মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১৮

শুভ আঢ্য

শিল্পের বিপক্ষে... নান্দনিকতার চামড়া তোলা একটি পক্ষপাতদুষ্ট ফুটবল প্রতিবেদন /

আপনার সারনেম দে, বা মান্না নয়? গানটাও শোনেন নি? তা’ও নিজেকে বাঙালী বলে দাবি করেন? তাহলে আপনার আগামী ফুটবল বিশ্বকাপ দর্শনের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। আপনি ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান নিয়েও মাথা ঘামান না? আপনি জানেন নি চিমা ওকোরির ঘরে কোন দেওয়ালে যীশু ঝোলেন; আচ্ছা, আপনার নিষেধাজ্ঞার মাত্রা আরও কিছুটা বাড়িয়ে রাখা হল আগামী দু’টি বিশ্বকাপ। এখন প্লিজ এটা বলবেন না, আপনি ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করেন না, প্লিজ... আপনার যাবজ্জীবন হোক আমি চাই না। এত নেগেটিভিটি নিয়ে আপনি খেলা দেখতে বসেন যখন, নিশ্চয় আপনি ‘অ্যাই গরু, সর না’ প্রজাতির! সুতরাং আপনার ওপর যা কিছু ফুটবল ও ইতিহাস বোধ চাপিয়ে দেবার অধিকার আমার জন্মগত, বিশ্বাস না হয় সংবিধান দেখুন, ও পাতা না মিললে তা গরমিলের দায়েও যাবজ্জীবন আপনার বাঁধা, সুতরাং বুঝতেই পারছেন...
এবার ধীরে অতি ধীরে রক্ষণভাগ সামলাতে সামলাতে ডজ করতে করতে বিশ্বকাপের দিকে এগোনো যাক, উল্লেখ্য এই ২০১৮’র বিশ্বকাপের দিকেই এগোই, যিনি ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করার কথা ভাবেন না, তাঁকে নিয়ে আর খুব বেশী কদ্দূরই বা এগোব। আমাদের উদ্দেশ্য হবে খেলা’কে খেলার বাইরে রেখে দেশ ও তার পারিপার্শ্বিক ক্ষেত্রে আপনার নজর ঘুরিয়ে রাখা। আর যদি বা ইতিহাস প্রসঙ্গ এসে পড়ে তবে আগেই বলে রাখা হয়েছে, আপনাকে ব্রাজিলের পাঁচবার বিশ্বকাপ জয় ও আর্জেন্টিনার ১৯৮৬’র বাইরে কথা বলতে দেওয়া হবে না। এবার আপনি আমার নাম পালটে অ্যাডলফ্‌ রাখবেন না কি রিল্‌কে রাখবেন সেই গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু আপনার ওপর ছেড়েছি বলে আইদার মারাদোনার হ্যাণ্ড অফ গড ভেবে আমার হাতে বা মেসির বাঁ পা ভেবে আমার বাঁ পায়ে চুমু খেলে আপত্তি করবো না। ছেলে হলে সামান্য মুখ বেঁকিয়ে হলেও, খেতে দেবো। ওই চুমু আর কি।
দেখেছেন, গৌরচন্দ্রিকার সাইজ ক্রমশই বাড়ছে এবং ঢুকতে পারছি না বিশ্বকাপে, বারবার রক্ষণের সামনে বল চলে আসছে, তো আমরা হলাম গিয়ে বল প্লেয়ার, রক্ষণ সেরকম বুঝি না, আর রক্ষণ যারা বোঝে তাদের করুণার চোখের দেখি, এই যেমন ধরুন না, ইতালি এই বিশ্বকাপটা খেলতে পারল নি, কি দুঃখু, আমাদের তো প্রায় নাওয়া খাওয়া ছাড়ার জোগাড়। বলা বাহুল্য গৌরকে ডবল এক্সেল সাইজের জার্সিতে খেপ খেলতে যদি আপনি না’ই দেখে থাকেন, তাহলে আর করলেন কি! বাবলু দা’র কস্‌ম, পেলের কসমস আর গৌরের খেপ... সে খেলা দেখে এখনও বিছানায় বাইসাইকেল কিক করা যায়। চিন্তা নেই, আপনি পারবেন না, যার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা রোচে না, বাঙালী হয়ে কেন আছেন বলুন তো! একটু সময় সুযোগ করে বিষ্যুৎবার দেখে দেহ রাখবেন, কেমন? শুক্কুরবার ছুটি, আর শনি রবি তো রইলই। দীঘার বিচে খানিক খালি পায়ে ড্রিবল দেখিয়ে আসব!
খেলা দেখবেন? কেন? জগতে কত সমস্যা রয়েছে, ব্রাজিলের পার ক্যাপিটা ইনকাম কত কম, মাত্র ২৫ শতাংশ লোকের পকেটে অর্থনীতির ৮০ শতাংশ টাকা ঢুকে পড়ছে। গরিব, আরও গরিব হচ্ছে তো বড়লোকের ক্ষেত্রেও ভাইসভার্সা। আপনি জানেন? আর্জেন্টিনার কত জন মানুষ ইউনেস্কোর সমীক্ষা অনুযায়ী দারিদ্রসীমার নীচে? খবর রাখেন আপনি? এখানে বলতে আসবেন না খুন-জখম, ছিনতাইয়ের বিশ্ব অনুযায়ী রেট কি রকম, তাহলে আপনাকে মনে করিয়ে দেবো, ইংরেজ হুলিগ্যান মব মার্কা সমর্থকদের কথা... এবার কিছু বলবেন?! লাতিন আমেরিকান কবিতা, সাহিত্য কিছু পড়েছেন কোনোদিন? এর মধ্যে যদি মুখটি তুলে প্রশ্ন করেছেন কি এসব তথ্য নিয়ে বিগত চার বছর কথা হয়নি, তো, মরেছেন। নিজের গুহ্যদ্বার যথেষ্ট পরিমাণ বাঁশ মজুত রাখার উপযুক্ত হলে করুন না, সব কিছুতে নিষেধাজ্ঞা নেই, আমরা উদার। নাহ্‌, শুধু ফুটবল নিয়ে কথা বলা কেমন রুচিতে বাঁধছে। বাঙালী হয়ে ভার্সেটালিটি থাকবে না, মেনে নেওয়া যতটা চাপের ততটাই। আসুন আমরা ফুটবল বিশ্বকাপের সাথে কথা বলি জার্মানির নাৎসি নিয়ে, ইহুদী বিদ্বেষ নিয়ে। কথা আমরা বলি, আসুন না, সেই কবে কবে মারাদোনা বিশ্বকাপ জিতিয়েছিল সেই নিয়ে... আসুন না, আপনাকে, আপনার সমর্থনকে একটু হেয় করে দেখিয়ে আমরা পিচৎজার ওপর এক্সট্রা টপিংসের মতো নাল ফেলি। আসুন শিল্প নিয়ে সামান্য... এই চা খেতে খেতে... তো, বুইলেন কি না, ব্রাজিল হল শিল্পের আঁতুড়ঘর। কত শত জগদ্বিখ্যাত প্লেয়ার জন্ম দিয়েছে, যদিও তা খুঁজতে গেলে আপনাকে বেশ কিছু বছর পিছলে যেতে হবে পিছনে, তা না হয় যাবেন। তবু শিল্পের জন্য সামনে যাবেন না, খবরদার, এই ২০১৪’র পর খোঁজার কিছু চেষ্টা করবেন না। আপনার অনর্থক হয়রানি হোক, চাই না বলেই বলা।
কবিতার মতো মাঠের সবুজ গালিচায় যেভাবে বল নিয়ে যাবার কথা বলে রেডিও কমেন্ট্রি শুনতেন অজয়বাবুর ও বাবলু দা বলেছেন, তেমন শিল্প প্রসঙ্গে ঢোকা যাক। দেখুন, সামনে তিনজন প্লেয়ার, রোমারিও এগোচ্ছেন, তাঁর বল ড্রিবলের ভাঁজে দু’পাশ থেকে খড়ের মত ডিফেণ্ডারেরা পড়ে যাচ্ছে, আপনার বল জমি থেকে এক ইঞ্চিও উঠছে না, বল আপনার কথা শুনছে, যদিও মারাদোনার কথা আর সামান্য বেশী শোনে, এ দেখার মজা পাবেন কোথায় বাওয়া? এঁড়ে স্টুডেন্টের মতো, স্যরকে বিপদে ফেলার মতো প্রশ্ন করবেন না যে, সেটা পায়ে বেশীক্ষণ না রেখে হাওয়ায় ভাসিয়ে বড় পাশ খেলে দলের অপরজনকে দিয়ে দিলে কি ক্ষতি; বা গাঁতিয়ে ঢুকে পড়ে বিপক্ষের বুঝে ওঠার আগেই একটা গোলের চেষ্টায় ঝুড়ির ক’টা আম’ই বা পচে যায়? এসব প্রশ্ন অর্থহীন ও এই বয়সে নি-ডাউন বা মুরগী করে রাখলে কি ভালো দেখায়! এখানে হেজিমনির মদতো মাথায় ঢুকিয়ে রাখুন, শিল্প সর্বদাই গরিবের পক্ষে। শিল্প ততক্ষণই শিল্প, যতক্ষণ আধপেটা খেয়ে আপনি ছেঁড়া জামা নিয়ে বিপক্ষের ডি-বক্সে ঢুকছেন। শিল্প ততক্ষণই মহান, যতক্ষণ তা ইনফ্রাস্টাকচারের অভাবে আপনার গলার শিরা ফোলাবার জন্য উপযুকত বিষয়। যখনই উপযুক্ত সম্মান বা প্রাপ্য মর্যাদা পেলেন, ব্যস, শিল্প থেকে আপনি চ্যুত। পথের পাঁচালীর উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটিকে বোঝানো যায়, কিন্তু সব জায়গায় এক উদাহরণ দিতে ভালো লাগে না। তাহলে খেলায় শিল্পের প্রয়োজনীয়তা বোঝা গেল? ধরা যাক, বিশ্বকাপ জিতেই ফেলছেন, বারবার, বারংবার জিতেই চলেছেন, আপনি কমিটির টিমও হয়ে উঠেছেন, আপনাকে অ্যাম্বাসাডর করে কত পথ চলে গেল ফিফা, এসব ভাববেন না, ঐতিহ্য নিয়ে বলুন, বল আবিষ্কারের পর তা’তে পা দিয়ে ছেলেখেলা করার কথা বলুন, তবে ভুলেও ইউরোপে খেলে আমাদের ধনী হবার কথা বলবেন না, যেমন এ’ও বলবেন না ইউরোপের স্কিল ও খেলার স্ট্রাকচার নিয়ে আমাদের মনেও সামান্য ভালবাসা জন্মে তো গেছেই, এসব বলা ও মনে আনা আমাদের হারাম। মানে ফুটবলের প্রসারের জন্য এক বা দুই বিশ্বকাপে আপনাকে এমন গ্রুপে রাখা হচ্ছে যে গ্রপে থাকা মানে আপনার বিদেশ সফরের সময়কাল একটা সময় অব্দি নিশ্চিত! এবং আমরা ফিফাকে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে প্রভোক করছি বলা ঠিক না, তবে না নিলে ফুটবলের বিশ্বব্যাপী যে প্রসার আটকে যাবে, তা বুঝিয়ে দিচ্ছি ঠারেঠোরে... তো? সোচিয়ে মৎ। এ এক জন্মগত অধিকার, সাও পাওলো বা বুয়েনস আইরেসেতে জন্মানো মানে আপনি জীবনের বেশ কিছুটা সময় হয় ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে আপনার পায়ের যাদু দেখাবেন, নয়তো ওখান থেকে বিতাড়িত হলে এশিয়ার সর্ববৃহৎ বাজারে এসে গুটিকয়বছর কাটিয়ে বাবলু দা’র সাথে দেখা করে যাবেন। ও হ্যাঁ, যাবার সময় সম্মাননা-টনা আপনাকে দেওয়া হবেই, সাথে শাল ও অতি অবশ্যই আমাদের গোরা পিটিয়ে মাঠজয় করার রক্তিম অভিনন্দন। পাঁচবার জেতার পরেও যদি কেউ আপনাকে মানে আপনার দেশকে প্রতিষ্ঠান বলে থাকে, ও সেই প্রতিষ্ঠানের বিরোধীতা করে উঠতে চায় সটান বলে দেবেন, প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার কিছু ক্ষেত্র আছে, কিছু প্রি-আইডিয়া আছে, সেগুলো ছাড়া ব্যাপারটা ভেগ, দাঁড়ায় না। আর আপনি সাদা চামড়া, সামান্য ভালো খেতে পান, আপনার ক্লাবে গিয়ে আমায় ঘাম ঝরিয়ে ঘ্যাম বাড়াতে হয়, যার অর্থ, আপনি অর্থশালী, মানেই মাঠে ল্যাদাড়ু হবেন, এ এক অনস্বীকার্য স্বতঃসিদ্ধ। এ আলু সিদ্ধ হয়নি বলে গোল করবেন না, অযথা। একটা পস্ট কথা বলে রাখা ভালো, সবসময় মনে রাখবেন, আপনি গরিব হবেন না, দেখতে ভালো হবেন, ভালো করে ইংরাজীতে কথা বলতে পারবেন, আপনার দেশে ক্লাবে খেলার পরিকাঠামো ভালো হবে, রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড হবেন, আবেগ থাকবে না, মাঠে পড়ে যাবার পর রক্তাক্ত অবস্থায় উঠে আবার খেলবেন জাত্যাভিমানের কথা ভেবে ও একটার বদলে পাঁচটা ফাউল করবেন আর ভাববেন মিত্র ক্যাফের ফাউল কাটলেটের ভাগ পাবেন! বেড়ে তো!
বোঝার চেষ্টা করুন, যে বিশ্বকাপ খেলা টিভিতে দেখেন আপনি, তার রেজাল্ট ও রেজাল্টেন্ট ফ্যাক্টর বাঙালী সমাজ মনেপ্রাণে মানে না। অন্তত ফেস্ফবুক সমাজ তো নয়ই। পরাজিতের পক্ষে অনেক মানুষ থাকে, জয়ী উঁচুতে ওঠার পর একা। ধরুন না, এই ফাইনালের কথাই, ছোটো দেশ ক্রোয়েশিয়া উঠল, অসাধারণ ফুটবল খেলল, ফাইনালেও ভালই খেলল, তবে হেরে না গেলে মন কি পেত? কাপ নিয়েই পাড়ি জমাতে হত। অপরদিকে ফ্রান্স, একটা বুর্জোয়া দেশ, সেখানে একটা ঊনিশ বছরের ছেলে ভালো খেলেছে, মেনে নেওয়া কঠিন, তবু উদারতার নমুনাটা দেখুন, একবারও তো ডোপিং হয়েছিল বলে চিল্লাইনি! ের বেশী আর কি আশা করেন? জিদানের পর কাপ জিতল, বিশ সাল বাদ, তা’ও মোটে দু’বার। এখানে প্রেসিডেন্ট সংক্রান্ত ব্যাপারস্যাপার উহ্য রাখাই বাঞ্ছনীয়, কারণ না হলে কবিতাগুচ্ছের প্রসঙ্গ এসে পড়বে, দেবদাস, হাগ ডে’র মতো প্রায় বিপরীতধর্মী প্রসঙ্গ চলে আসলে ব্যাপারটাকে খেলা’র মধ্যে রাখা চাপের। জিজ্ঞাসা করে আর বিব্রত করবেন না ক্রোয়েশিয়াকে সেমসাইড করতে কে বলেছিল বা ভিডিও অ্যাসিটেন্সের পর যেহেতু রেফারিকে নিয়ে সেভাবে কথা বলা যাচ্ছে না, এবং প্রভূত বিশেষণ রেফারি সম্প্রদায়ের জন্য জমা করা আছে – জিজ্ঞাসা করলে সেগুলো আপনাকেই দিয়ে ফেলব! বমি আর আটকানো যায় কাঁহাতক। আপনাকে মানতেই হবে, সেখানে জি বাংলা বা রূপসী বাংলার মতো চ্যানেল নেই, ঘরে ঘরে সেখানে প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার জন্য প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা করা হয় না। বোঝার চেষ্টা করুন প্লিজ বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না বা সোপ অপেরা দেখা লোকজন যেটাকে খেলা বলে মনে নিয়েছে সেটাকেই আপনাকেও খেলা বলে মেনে নিতে হবে। মনে রাখুন চৌত্রিশ বছর ধরে ফিকে গোলাপীকে লাল বলে মেনে নেওয়া একটা দল বা জাতি হঠাৎ সত্যিকারের লাল দেখে চিনে ফেলবে বললে তো চলে না, তাকে সময় দিতে হবে, তাঁর কর্নিয়ায় সেই পরিমাণ লাল আলো পৌঁছাবে সে দেস্খে উঠবে লাল জন্মাচ্ছে, তীব্র কালোর মধ্যে থেকে, বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সেই লাল হলুদে রূপান্তরিত হয়ে যাবে, এটা হতে পারে না। আর আগের লাইনের রংগুলি হরাইজ্যন্টালি সাজালে যদি জার্মানির পতাকা হয়ে যায়, তো সেটা কোনোভাবেই হতে দেওয়া যায় না। আমাদের ইহুদী ভাইদের যারা সেই অকথ্য অত্যাচার করেছে, তারা মাঝমাঠ থেকে দূরপাল্লার শটে গোল করলেও লাইন্সম্যান নিশ্চয় অন্ধ নন, তিনি নিশ্চয় বাঁশিটি বাজিয়ে মনে করিয়ে দেবেন অফসাইডের কথা। আপনি এখানে একটা কাস্ট সিস্টেমের ভেতরে বসে খেলা দেখছেন, যেখানে আপনার গায়ে হলুদ জার্সি বা নীল সাদা জার্সি থাকা মানেই আপনি খেটে খাওয়া সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। বিশ্বের চূড়ান্ত অবমাননার জবাব আপনি দেবেন মাঠে। ধরুন বউ আপনাকে দেয় না, তো আপনি প্রুভ করার সুযোগ পাচ্ছেন না; বাসে বসার সিট পাচ্ছেন না, নৈতিকভাবে আপনার পাশে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন ওঁর সামনের যাত্রীটি উঠে যাওয়ায় ওটি তাঁরই প্রাপ্য অথচ আপনার কাপড়েচোপড়ে অবস্থা... আবেগটাকে লক্ষ্য করুন, আপনার দেশে খুন, জখম, ধর্ষণের কাহিনী থাকতে পারে; সমীক্ষায় আপনি সেসবে অনেক ওপরের দিকেও থাকতে পারেন, কিন্তু আপনি তো নিজেকে বাকি সব কিছু থেকে বিছিন্ন করে রেখে নিজেকে ফোর্থ বা ফিফথ ওয়ার্ল্ডের প্রতিনিধি বলে ভাবছেন। দেখুন, রক্ত কি সুন্দর গরম হয়ে গেল না? আপনার চা বোধহয় এতক্ষণে জুড়িয়ে গিয়েছে। তা যাক, ওরে, আর এক কাপ চা বল। মাঠে আপনার পারফরম্যান্স হল খেলা নয় ইতিহাস... আপনি না পারলে অন্য কেউ হলেও ইতিহাস নিয়ে আসুন। সিপাহী বিদ্রোহ, বাস্তিল দুর্গ, গ্যাস চেম্বার। আহা, ওই বেঁটে মালটা কি খারাপ লোকই না ছিল, ইহুদীগুলোকে জ্যান্ত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে......... মা গো! বাবলু দা গো! এরা মানুষ! এরা কি না ভাল খেলতে পারে! এখনও কি মনে হচ্ছে না ওই এক অণ্ডকোষের লোকটা আপনারই ফুটবলারকে হার্ড ট্যাকল করলো, আর ওদের কাছে পয়সা আছে, মানে রেফারি তো কেনাই থাকবে! এর পরেও ওদের সাপোর্ট করবেন? এর পরেও মাঠে ফরাসি পারফিউমের কথা ঠোঁটে আনতে পারবেন! ওরা জয়ের পর ওদেরই কোনো ফ্যানের ঠোঁটে চুমু খেতে নিজেকে কাউন্ট ড্রাকুলা বলে মনে হবে না? আপনার ভেতরে রক্ত আছে তো, নাকি পাতিত জল?
তো, সেবার ১৯৮৬ তে, নিখাদ ভগবান এসে সেবারে বিশ্বকাপ খেলেছিলেন মেনে নিয়েই বলি, তাঁর খারাপ আবার কিছু আছে না কি! কি আশ্চর্য যিনি একা হাতে কাপ জেতাতে পারেন, তিনি ডোপ বা অন্যান্য কেলেঙ্কারিতে... জড়ালেও তা শোনা পাপ। বরং আপনি ভাবুন মেসির ওপর প্রত্যাশার চাপ, আপনি তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করুন তিনি কোন দাতব্য সংস্থায় কত অর্থ সপ্তাহান্তে বা মাসান্তে বা বৎসরান্তে দান করেন, কেন আপনি একথা জানতে চাইবেন, তার বিনিময়ে তিনি কত ট্যাক্সের সুবিধা পাচ্ছেন? আপনি আই টির লোক হন, পাবে গিয়ে লাতিন আমেরিকার জার্সি পরে খেলা দেখুন, ইনকাম ট্যাক্সের লোক হলে... ও বাবলু দা... নজরে রাখুন উঠতি তারকার থুড়ি লেজেণ্ডের পায়ের অস্ত্রোপচারের সংখ্যা। আপনি ম্যাচের স্কোরবোর্ডের পাশে একটা এক্সেল শিটে এগুলো মেনটেন করছেন না? কেন? এগুলোর সাথে মানুষের দয়া মায়া বা কতটা তার পরিমাপ নেই? কেন যে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না, খেলাটা আবেগ দিয়ে হয়, মিস পাস দিয়ে থাকলে সেই বল বিপক্ষের পায়ে ফিরিয়ে দেওয়ার নিয়ম সম্বন্ধে অবহিত করার জন্য আপনার জন্য আরেকটা স্পেশাল ক্লাস রইতল। তার বদলে আপনি কি না ওই এক দল যারা বিয়ার খেয়ে যথেচ্ছ পয়সা ওড়ায়, তাদেরকে দেখছেন? হোক না রক্ষণ খারাপ, হোক না বিশ্বমানের গোলকিপার কোনো দেশ প্রোডিউস না’ই বা করল গত ১২ বছর, হোক না ব্যক্তিগতভাবে খেলার জন্য আর বল পজেশন বাড়ানোর জন্য, সময় নষ্টের জন্য, প্লে-অ্যাকটিঙের জন্য কিছু বলা হল, তবু ইকবার আঁখ পে পানি ভরকে তো দেখিয়ে জনাব...
ফ্লুকে ঘটে যাওয়া একটা বিশ্বকাপ নিয়ে এত মাতামাতি করবেন না। একটা আধা ইউরো কাপের এত গ্ল্যামার নেই। শুনুন, কবিতার ক্ষেত্র আলাদা, সেখানে আমরা অলংকার বর্জন করে, শব্দরীতি, ধ্বনিরীতি, পরীক্ষামূলক, ট্রিগার... এ সব শব্দ আওড়াই বটে। এমনকী শ্রুতিমধুর না হলেও পরোয়া করি না, উলটে অনেকসময় সওয়াল করি শিল্পের অর্থই কি শ্রুতিমাধুর্য? এ’ও জিজ্ঞাসা করি না কি পাঠককে, একজন কবি কি শুধুই নান্দনিক দিকই দেখাবে? করি, করা হয়... তবে এ ক্ষেত্র ভিন্ন। যতক্ষণ পায়ে বল থাকছে, বল প্লেয়ার আমার শিল্পীসত্ত্বা থাকছে, ততক্ষণই আমি শিল্পের পক্ষে, পক্ষান্তরে যখন আমার বল, আপনার পায়ে, এবং আপনি মাঝমাঠ ধরে ফেলেছেন, বল ভাসিয়ে হাওয়ার সাথে খেলছেন, আক্রমণে যাবার পর ডিফেন্সে নামার ঐতিহ্য হারিয়ে আপনাকে নকল করে .আমায়ও আন্মতে হচ্ছে, তখন সেটা মেনে নেওয়া যায় না। প্লিজ, আদর করে বলছি, ওটা বলবেন না। তখন আমরাও রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট বিশ্বভারতীর রাখার পক্ষেই। শ্রী দেবব্রত বিশ্বাস, শ্রী রামকিঙ্কর বেইজ এঁরা ভাল, ঠিক আছে, তবে কপিরাইটের ব্যাপারটা যেন ফস্‌কে অন্য কারো হাতে চলে না যায়। কবিতা আদতেই শ্রুতিমধুর বলে আমরা মানি। আর সহজ করে বুঝতে চাইলে একটা সহজপাঠ কিনে দেবো। কি বলেন, উডকাট প্রিন্ট, অবন ঠাকুরের কাজ... বহুদিন দেখিনা... শিল্প তাই’ই... পিকাসো নিজেকে বা ছবির সাবজেক্টকে নক্যারজনকভাবে দেখিয়েছেন যখন, এক্ষেত্রে তাঁর কাজের উদাহরণ থেকে সরে আসলাম। ভাবনাও কো সামঝো বস্...
চিত্রঋণ_ Andrey .Ermolenko

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন