খোসা
- ডিম সেদ্ধ করতে খরচ কম। কিন্তু, সময়টা বেশি যাবে।
- ধুর! এইভাবে হিসেব করে নাকি। ডিম ভাজবি একসাথে ক'টা? বড় জোর ডবল মামলেট। কিংবা ডিম পাউরুটি টোস্ট, সেও বেশি হ'লে একসাথে দু'টো ডিমের বেশি নয়। কিন্তু সেদ্ধ করলে, বড় ডেকচিতে একসাথে অনেকগুলো সেদ্ধ হয়ে যাবে।
ডিম, ডেকচি, স্টোভ, কেরোসিন তেল, নুন, জলের ব্যবস্থা, বসার ব্যবস্থা... সব নিয়ে একটা হিসেব করে শুরু করার মত পুঁজি কত হ'তে পারে বুঝে নিলো প্রকাশ। সমান সমান হিসেবে তেল, পেঁয়াজ, পাউরুটি যোগ করলে খরচ অনেকটাই বেশি হয়ে যাচ্ছে। আপাতত সেদ্ধ ডিমেই খুশি হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। লাভের মুখ দেখলে তখন ধাপে ধাপে অন্য ব্যবস্থা... এক এক করে। কিন্তু একটা জিনিস কেমন খচখচ করছে... প্রশ্নটা নিরাপদদাকে করাই হ'ল না। এমন ভাবে হিসেব বোঝালো, যেন প্রচুর লাভ। তখন মনেও এলো না। এখন মনে হচ্ছে।
--- --- ---
অরুণার ওপর থেকে নেমে, চিৎ হয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার পর হঠাৎই বলে ফেলল প্রকাশ "আচ্ছা, লোকজন সেদ্ধ ডিম খেতে বেশি ভালবাসে? না মামলেট?"
এইসময় এমন প্রশ্নর মানে বুঝতে পারল না অরুণা। বুকের ওপর আঁচলটা টেনে প্রকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল "কি?!"
প্রকাশ আগের মতই চিৎ হয়ে শুয়ে বুকের কাছে রাখা ডান হাতটায় কড় গুণতে গুণতে বলল "বুঝতে পারছি না। লোকে বিকেলে বা সকালে ডিম সেদ্ধ খায়। কিন্তু আমার থেকেই বা কেন খাবে? মামলেট, টোস্ট এগুলো তো বেশি খায়... তাই না? আমার তো সেদ্ধ ডিমের থেকে এইগুলোই বেশি ভাল লাগে!" অরুণা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল, অন্ধকারেও ওর চোখের বিরক্তিটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। এক ঝটকায় প্রকাশের বাঁ হাতটা সরিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে বলল "সময় অসময় বলে কিছু নেই... রাতে শোয়ার পরেও.. ছিঃ... স্বার্থঃপর একটা!"
প্রকাশ কী বলবে বুঝতে পারলো না। কিছু বলার চেষ্টাও করল না। মশারীর বাইরে হাত বাড়িয়ে জলের বোতল থেকে দু' ঢোক জল খেলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে। বিড়বিড় করে শুধু বলল "খুব ভুল হয়ে গেল... কাল আবার নিরাপদদাকে ধরতে হবে বাজারে গিয়ে।" অরুণা নিজের পা দু'টোও টেনে সরিয়ে নিলো, যাতে কোনও ভাবেই প্রকাশের ছোঁয়া না লাগে।
--- --- ---
"কেউ সেদ্ধ খায়, কেউ ভাজা... আবার সেদ্ধ আর ভাজাও আলাদা রকমের হয়। কীসব নাম আছে। দেখেছি। সবার ব্যবস্থা হ'লে লোক বেশি জুটবে।"
সকাল থেকে এই প্রথম কথা বলল অরুণা। এতক্ষণ শুধু ঠুকঠাক জিনিসপত্র রাখা আর বাসনের শব্দ হচ্ছিল। কথাগুলো খুব একটা অন্যায্য বলেনি, কিন্তু প্রকাশের টাকার হিসেব করতে গেলেই টানাটানি পড়ে যাচ্ছে। অরুণার কথাগুলো শুনে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল "আমিও তো এই ভেবেই আর এগোতে পারছি না। শুধু সেদ্ধ থেকে কি আর লাভ আসবে?"
রান্নাঘর থেকে উঠে এসে অরুণা জিজ্ঞেস করল - সেদ্ধ ডিমে খরচ কম?
- সেরকমই তো বলল নিরাপদদা।
- কী বলল?
- ওই ডিমের দাম, ডেকচি, স্টোভ, কেরোসিন... সব মিলে।
- দিনে ক'টা করে ডিম বেচবে?
- ক'টা বিক্রী হবে তা কি আর জানি? ওই দু' ডজন দিয়ে শুরু করব। তারপর তার থেকে যেমন বিক্রী হয়।
- নিরাপদদা'র নিজের দোকানটা যেন কিসের?
- ও চায়ের দোকান...
- শুধু চা?
- না না... চা বিস্কুট, সিগারেট, পাউরুটি টোস্ট, পান মশলা...
- আচ্ছাআআআআ... এবার বোঝা গেল।
- অ্যাঁ?
- না... তুমি দু'ডজনের বদলে যদি দেড় ডজন নিয়ে যাও প্রথম দিন। আর ঘরের থেকেই ছোট কড়াটা, এক শিশি সরষের তেল, দুটো পেঁয়াজ আর ক'টা লঙ্কা... তাহ'লেও কি খুব বেশি খরচ হবে?
- না তো।
- তাহ'লে প্রথম দু-তিনদিন অল্প করে দেখো না। তারপর সেই মত না হয়...
বিকেল হওয়ার আগেই বাজারের দিকে সাইকেল নিয়ে চলে গেলো প্রকাশ। নিরাপদদা ব্যস্ত হওয়ার আগেই একবার ধরতে হবে। অরুণার কথা মত সব কাগজে লিখে নিয়েছে। এদিক-ওদিক মেরে কেটে সেদ্ধ, মামলেট দুটো দিয়েই শুরু কর যায়। খুব একটা হেরফের হচ্ছে না।
--- --- ---
"আসল কথাটাই নিরাপদদা সেদিন বলেনি... এইসব করতে ডেলি যা খরচ তা তো আছেই... এ ছাড়া ওই জায়গাটা পাওয়ার জন্য পার্টিকে কিছু অ্যাডভান্সও দিতে হবে... তারপর মাসে মাসে..."
সাইকেলটা এক কোণে দাঁড় করিয়ে রাখতে রাখতেই কথাগুলো জানিয়ে দিলো প্রকাশ... হাঁফাচ্ছিল, তাই সময় লাগল পুরোটে বলতে। অরুণা এই প্রসঙ্গে কোনও উত্তর দিলো না। নুন-চিনি মেশানো এক গ্লাস জল প্রকাশের দিকে এগিয়ে দিয়ে শুধু বলল "বসো... চা খাও। শুনছি এক এক করে। বাসনগুলো মেজে নিই।" ঢকঢক করে সবটা জল খেয়ে জামার বোতামগুলো খুলে ফেলল ফেলল প্রকাশ। তারপর সেই জামা দিয়েই গায়ের ঘাম মুছে সেটা দিয়ে হাতপাখার মত নিজেকে হাওয়া করতে শুরু করল। অরুণার কাছ থেকে কোনও সাড়া না পেলেও নিজের মনেই এক এক করে বলে যেতে লাগল, চায়ের দোকানের নিরাপদর সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে। যদিও তার থেকে কোনও নতুন অথবা বাড়তি তথ্য এলো না। তবে নিরুপায় মানুষের এতেই সান্ত্বনা, এক কথা বাড় বাড় বললেও মনে হয় কিছু কাজ এগোচ্ছে। কথা চলছে।
অরুণা জানে, প্রকাশ অল্পেতেই ঘাবড়ে যায়, দুশ্চিন্তা করে... বেশি চাপ পড়লে দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। ইংরিজীতে যাকে বলে 'নার্ভাস'। শব্দটা জানা না থাকলেও, ধাতটা অরুণার চেনা। তাই ইচ্ছে করেই প্রকাশের এতগুলো কথার কোনও উত্তর দিলো না। ঘরের সব কাজ সেরে দরজার কাছে এসে শান্ত ভাবে বলল "বাইরে মশা কামড়াবে, ভর-সন্ধেবেলা চৌকাঠে বসলে দেনা হয়।"; তারপর ঘরের ভেতর ঢুকে গেল বিছানার চাদর ঝাড়তে।
- নিরাপদদাও টাকা দেয়?
- পার্টিকে?
- হুম?
- বলল তো সবাই দেয়। দোকান থাকলে নাকি দিতেই হয়...
- তোমাকে ক'ত দিতে বলেছে?
- পাঁচ হাজার কম করে।
- তারপর?
- তারপর কি? মাসে মাসে?
- হুম?
- সে সব অতটা বলতে পারল না নিরাপদদা। বলল ওদের সঙ্গে কথা বলে সব আগে সেট করে নিতে হয়। না হ'লে পরে ঝামেলা হবে।
- কার সঙ্গে কথা বলবে? তুমি তো চেনোই না কাউকে!
- নিরাপদদা চেনে। বলেছে কথা বলিয়ে দেবে।
- বাবা, নিরাপদদার যে তোমার থেকেও বেশি গরজ!
প্রকাশ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে অরুণার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ভাতে খানিকটা ডালের জল ঢেলে খেতে শুরু করল। নিরাপদ'র বাড়তি আগ্রহটা প্রকাশও বোঝে। এসব সহজেই বোঝা যায়।
- হাজার পাঁচেক টাকা, তোমার কাছে হবে?
- দেখি।
- কোথা থেকে দেখবে! ব্যাংকে তো ঐ ক'টা টাকা। ছেলে-পুলে এখনও কিছু নেই। কিন্তু ঘটির জল তো ওইটুকুই আছে। যদি ভালো-মন্দ কিছু...
- তাহ'লে আর কী করতে পারি বলো?!
- হাতেরটা, গলারটা বেচে দাও... তাও আর বলতে পারছি না। আর টাকাগুলো নিয়েও যে সব মিটে যাবে... ওদের কথার দাম আছে? জানো না তুমি? মনে নেই?
- বাজারের দিকে নাকি এমনই রেট। অন্য দিকে কম। কিন্তু সেখানে কি খদ্দের পাবো?
"শুরু করার আগেই পাঁচ হাজার। তারপর প্রতি মাসে নিয়ম করে... সময় মত। লাভের হিসেব যা করেছিল, তা আর থাকবে কী করে? ব্যবসা শুরু করার আগেই লসের খাতায় চলে যাবে। ওদের আর কি! ভালই কাটছে হারামখোরগুলোর এই করে! নাহ্... বাজারের দিকে বসা যাবে না। শ্মশানে যাওয়ার পথে নিমতলার মোড়, কিংবা স্টেশনের দিকে কলোনির রাস্তাটার কেমন রেট জিজ্ঞেস করতে হবে। যদি কিছু কমসম হয়..."
রাতের দিকে ভ্যাপসা গরম, তাই না ঘুমিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে এইসব সাত-পাঁচ চিন্তা করে যাচ্ছে প্রকাশ। দু'জনেই দু'জনের দিকে পিঠ করে শুয়ে। অরুণারও ঘুম আসছে না। হাতের ওপর মাথাটা রেখে ঘুমনোর চেষ্টা করছে চোখ বন্ধ করে। চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে সরু শাঁখাটা। ভাগ্যিস... এখনও ওদের কোনও ছেলে-মেয়ে হয়নি।
--- --- ---
কাজ শুরু করতে গিয়ে খাতায় কলমে বসে দেখা গেল যা হিসেব করেছিল তার থেকে অনেকটাই বেশি খরচ। গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ হাজার টাকার অগ্রীম আর মাসিক হিসসার বাইরেও একটা ব্যাপার আছে - মাঝে মাঝে স্থানীয় থানা থেকে কেউ কেউ আসতে পারে। এটা বলে দেওয়া হয় না। ধরে নিতে হয়। পার্টির সঙ্গে বোঝাপড়া ভাল থাকলে, চাপ কম থাকে। কিন্তু এইসব যেমন গোড়ায় বলতে ভুলে গেছিল নিরাপদ, সেরকম এটাও বলতে ভুলে গেছিল যে একটা গুমটির দরকার হয়। দুটো সাইকেলের চাকা লাগানো গুমটি। যেটা নিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এখানে সেখানে যাওয়া যায়, সেখানেই সরঞ্জাম রেখে ব্যবসা। সাময়িক এবং গমনশীল। তারপর -
ডিমের খোসা (বিকল্প উপসংহার ১)
সব দিক ভেবে প্রকাশের শেষমেশ বাজারের আশা ত্যাগ করে শ্মশানের দিকের নিমতলা মোড়েই যেতে হ'ল। তাও মোড়ের মাথা নয়, সেখান থেকে একটু দূরে। অগ্রীমটা অনেক কমে গেল, কারণ শ্মশানে আসতে যেতে কেউ ডিম সেদ্ধ খায় না। হিসসা তখনই চাইবে, যদি কাস্টমার বেশি হয়। চাকা লাগানো গুমটিটা একজনের থেকে বাধ্য হয়ে কিনতে হ'ল। পার্টির চাপে।
ডিম এমনিতেই অযাত্রা। তায় আবার সেদ্ধ। অরুণা বলল এক ডজনের বেশি রেখে লাভ নেই। চায়ের কেটলি আর প্লাস্টিকের কাপে একটু খরচ করল। আর কাজ চালানোর মত সিগারেট, বিস্কুট। সকালের দিকে প্রকাশ বসে, দুপুরের দিকে অরুণা, আবার সন্ধের পর প্রকাশ। একটু বেশি রাত অবধি থাকে, শ্মশান থেকে রাতে যারা ফেরে, মাঝে পাঁচ-ছজন দাঁড়িয়ে যায়। অরুণা রাতে থাকতে দিতে চায় না। নাহ'লে দিনে না বসে সারা রাত দোকান দিলেই ভাল হ'ত। দুপুর থেকে ভোর অবধি।
যদিও একমাস হয়নি, তবে লাভ সামান্যই। আর এর থেকে বিশেষ বাড়ারও কথা নয়। মাঝে মাঝে এক আধ দিন দশ টাকাও লাভ হয় না। মাস গেলে কতই বা জমবে হাতে? এর ভরসায় বেশিদিন চলবে না। অন্য কিছু ভাবতে হবে। দু-তিন রকম ব্যবস্থা করতে হবে সংসার টানতে গেলে। অথচ পার্টির ছেলেগুলোকে বোঝানো মুশকিল। মাসের শেষ সপ্তাহ হ'তেই ওরা আসা যাওয়া শুরু করেছে। সত্যি হিসেব দেখালেও কি অমনি অমনি ছেড়ে দেবে?
পেঁয়াজের খোসা (বিকল্প উপসংহার ২)
পাঁচ হাজার টাকা চাইলেই ওভাবে দিয়ে দেওয়া যায় না। তার ওপর মাসে মাসে, তার ওপর আবার থানা। নিরাপদদা এই ব্যাপারে সরাসরি কিছুই করতে পারল না, শুধু গোবিন্দ হাঁসদা বলে একটা লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো। তাকে একশো টাকা দিতে, সে নিয়ে গেল পার্টির ছেলেদের কাছে। পার্টি অফিস না, ক্লাব ঘর। ক্যারাম খেলতে খেলতে কথা বলল দু'টো ছেলে। নতুন কথা, পুরনো কথা... অনেক কিছু শোনার পরেও চুপচাপ রইল। পাত্তা দিলো না খুব একটা। সত্যি তো... প্রকাশ ওখান দোকান দিক বা না দিক, তাতে ওদের কী? প্রকাশের লাভ না হলেই বা ওদের কী? দোকান দিলে কিছু তো দিতেই হবে! বাজার একটা প্রাইম লোকেশন। প্রকাশ না বসলে ওই জায়গায় অন্য কেউ বসবে। এরা কেন লস খাবে? তাও প্রকাশ কিছুক্ষণ হাতকচলে গেলো। এক মিনিট করে চুপ করছিল, তারপর আবার নতুন করে বলছিল। জমিদার বা নায়েব-গোমস্তাদের কাছে যেমন চাষা-ভুষোরা হাত কচলে খাজনা মকুব করতে বলত। যেমন 'নার্ভাস' হ'লে প্রকাশ করে। শেষে একটা ছেলে বিরক্ত হয়েই বলল - "ঠিক আছে, আগে দু'হাজার দে... বাকিটা মাসে মাসে ভেবে দেখব।" এই ভেবে দেখার ব্যাপারটা প্রকাশ বুঝতে পারল না। গোবিন্দ হাঁসদা তাকে বুঝিয়ে দিলো - পাঁচ কমে দুই হয়েছে। বিশাল ব্যাপার। মাসে মাসে একটু বেশি দিয়ে বাকিটা পুষিয়ে দিতে হবে... ধারের সুদ দেওয়ার মত।
বাজারে ব্যবসা করতে গেলে এতে রাজী না হয়ে উপায় নেই। ব্যাঙ্ক থেকে ঐ দু'হাজার তুলে দিয়ে দিলো প্রকাশ। কিন্তু এসবের কি আর সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকে? সবই ভরসা করা। জনদরদী দলের দুঃখী-দরদী ছেলেরা কথা দিয়েছে। এই অনেক। তবে গোবিন্দ ছেলেটা চালাক, এইসব রফার কথা পাঁচকান করতে বারণ করল। অরুণা বলল - "নিরাপদকেও বলো না। দরকার নেই!"
আপাতত অরুণার কথা মত সেদ্ধ আর ভাজা দু'টোই রেখেছে। তার সঙ্গে পাউরুটিও পাঁচ-ছটা। কেউ টোস্ট চাইলেও দেয়। বাজারে এমন দোকান আরও আছে। একচেটিয়া ব্যবসার ব্যাপার নেই। আর নিরাপদদাকে চটানো যাবে না... তাই এর বেশি কিছু করার কথাও ভাবা যাচ্ছে না আপাতত। গোবিন্দ বলেছে, দু-তিন মাস আগে টিকে থাকো... টিকে থাকাই আসল। রয়ে সয়ে খেলে সব হয়। আঁকুপাকু করলেই গলায় আটকে যাবে।
এদিকে, মাসের শেষ হয়ে এলো... এই নামমাত্র লাভের রাখবে কি আর পার্টির ছেলেগুলোকেই বা দেবে কি?! এই ভাবতে ভাবতে প্রকাশ বিছানায় ঘেমে ওঠে রাতে। অরুণারও মাঝে মাঝে রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। গোবিন্দ বলে ছেলেটার পান খাওয়া দাঁতের হাসিটা স্বপ্নে তাড়া করে। ছেলেটা আজকাল নিয়ম করেই সন্ধেবেলা বন্ধুদের নিয়ে এসে ডিম সেদ্ধ, কিংবা টোস্ট খেয়ে যায়। সন্ধেবেলাই আসে, কারণ ওইসময়টা অরুণা দোকান সামলায়।
মানুষের খোসা (বিকল্প উপসংহার ৩)
প্রকাশ সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না। অনেক কিছু বুঝতে পেরেও চুপ থাকে। মাঝে মাঝে মাথা গরম হয়, মাঝে মাঝে ঘাড়ের কাছটা টনটন করে... মাথা ঝিমঝিম করে। চেঁচিয়ে বা অশান্তি করে কিছু কাজের কাজ হয় না, এটা শেষ ছ'-সাত মাসে হাতে কলমে বুঝে গেছে। অরুণাও বুঝিয়েছে অনেক করে। নিরাপদ লোকটা নিজে পাক্কা ব্যবসাদার। এটা-সেটা বুঝিয়ে নিজেই কিছু টাকা হাতিয়ে নেবে। ওর চেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে হবে, ওর চেনা লোকের থেকে মাল সাপ্লাই নিতে হবে, ওর ঠিক করে দেওয়া জায়গায় দোকান দিতে হবে... সবই ও বলে দেবে। চালাকি!
নিরাপদ আর ওর দেঁতো হাসি হাসা চেনা লোকগুলোকে কাটিয়ে নিজেই পার্টি অফিসে চলে গেছিল প্রকাশ। অফিস থেকে ক্লাব, ক্লাব থেকে আর এক পাড়ার অফিস, সেখান থেকে আর এক ক্লাব। মোটামুটি সব জায়গা ঘুড়ে স্পষ্ট বুঝে গেল... হাজার নাক রগড়েও টাকা না খসিয়ে এক পা এগনো যাবে না। শেষে গায়ে পড়েই একটা ফালতু রফা করল। সামনের ইলেকশন, ওদের লোক দরকার। প্রকাশও যাবে অন্য গ্রামে ডিউটি দিতে। দলের যা যা দরকার লাগে। ছোট-বড় কাজ, যতটা পারবে। প্রকাশ কী জানে আর কী পারবে... তা নিয়ে পার্টির ছেলেদের তেমন মাথা ব্যথা নেই, কারণ ওকে দরকারও নেই। কেমন যেন কাকুতি-মিনতিতেই রাজী হয়ে গেল শেষমেশ। পার্টির হয়ে বেগার খাটার জন্য এক পয়সাও পাবে না। রাতও জাগতে হ'তে পারে। অন্য গ্রামে গিয়ে পড়েও থাকতে হ'তে পারে যতদিন বলা হবে। বদলে ওই পাঁচ হাজারটা কমে যাবে। আর পার্টির কাজ পাকাপাকি ভাবে করে গেলে হয়ত মাসে মাসেও কমই দিতে হবে। তবে এইসব কিছু মুখের কথা... মুখের কথা মেনেই কাজ করতে হয়। প্রকাশের আর দোকান দেওয়া হ'ল না। তবে দোকানটা হয়েছে বাজারেই, নিরাপদর দোকানের থেকে একটু দূরে... প্রকাশের বউ অরুণাই সামলায়। প্রকাশকে চলে যেতে হয়েছে পাশের গ্রামে, পঞ্চায়েৎ ভোট শেষ হ'লে তবে ফিরবে। ততদিন অরুণা একাই।
পার্টির ব্যাপার-স্যাপার অরুণারও কানে আসে। প্রকাশদের সঙ্গেই কাজ করত সজল। পার্টির ছেলে। আলাদা সুবিধে ছিল। বাইক অ্যাক্সিডেণ্টে মরে যেতেই সব ফক্কা। পার্টি থেকে বলেছিল বউকে একটা চাকরি পাইয়ে দেবে। মিথ্যে বলে লাভ নেই... পাইয়েও দিয়েছে। মাস মাইনে ভাল, মেয়েটার স্কুলের মাইনেও কুলিয়ে যায়। কিন্তু সজলদার বউ কাবেরীকে এক নেতার বাড়ি রান্নাটা করে দিতে হয়। সন্ধের দিকে চায়, রান্নাটা করে দিয়ে আসে। সেই নেতার বউয়ের নাকি হাঁটুর ব্যামো। নড়াচড়া বেশি করতে পারে না। অরুণা জানে, ওই রান্নার কাজটাই আসল... ওই দিকেই সংসারটা চলছে। খোঁজখবর রাখলে অরুণাও একটা রান্নার কাজ, কিংবা কাপড়-কাচা বা বাচ্চা-সামলানো, নাহ'লে নেহাৎ অথর্ব বাবা-মাকে দেখা... কিছু একটা জুটিয়েই নেবে। ভালমন্দ কিছু কপালে থাকলে শেষমেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে... তার কি ঠিক আছে? তার থেকে নিজেই যদি সময় থাকতে থাকতে একটা ব্যবস্থা করতে পারে... সংসারের অবস্থা থাকলে... সম্মানেরও ব্যবস্থা হয়ে যায়।
--- --- ---
এই তিনটে উপসংহারের মধ্যে কোনটা কতটা ভাল থাকা, তা আমি বা আপনি বলে দেওয়ার কেউ নই। আর বিচার করার তো প্রশ্নই ওঠে না। কি জানেন... আমাদের, কিংবা প্রকাশ আর অরুণাকে কষ্ট করে ডিম সেদ্ধর কারবার নিয়ে এত কিছু ভাবতেই হ'ত না; যদি প্রকাশের কারখানাটা হঠাৎ বন্ধ না হ'ত।
কী ভাবছেন? আসল অ্যান্টিক্লাইম্যাক্সটা ঠিক কোথায়? এই কারখানা লকআউটের পরিচিত খবর? তিনটে উপসংহারের মাঝে ঘেঁটে যাওয়া গল্প? নাকি... এই চরিত্রের নাম দু'টো... প্রকাশ আর অরুণা?!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন