের দিকে তাকিয়ে উবু হয়ে মাটিতে বসে আছে।

ট্যাক্সিটা ওকে নামিয়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাপরার গুমটি থেকে হইহই করতে করতে যে বেরিয়ে আসে তাকে যেন চিনতে অসুবিধা হয় শ্রাবণীর। জিনস্-টপ পরা, মাথা মুখ ওড়না দিয়ে পেঁচানো এবং চোখ সানগ্লাসে ঢাকা মেয়েটি এসে মা বলে জড়িয়ে ধরাতে চিনতে পারে ঋতুকে। শ্রাবণীর হাত ধরে টেনে ছাপরার নিচে নিয়ে যায় ঋতু। সেখানে ছায়াতে জিনস্,টি-শার্ট, টুপি সানগ্লাস পরা দুটি ছেলেকে অপেক্ষা করতে দেখে ধক্ করে ওঠে শ্রাবণীর বুকটা। লক্ষ করে গুমটির পাশেই দুটো স্ট্যান্ড করা মোটরবাইক।  কিছুদিন আগেই খবরের কাগজে দেখা গাদচিরোলিতে পুলিশের গুলিতে মৃত তিন মাওবাদীর ছবিটা কেন যে হঠাৎ মনে পড়ে গেল শ্রাবণীর!
-- লেম্মী ইন্ট্রোডিউস। হি ইজ সুনীল এন্ড হি ইজ গৌরব। বোথ আর মাই ক্লাশমেট। ঋতু বলে।
নমস্তে আন্টি। ছেলেগুলো প্রায় একসাথেই বলে ওঠে।
শ্রাবণী ঋতুকে বলে, তোর মুখ থেকে ওড়নাটা তো খোল, একবার দেখি। আসলে বুঝতেই পারে না ওর কী বলা উচিত। ওই দুটোর মধ্যে একটা ছেলেকে দেখে তো বেশ ষণ্ডাগুন্ডা মার্কা মনে হয়।
---
আরে মুখ তো পরে দেখবেই। দেখছো না এখন কী রোদ। তুমিও মাথা ঢেকে নাও মা। তারপর ছেলেদুটোর দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে বলে, এই সুনীল তুই মাকে তোর বাইকে নে, আমি গৌরবের পেছনে বসছি।
শ্রাবণীর কেমন যেন অসহায় লাগে। ওর বাইকে চড়ার অভ্যাস নেই। তাছাড়া, যতই বয়সে ছোটো হোক তবু একটা অচেনা ছেলের বাইকে চাপতে কেমন অস্বস্তি হয় ওর। বেঞ্চে বসে পড়ে। রুমাল দিয়ে নিজের মুখটা মুছতে থাকে সময় নিয়ে। যেন ওর কোথাও যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। তারপর ব্যাগটা খুলে গিফ্ট-প্যাক করা ঘড়িটা ঋতুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, হ্যাপী বার্থ ডে। আয় তোকে একটা চুমু অন্তত খাই।
--
মম্, ডোন্ট বি সিলি। আমি কি বাচ্ছা মেয়ে?  ঋতু প্যাকেটটা নিজের কাঁধের ঢাউস ব্যাগটায় রাখতে রাখতে বলে। শ্রাবণী খেয়াল করে ঋতু গিফ্ট-প্যাকটা খুললো তো নাই, এমনকি জানতে পর্যন্ত চাইল না কী আছে ভেতরে। কাল থেকে জমে থাকা নিম্নচাপটা আবার টের পায় শ্রাবণী।
--
তোমাকে বলেছিলাম বাজে খরচ না করে ক্যাশ দিও। ঋতুর গলায় বিরক্তি।
--
এই নাও, সেটাও এনেছি। ব্যাগ থেকে বের করে একটা খাম এগিয়ে দেয় ঋতুর দিকে। অজান্তেই ওর মুখ থেকে নে- বদলে নাও বেরোয়। ঋতু অবশ্য  খেয়ালও করে না। খুশি মুখে খামটা ফাঁক করে 'টা পাঁচশো টাকা গুনে নিজের জিন্সের পকেটে চালান করে দিয়েই ঝুঁকে শ্রাবণীকে জড়িয়ে ধরে। ওর ডান গালে চুমু দিয়ে আনন্দে উজ্জ্বল গলায় বলে ওঠে, লাভ ইউ মম।
ছেলেদুটো বাইকে স্টার্ট দিয়ে অপেক্ষা করছিল। ঋতু গিয়ে গৌরব নামের ষন্ডামার্কা ছেলেটার পেছনে দু দিকে পা দিয়ে বুকের সামনে ব্যাগটা রেখে বসে পড়ে। শ্রাবণী নিজের ওড়না দিয়ে মাথাটা ঢেকে একদিকে পা ঝুলিয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে সুনীলের পেছনে। 
--এই সুনীল, স্পীডে চালাবি না। মা কিন্তু ভয় পাবে। ঋতু বলে

হাইওয়ে পেছনে ফেলে দূরবিস্তৃত ধুধু প্রান্তরের মধ্যে সরু মাটির রাস্তা দিয়ে এগোতে থাকে দুটো বাইক। ঋতুকে নিয়ে গৌরবের বাইক সামনে, পেছনে ওরা। দূরে দূরে উঁচু পাহাড়, পশ্চিমঘাট পর্বতমালা।
কদাচিৎ দু একটি মানুষ চোখে পড়ে। তাদের হাঁটুর ওপরে মলিন ধুতি। রোদে পোড়া তামারঙা রোগা দেহ। রাস্তার দুধারের পাথুরে জমিতে শুধু হলদে হয়ে যাওয়া শুকনো ঘাস। এখানে ওখানে একটা দুটো বিরল-পত্র গাছ। মাথার ওপরেই সূর্য থাকাতে সে গাছের ছায়াটুকু পর্যন্ত মাটিতে পড়ছে না। চলন্ত বাইকে বসে শ্রাবণীর মুখের ত্বক চিড়বিড় করতে থাকে গরম হাওয়ায়। প্রায় দু-তিন কিলোমিটার যাওয়ার পরে শ্রাবণী বুঝতে পারে তারা একটা গ্রামের মধ্যে ঢুকছে।

ছাপরার নিচু নিচু ঘর। ঘরের পাশে রুগ্ন কলা গাছ, পেঁপে গাছ কুলগাছ। ঘরের সামনে উঠোনে দড়িতে ঝুলছে সস্তার রঙীন কাপড়-চোপড়। গোলাপি, বেগুনি, সবুজ রঙের মালকোচা মেরে শাড়ি পরা মহিলারা উঠোনে বসে আছে গাছের ছায়ায়। ক্ষয়া শিশুরা দৌড়াদৌড়ি করছে উঠোনে। কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে কঙ্কালসার কুকুর। চারদিকে দারিদ্রের ছাপ। কিন্তু তার মধ্যেই উজ্জ্বল রঙ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। মহিলাদের শাড়িতে, গ্রাম্য ছোট মন্দিরের চূড়ায় ওড়া গেরুয়া পতাকায়, এমনকি ঘরের বাইরে লাল রঙের প্লাস্টিকের বালতি, নীল মগে। মধ্যে মধ্যে নিচু মাঁচা বেঁধে কিছু একটা চাষ করা হয়েছে। শ্রাবণী বুঝতে পারে না ওগুলো কিসের গাছ। বেশিরভাগ জমিই পড়ে আছে শষ্যহীন, ফুটিফাটা হয়ে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে ওরা রাস্তা ছেড়ে নেমে আসে একটা বাড়ির উঠোনে। বিবর্ণ সবুজ চট দিয়ে ঘেরা উঠোনের দু দিকে দুটো ঘর। ছাপরা অপেক্ষাকৃত উঁচু। মাটির দেওয়ালে সাদা রঙের নানান নকশা আঁকা। ঘরের পেছনে অনেকগুলো কলাগাছ। পাশে একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের ড্রাম, মনে হয় জল রাখার জন্য। বাইকের আওয়াজে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে একটি শ্যামলা রোগা বছর আঠারো-উনিশের মেয়ে। পরনে রঙচটা সালোয়ার কামিজ। তার পেছন পেছন লাল শাড়ি পরা একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। আসেপাশের পরিবার থেকেও ছেলেপুলে দৌড়ে এসে ভীড় করে ওদের ঘিরে। বাইক দাঁড় করাতেই ঋতু নেমে মুখ থেকে ওড়না সানগ্লাসটা খুলে মেয়েটির কাছে এগিয়ে যায়। মেয়েটি মধ্যবয়স্ক মহিলার মুখের ঝকঝকে সাদা দাঁতের উজ্জ্বল হাসি দেখে শ্রাবণী বুঝতে পারে এরা ঋতুকে চেনে
ঘরের সামনের নিচু দাওয়াতে একটা রংচটা প্লাস্টিকের মাদুরে ওরা সবাই বসলে লাল শাড়ি পড়া মহিলা চকচকে স্টিলের গ্লাসে জল এনে দেন সবাইকে। এখানে খাওয়ার জল কোথা থেকে আসে সেই চিন্তায় শঙ্কিত শ্রাবণী যখন ওই জল না খেয়ে ওর ব্যাগে থাকা মিনারেল ওয়াটার বের করে খাবে কিনা ভাবছে, দেখে ঋতু ছেলেদুটি ঢকঢক করে গ্লাসের জলই খেয়ে নেয়। মেয়েটি এগিয়ে এসে শ্রাবণীর হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করে। ঋতু শ্রাবণীকে বলে মেয়েটির নাম সরিতা পোটে। ওদের সঙ্গেই ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ে। রীতিমত জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে পাস করে ভর্তি হয়েছিল। পাঁচ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে রোজ যেত কলেজে। হায়ার সেকেন্ডারিও করেছে অনেক দূরের একমাত্র স্কুল থেকে। আজ সেই সরিতারও জন্মদিন। তাই ওরা এসেছে ঋতু আর সরিতার জন্মদিন একসাথে পালন করবে বলে। কলেজে নাকি ওরা চারজন খুব বন্ধু।
শ্রাবণী চুপ করে বসে দেখে ঋতু ওর ঢাউস ব্যাগ থেকে বের করে একটা ছোটো সস্তার কেক। একটা নতুন রেডিমেড সালোয়ার কামিজএ বের করে রাখে। ছুরি জোগাড় করতে না পেরে ওর ভাই একটা খুন্তি নিয়ে আসে। তাই দিয়েই ঋতু সরিতা একসাথে কেকটা কাটে। শ্রাবণীর হঠাৎ বড় একা লাগে নিজেকে। মনে হয় এখানে ওর কোনোই ভূমিকা নেই।

শ্রাবণী  একা উঠে এসে দূরে কুলগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে ওদের। এই মেয়েটার সঙ্গে, শুধু এই মেয়েটার সঙ্গে জন্মদিন কাটাবে বলে ঋতু বাড়িতেই ফিরল না! ওয়াটার কিংডমে মা-এর সঙ্গে সময় না কাটিয়ে এই প্রত্যন্ত গ্রামে এসে সস্তার কেক কাটাতে আজ ওর বেশি আনন্দ! এতই বন্ধুপ্রীতি!   দেখছিল ছেলে মেয়েগুলো কী আনন্দে পরষ্পরের মুখে তুলে দিচ্ছে কেকের টুকরো। ছেলেদুটো কেকের ওপরের ক্রীম তুলে মাখিয়ে দিচ্ছে ঋতু সরিতার মুখে। ওরা উচ্ছল আনন্দে হাসাহাসি করে। মজা করে কোনো কথা বলে একে অপরের বাড়ানো হাতে তালি মারে। বাকি কেকটা ছোট ছোট টুকরো করে ঋতু ওদের ঘিরে ভিড় করে থাকা বাচ্চাগুলোর হাতে তুলে দেয়। অনাবিল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে হাড়-জিরজিরে শিশুগুলোর মুখ। সরিতার শ্যামলা সাধারণ মুখটাকে আনন্দ লজ্জার এক মিহি ছায়া যেন অপরূপ করে তুলেছে। ঘরের নিচু দরজাটা ধরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে সরিতার মাও। ওর মুখেও এক বিড়ম্বনার হাসি। শ্রাবণী বুঝতে পারে এভাবে জন্মদিন পালনে অভ্যস্ত নয় ' পরিবার
এরপর ঋতু নিজের পকেট থেকে শ্রাবণীর দেওয়া খামটা টেনে বের করে গৌরবের হাতে দেয়, ব্যাগ থেকে বের করে দেয় পাঁচটা দুহাজার টাকার গোলাপি নোট। সুনীল এবং গৌরবও ওদের নিজেদের পকেট থেকে বের করতে থাকে টাকা। শ্রাবণীর চোখের কোন দুটো জ্বলতে থাকে এক অনাস্বাদিতপূর্ব অনুভূতিতে।এক অচেনা অনুভূতিতে। এমনকি অচেনা লাগে নিজের মেয়েকেও। বুঝতে পারে ঋতু সত্যিই আর ছোট নেই, অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক। একা এগিয়ে যায় কলাগাছগুলো পেছনে ফেলে শুকনো ঘাস মাড়িয়ে ঘরের পেছনের অন্তহীন ধুসর প্রান্তরে। ঠাঠা রোদ মাথায় নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে বাজে পোড়া কোনো প্রাচীন গাছের মতো। আচমকা পেছন থেকে এসে দু'হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে ঋতু। 
-- কী গো মা, এই রোদে দাঁড়িয়ে ধু ধু খেত কী দেখছ? সত্যি, এখানে এলে বোঝা যায় কেন মহারাষ্ট্রের এই গ্রামগুলোতে জলের অভাবে গরীব চাষিগুলো টপাটপ মরে যায়। তাই না?
তারপর গলা নামিয়ে বলে, জানো তো, মাসে দেড়েক আগে সরিতার বাবাকে ইগতপুরি স্টেশন থেকে দূরে রেল লাইনের ওপরে দুটুকরো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল! সবাই বলছে ব্যাংকের ধার শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা। সরিতা সেকেন্ড ইয়ারের ফিস জোগাড় করতে পারবে না বলে পড়া ছেড়ে দেবে ঠিক করেছে। ওর ছোট ভাইটা এইটে পড়ে। সেও নাকি এখন পড়াশোনা বন্ধ করে বাবার সামান্য জমিতে চাষবাস করবে ভাবছে। আমরা ঠিক করেছি কিছুতেই সরিতার পড়া বন্ধ হতে দেবো না।ভালো করিনিদেখো না, ক্লাশের সবার থেকে সাহায্য নিয়ে, আমরা সবাই মিলে সাতচল্লিশ হাজার টাকা জড়ো করেছি। সেটাইতো আজ সরিতার মার হাতে দিলাম, জোর করে। সরিতা কিছুতেই নিতে দেবে না। ওয়াটার কিংডমে গিয়ে গ্যালন গ্যালন জলে দাপাদাপি করার চেয়ে এতেই অনেক বেশি আনন্দ হলো কি না বলোসবার  কপালে তো আর বাপীরা ছেড়ে গেলেও আমার মা' মতো এমন সোনা মা জোটে না, বলেই শ্রাবণীর গালটা টিপে দেয় আদর করে। যেন শ্রাবণী ছোটো একটা মেয়ে আর মা। যদিও ওর কানের কাছেই কথাগুলো ঋতু বলছে, কিন্তু তবু শ্রাবণীর মনে হচ্ছে যেন কতদূর থেকে ভেসে আসছে। নিজের চোখটা ঢাকতে কুর্তার গলায় ঝোলানো রোদ চশমাটা তাড়াতাড়ি পড়ে নেয়
-- মা, চলো। ছায়ায় চলো। তোমার তো সান স্ট্রোক হবে এবার, ঋতু বলে
শ্রাবণী বলতে পারে না, গতরাত থেকে জমতে থাকা মেঘ এতক্ষণে ঝরতে শুরু করেছে।ওর সান স্ট্রোক হবে কীওর উঠোনজুড়ে তো এখন শুধুই  অন্য এক প্রবল বর্ষণ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন