মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১৮

জয়িতা ভট্টাচার্য


ক্ষিদে   
______      ____________
বাড়িটা মাঠের প্রান্তে। রাতে একটা ধ্বংসস্তুপের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ।দিনে যেন হানাবাড়ি ।এই বাড়িটাই জুটলো শেষে আমার  অর্থাত  অনিমেষের ভাগ্যে ।সরকারী সমী়ক্ষক হিসেবে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয় ।থাকতে হয় মাসখানেক ।কিন্তু এমন বিদ্ঘুটে বাড়ি তে এর আগে আশ্রয় জোটেনি ।জনবসতি বহূদূর।বাড়িটা আগাছায় ভরা ।বহূকাল বাস করেনি কেউ ।পলেস্তারা খসা ,দেয়ালে শ্যাওলা ।
দিনের বেলা ঘুরে দেখার সময় হয়না ।গ্রামে ঘুরি ,সার্ভে করি।দু তিনটে গ্রাম ।
বিকেলে অনেক সময় বাড়িটার পেছনে যাই ।ঝোপঝাড় ,রাংচিতা আর বিছুটির মাঝে ঝিঙে লতা আর .....পচা মরা ইঁদুর বেড়ালের হাড় গোড় ।
বিশ্রী গন্ধ লাগে ।চলে আসি ঘরে ।
কড়িবরগায় পেঁচা ,রাতে পায়রা ঘোঁট বেঁধে থাকে ।ঘরের মধ্যে রাত হলেই উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় চামচিকেরা ।সরকারী গ্রুপ ডি কোনো ক্রমে রুটি মাংস করে পলায়ন ।
জানলা রাত পুরে ফেলে ঘরে ।আমার জন্য একতলার  দুটি ঘর
  ঘর বরাদ্দ হয়েছে।দোতলয়া ধুলো ়ধুসারিত আরো অনেক়ঘর, বারান্দা ।
___" যাই বাবু, রাত হলো। "
টিকারাম রাতের ়খাবার ,জল আর হ্যাজাক  জ্বেলে দিয়ে চলে যায়।
বলা হয়না
" এখন সবে সাতটা,আরেকটু থাকো"পাছে নিজের অস্বস্তি ধরা পড়ে যায়।
অন্য তালাবন্ধ ঘরগুলো কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে  রাত হলেই ।
কাগজ পত্র আর কলকাতা থেকে আনা হুইস্কি  নিয়ে বসি ।নেটের আওয়াতার বাইরে এসে কেমন যেন খালি খালি লাগে ।
রাগী চাঁদ কটমট করে চেয়ে থাকে ।
ওরা কেমন আছে কে জানে .......দূরত্বে সম্পর্কও আবছা হয়ে যায়।
রাত বাড়লে গেট খুলে যায় ।ধারি কালো কুকুরটা ঢোকে ,নিঃশব্দে উঠে যায় দোতলার ়ঘরটায়। পুরোনো তক্তপোষের মর্ মর্ আওয়াজ পাই ।সন্ধ্যাবেলা একবার দেখেছিলাম ওখানে সিঁড়ির কাছে বিরাট মাংশপিণ্ড পরে আ়ছে ।হয়ত ়টিকারাম রেখে যায় ।
সিঁড়িতে আমার সেই পায়ের ছাপ পড়ে আছে ।এখানে আসার পর দু একবার দোতলায় গেছিলাম ।সেই চিহ্ন এখনো ।অথচ,
চারপেয়েটার কোনো পদচিহ্ন নেই ।
ওপরে বিরাট দরদালান গাড়ি বারান্দা ।ঝুলের মোটা আস্তরন। মেঝেতে ফাট ধরেছে ।নেমে আসি ।
তবে সব ঘরই ত দেখলাম তালাবন্ধ।

সেদিন পূর্নিমা ।
কাজ কর়ছি আর পান করছি ।ভাবছি বাড়ির কথা,মৃত পরিজন ,মৃত সম্পর্কের কথা................

____" কেমন আছেন অনিমেষবাবু," চমকে তাকাই ।
মিশকালো কুকুরটা, সাধারন কুকুরের থেকে কয়েকগুণ বড়ো ।সামনে বসা ।নেশা টা বেশিই হয়ে গেছে ভাবলাম ।
___"আসলে কুকুর জীবনে আসার পর বিশেষ মানুষের সা়থে বাত্ চিত্ হয়ে ওঠেনা ,তাই ভাবলুম দুটো কতা বলি "।
না এবার আর কোনো ভুল নেই ।পরিস্কার বাংলা ভাষায় কথা বল়ছে ।চক্চক্ করছে ওর দেহ ।সামলে নিতে সময় লাগে ।এই পোড়া বাড়িতে একা বসে ,কয়েক ঢোক পান করে নি মনের জোড় বাড়াতে ।কাঁপা গলায় বলি
___" বলুন ।আপনার নামটা জানা হয়নি "
___" আমার নাম উমাপদ ভাণ্ডারী ।বাড়িটা আমারই ।কেয়ারি করা বাগান ।ঝক্ ঝক্ করত দরদালান ।ব্যবসাদার ছিলাম কিনা "
__"ও " আমি কলকাতার ছেলে স্মার্ট হবার চেষ্টা করি ।হুইস্কির এফেক্ট বোঝাই যাচ্ছে তারপর শূণ্য বাড়ি ,রাত।
আমি একবার চিন্তা করে নি উমাপদবাবুকে হুইস্কি অফার করব কিনা ।
___" আপনি খান অনিমেষবাবু,আমি  অন্য পানিয় খাই ।"
চমক। এ কি থটরিডিং জানে নাকি !
____"দুটি ছেলে বউ, ভরা সংসার ছিলো মশায়"
উমাপদ কিঞ্চিত উদাস। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা
"আপনি কুকুর হলেন কী করে " আপনা থেকেই প্রশ্ন আসে ।বলে ফেলে ভয় পাই। মানুষকে কুকুর বা কুকুরকে কুকুর.......বলা কি উচিত হলো !

কালো কুকুরটা যুত করে বসে। চোখ দুটো সবুজ আলো ঠিক্ রোয়।মাথা নীচু করে থাকে।প্রমাদ গুণি আমি।
"বলছি ভায়া। কেউ ত শোনে না। আসে না ।এলেও........
এর পর স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকি উমাপদর কাহিনী।
"সেসব অনেকদিন আগের কথা। আমার এ বাড়িটা সাহেব আমলে ঠাকুর্দা তৈরী করেছিলেন। আমি ব্যবসা করতুম আমদানি রফতানির ।এ গ্রামে আমিই সবচেয়ে ধনী প্রায় জমিদার ছিলাম।এমন নিঝুম ছিলোনা চারপাশ।
একবার ব্যবসার কাজে দিল্লী গেলাম দুদিনের জন্য । ফিরতে ফিরতে মাঝরাত
রাত হলো।ঢুকতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা । দেখি বাড়ি শুনশান ।এখান ওখান রক্ত। কাপড়ের টুকড়ো ।টাকা পয়সা গয়না গাটি কিছু নেই ।দেহ গুলো পড়ে ।বউ।আরো সবার ।
ওপরের ঘরে আমার মেয়ের পচা লাশটা খাচ্ছে কালো একটা কুকুর ।
জানেন, ওদের মাটি চাপা দিলাম।
তারপর আর ঘর থেকে বেরোতাম না।
শুধু একটু খাবার কিনে আনতাম রাতের দিকে লোকের চোখ এড়িয়ে।
"পুলিশে জানান নি কেন?"আমি জানতে চাই।
" পাশের গাছটায় শকুনের বাস।হাড় গোড় ছাড়া আর কিছু নেই ।ওই পেয়ারা গাছের নীচে বাক্সে ৫০ লক্ষ আর গয়না লুকোনো আছে ।পুলিশ এলে নিয়ে নিত।যাই হোক ,
মাংস কিনে আনতাম সামান্য খাবার........
কুকুরটা রয়ে গেলো ।আমি আর সে ।শেষে আর মানুষের কাছে যেতে ইচ্ছে করতনা ।ওর সাথেই কথা বলতাম ।ফল পাতা খেতাম আর ইদুর বেড়াল ধরে কুকুরটাকে দিতাম ।
"পেয়ারা গাছের নীচে......" আমার মন দ্রুত কাজ করছে। উমাপতি জানলার দিকে তাকিয়ে........  বাইরে খস খস পাতা পড়ে
" দুজনে অনেক বছর কেটে গেলো ।ওর সাথে থাকতে থাকতে আমাকেও ওর মতোই যেন দেখতে হয়ে যাচ্ছিলো জানেন।এরকম হয়। ফ্রয়েড বলেছেন স্বামী স্ত্রী দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে মিল হয়ে দেখতেও।ওই ওরকমই ছিলুম ত আমরা !
ফল পাতা ছেড়ে আমি়ও কাঁচা মাংস খেতে লাগলাম একসময় ।ঝামেলা নেই ।বেশ খেতে বু়ইলেন ।"
আমি কী বলব ভেবে পাইনা ।শরীর যেন বরফ। হুইস্কির বোতল প্রায় শেষ।
"খেলে একটু বেশি মাংসই ত লাগে দুজনের। তাইনা।
একদিন বুড়ো হয়ে মরেই গেল ব্যাটা।
নষ্ট না করে ওটাকেই কদিন খেলাম বুইলেন "
"আমি একদম ক্ষিদে সহ্য করতে পারিনা জানেন, এই এক দোষ আমার"
একটু অস্বস্তি হচ্ছে এবার ।
তারপর ়থেকে রোজ খুঁজে বেড়াই মাংস।
বাইরেটা হঠাত্ অন্ধকার। কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে চাঁদ ।হাওয়ায় লম্ফটা জ্বলছে নিবছে । দূরে বিদ্যুত চমকালো কি?
ভ়য় করছে যেন এবার।
ক্ষিদে পাচ্ছে.........
উমাপদ বলে চলেছে
__" আজ আর কাউকে পেলামনা ।ক্ষিদে পাচ্ছে খুব ।যদি কিছু মনে না করেন................বেশি লাগবেনা কিন্তু......"
অনিমেষ জ্ঞান হারায় ।কিন্তু তার আগে ভারি বোতলটা ভে়ঙে ঢুকিয়ে দেয় উমাপদর পেটে ।
সকালে চোখ খুলে ধরমর করে উঠে বসে অনিমেষ। বেরোতে হবে ।আয়নায়   চোখ পড়ে ।স্তব্ধ হয় অনিমেষ নিজেকে দেখে।

বড়ো কালো একটা কুকুর এখনো ঢোকে গেট খুলে ।মরা কুকুরটাও খেয়ে নিয়েছে সে । ক্ষিদে পায় আজকাল খুব। টিকারামের দেহ টা বেশ কিছুদিন খাওয়া গেছে।সুস্বাদু নর মাংস ।
অনিমেষ ভালো়ই আছে ।
তবে তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।
এখন অনিমেষ আর পুরোনো বাড়িটা প্রতিক্ষা করে নতুন আগন্তুকের
                  ____________




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন