মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১৮

মানসী গাঙ্গুলী

অসমাপ্ত

     বিয়ের সাতমাস পার হয়েছে সবে।গতমাসে চন্দ্রা পিরিয়ড মিস করেছে।কিছুদিন অপেক্ষা করার পর,রাজ আজকে তার ইউরিন নিয়ে ল্যাবে গেল প্রেগন্যান্সি টেস্ট করানোর জন্য।বেশি দূরে নয়,আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসার কথা,স্কুটার নিয়েই তো গেছে,কিন্তু এত দেরী হচ্ছে দেখে চন্দ্রার খুব চিন্তা হচ্ছে।
       শ্বশুরবাড়ী কলকাতা হলেও রাজের কর্মস্থল দূর্গাপুরেই তারা থাকে।বেলা ১২ টা বেজে গেলেও ফিরছে না দেখে চন্দ্রা ফোন করে কিন্তু রিং হয়ে গেল,চন্দ্রার মনটা অস্থির লাগতে শুরু করে।কিছু পরে আবারও ফোন করে,এবারও রিং হয়ে গেলে,মনটা চন্দ্রার কু গাইতে শুরু করে। ছটফট করে এঘর ওঘর করছে ও, কাজকর্ম সব সারা হয়ে গেছে,এমন সময় স্কুটারের চেনা আওয়াজ কানে এল ওর।রাজ বাড়ী ফিরল যখন বেলা তখন ১ টা বাজে।রাজকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ী ফিরতে দেখে চন্দ্রা তো তখন রেগেই আগুন,তাকে এভাবে টেনশনে রাখার জন্য,একটা ফোন  করে না জানানোর জন্য বা তার ফোন না ধরার জন্য।রাজের কোনো কথাই তখন সে শুনতে চায় না।রাজ অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করে,তারপর সব বলে।
      ল্যাবে ইউরিন জমা দিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ এক ভদ্রলোক তার স্কুটারের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হতে যান আর রাজের স্কুটারের ধাক্কায় তিনি পড়ে যান,সামলাতে না পেরে রাজও পড়ে যায় রাস্তায়।রাস্তার আশপাশের লোকজন হৈ হৈ করে ছুটে আসে যদিও ওদের দুজনেরই তেমন একটা লাগেনি,তবে ভদ্রলোকের দু'এক জায়গায় ছড়ে যায়।রাজ খুবই ভদ্র ছেলে,সে নিজেই ভদ্রলোককে নিয়ে যেতে চায় হসপিটালে,প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য।যাঁরা ভিড় করেছিলেন, তাঁদেরও তাই মত,তাই রাজ তাঁকে নিয়ে হসপিটালে গেলে এমার্জেন্সীতে ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা করেন,ছড়ে যাওয়া জায়গা আয়োডিন দিয়ে পরিষ্কার করে,ইঞ্জেকশন দিয়ে প্রেসক্রিপশন করে ছেড়ে দেন।রাজ তাঁকে সঙ্গে করে ওষুধ কিনে তাঁর বাড়ীতে ছেড়ে দিতে যায়,এটা তার নৈতিক কর্তব্য বলে সে মনে করে।তাই সেখানে পৌঁছে দিলে,তাঁর বাড়ীর লোকজন রাজের কাছে সব জানতে চান।তাঁদের সমস্ত ঘটনা বলে,প্রেসক্রিপশন ওষুধ সব বুঝিয়ে তবে রাজ বাড়ী ফিরতে পারল এখন আর তাই ফোন করার বা ফোন ধরার অবকাশটুকু সে পায়নি।
        চন্দ্রা বড় বড় চোখ করে সব শুনল,এবার সে শান্ত হল,বলল,"যাও তাড়াতাড়ি স্নান সেরে এসো,খাবার রেডি করি"।রাজ তাকে অনুরোধ করে খেয়ে নেবার জন্য,এখন তার রাজের জন্য বসে থেকে দেরী করা ঠিক নয়,যে আসছে তার জন্য অন্ততঃ। চন্দ্রা শুনতে চায় না,আগে রিপোর্ট আসুক।রাজ বাথরুমে গেলে চন্দ্রা রান্নাঘরে যায় খাবার রেডি করতে আর দড়াম করে আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে সে।ছুটে যায় বাথরুমের কাছে,দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।দরজা ধাক্কায় চন্দ্রা, রাজের নাম ধরে ডাকে,কোনো সাড়াশব্দ নেই।চন্দ্রা চিৎকার করে ওঠে,কত জোরে সে নিজেও জানে না,পাশের কোয়ার্টারের লোক ছুটে আসে,চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়।শেষে বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে রাজকে বার করতে হয়।তার মুখ দিয়ে তখন গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে।সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়।এমার্জেন্সীতে সেই ডাক্তার তখনও ডিউটিতে ছিলেন।তিনি রাজকে দেখে চিনতে পারেন আর বলেন,"উনি তো কিছু আগেই অন্য একজনের চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে গেলেন,ওনার কিছু হয়েছে তো বলেন নি"।ডাক্তারের খুব খারাপ লাগল ব্যাপারটা,কিন্তু ওনার চিকিৎসা শুরু করার আগেই রাজ চোখ বুজল।
       স্কুটার থেকে পড়ে গিয়ে রাজের ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়ে গিয়েছিল।ভেতরে ভেতরে অতসময় ধরে রক্তক্ষরণ  হয়েছে আর তাই তার পিঠে চামড়ার নীচে চারিদিকে লাল টকটকে ছোপ ছোপ হয়ে আছে,গায়ের রঙটা ফর্সা বলে আরো বোঝা যাচ্ছে।যারা নিয়ে গিয়েছিল হসপিটালে,ডাক্তার তাদের দেখালেন, নিজেও খুব আপশোস করতে লাগলেন চিকিৎসার সুযোগ পেলেন না বলে।
       সবাই হতবাক,ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না,স্তম্ভিত, শোকাহত রাজের এই অসমাপ্ত জীবনের সমাপ্তিতে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন