আড়াল
কেওনঝড় থেকে ফেরার পথে ছোট্ট চায়ের দোকানটায় নেমে পড়েছিলাম। বৃষ্টি হয়েছে গতরাতে। মৃদুলা কিছুতেই থাকতে রাজি হল না ফলে আমার পরিকল্পনা জলাঞ্জলি দিয়ে ফিরতে হল। এখানে রাস্তাটা বেশ উঁচু। পাহাড় ঠিক না তবে উঁচু টিলা। টিলার টঙে দোকানে পিছনে বেশ খাদ মতো, নীচে জলাটা বর্ষার জলে থৈ থৈ। ওড়িশার অন্দরে গাছের প্রাচুর্য যথেষ্ট। দোকানির চোখ কোটরগত তিক্ষ্ণ, বেঁটেখাটো তৎপর ভঙ্গি। মৃদুলা বহুক্ষণ থেকেই কিছু খুঁজছিল বুঝতে পারছিলাম। ড্রাইভিং সিটে থেকেও বিষয়টা বুঝতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। ভাবলাম টয়লেটের প্রয়োজন হয়তো। যদিও মনটা খিঁচড়ে ছিল বলে আগ বাড়িয়ে কিছুই জিজ্ঞাসা করিনি। অনেকগুলো টাকার দণ্ড গেল। এখন আবার নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। চায়ের দোকানটা খানিকটা স্বস্তি দিল। গুছিয়ে বসে ঘন দুধের চা, বাদাম দেওয়া বিস্কুট আর ডবল ডিমের অমলেট খেতে শুরু করলাম। মৃদুলা উল্টো দিকের বেঞ্চে বসে লঙ্কা বেছে অমলেট খাচ্ছে। ওর সঙ্গে দূরত্বটা এখন অসহ্য হয়ে উঠেছে। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে কিছুই মেলেনি আমাদের। তার উপর বছর বত্রিশের মৃদুলাকে এখন একটু বয়স্ক লাগে, বোধহয় ওজনটা বেড়েছে বলে। তাছাড়া সবেতেই তো অসন্তুষ্ট। মুখে সেই ছাপটাই বড় হয়ে ফুটে ওঠে। বিরক্ত লাগে বলেই তাকাই কম। এখন চা খেতে খেতে দেখি কিছু খুঁজেই চলেছে। বৃষ্টিটা শুরু হল আবার। টিনের চালে ঝমঝম শব্দ বাড়তে থাকল। দোকানি গলা তুলে বলল, দাদা আর কিছু লাগবে? আরেক কাপ চা চেয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে একটা বাইক এল দুজন আরোহী নিয়ে। কালো রেনকোট পরা লোকদুটো নেমেই সিগারেট ধরাল, মনে হল লোকাল। অনর্গল ওড়িয়া ভাষায় তুমুল কথা বলছে। ওড়িয়া বুঝি কিন্তু বলতে পারিনা। কথাগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং।
-যাদের বেশি টাকা তাদের ওরম হয় আমাদের হয় না।
-বাজে কথা বলিস না, রঞ্জাকুমার টাঙি দিয়ে বউটাকে খাটো করে দেয়নি। কাটা মুণ্ডুটা বিস্ময়ে ভয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিল। আর মুকুর! নিজের বাপকে মেয়ে হয়ে বিষ দিতে দুবার ভাবেনি। ওসব বড়োলোক গরীবলোক কোনো ব্যাপার না। শালার রিষ সকলের মধ্যেই।
-তবু ওরা সব পারে আমরা পারিনা। আমার বউয়ের ঢিলা শরীর, কষকষে গলা আর আবর্জনার মতো মন তবু কি এমন ভাবতে পেরেছি।
-হয়তো এমন কিছু আছে তুই আমি বুঝতে পারছি না।
-তুই শালা এদের হয়ে এত কথা বলছিস কেন?
ওদের কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। পয়সা কড়ি থাকলেই লোকের জ্বালা ধরে অনেকখানি। তবে এদের ভিতর আরও কিছু গোপন কথা লুকিয়ে আছে বোঝা যাচ্ছে। মৃদুলা খাওয়া শেষ করে মোবাইলে একমনে কিছু দেখছে। লিখছে। ছবি তুলছে। আমি ওর ফ্রেমে আসছি তবু সরছে না। সেই প্রথম দিনগুলোর মতো। একটু যেন হাসল। আমি ভুল হতেও পারি। এখনঢ়কটা বাজে? চমকে উঠলাম। এতক্ষণে সবটুকু সমাধান হয়ে যেত হয়তো। ছেলেদুটো মন দিয়ে মোবাইল দেখছে। আমাদের দিকেও একবার যেন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। সেই হানিমুনের দিনের স্মৃতি ভেসে এল।
রাবাংলায় এক মনোরোম পরিবেশে ছিমছাম হোমস্টেতে নতুন বউ নিয়ে উঠেছিলাম। পাশের ঘরে চার বেহেড মাতাল। মৃদুলা তখন মোটামুটি সুন্দর। সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে মাতালগুলো। শেষে বউকে বগলদাবা করে সোজা গ্যাংটক। জমজমাট এমজি মার্গে বিখ্যাত হোটেলের তিনতলায়। আজও একটা অস্বস্তি হচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে মৃদুলার দিকে এগিয়ে গেলাম।
-কিছু বলবে? কিছু লাগবে?
-নাহ্, এখানে তোমার পাশে একটু বসি।
-আমার পাশে? হঠাৎ! কেন তোমায় আজ কেউ ফোন করেনি, ওহো এখানে বোধহয় নেট ওয়ার্ক নেই না!
এত অপমান! ভুলে গিয়েছে নিজের যোগ্যতা! ওর বাবার দু কামরার ওই বাড়িতে কিছুই ছিল না অভাব ছাড়া। রানী করে রাখতে না চাইলেও অভাব কিছু দিইনি কিন্তু বিনিময়ে জুটল কেবল জ্বালা। একটু যদি নরম সরম হত এতকিছু ভাববার দরকার হত না।
-কী হল উঠে যাচ্ছ যে?
-আমি থাকলে তোমার বোধহয় ভালো লাগবে না।
-নাকি আমায় ভালো লাগছে না!
-আমি কিন্তু বসতেই এসেছিলাম।
-তাহলে যাচ্ছ কেন?
-তুমিই তো প্রশ্ন তুললে।
-প্রশ্ন তুললাম বলে চলে যাবে? আত্মপক্ষ সমর্থন করলে না?
-তোমাকে আমি বুঝতে পারিনা। কী চাও তুমি?
-বুঝতেই পারোনা যখন তখন আর জানতে চাইছো কেন? আমি বললেই কি তুমি বুঝবে?
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই উঠে চলে আসি দোকানটার পিছনে। চমৎকার জায়গা। দূরে নীচে ছককাটা জমিতে কত রঙের বাহার। এখানে মাটির রঙ লালচে কাঁকুড়ে। রেনকোট পরা একটা ছেলে এদিকেই ঘুরছিল, পরিস্কার বাংলায় বলল, আপনার পিঠের উপর কাঁটাকাঁটা ধারালো খোলস আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। খুব চমকে উঠলাম। অপিরিচিত কেউ এমন ভাবে কথা শুরু করেনি কখনো। ওর মুখে বেশ পুষ্ট গোঁফ, চোখ দুটি আয়তাকার, উজ্জ্বল, গায়ের রঙ কালো। আমি বেশ মজা পেয়ে বললাম, তোমার গল্পের বড়োলোক মানুষদের এমন খোলস আছে? ছেলেটি চমকালো না, বলল, আপনার লুকানো সত্যিগুলোর মধ্যে একটা অবৈধ যৌনতার গাঢ় ছাপ। আপনি আদতে গিরগিটি। এবার একটু রাগ হয়ে গেল।
-কে মশাই আপনি না জেনে বুঝে যা খুশি বলছেন?
লোকটা গায়ের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, কত টাকা নষ্ট হল আপনার? এবার আর চমকে উঠছি না। কেবল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বললাম, আপনি বেয়ারা, অসভ্য। আমার এখান থেকে যান।
-যান বললেই যাওয়া যায়? ধুস্ কী যে বলেন আপনি। দেখুন কেসটা খোলসা করে বলুন দেখুন আমি ঠিক সমাধান বলে দেব। এটাই আমার কাজ।
-কী কেস কী সমাধান?
-ওই যে মুক্তি খুঁজছেন। আসলে মনের অন্ধকারে আপনি যা দেখতে পাচ্ছেন না তাকে খোঁজা এবং সমাধান দেওয়া আমার কাজ।
যত্তসব বলে লোকটাকে এড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। পিছু নিল নির্বিকার ভাবে। আবার গা ঘেঁষে এল। অণ্বেষা ম্যাডামের ডান গালের তিলটা সত্যি মারাত্মক। আপনাকে পুরোপুরি দোষ দিতে পারছি না। তবে ব্যালেন্স করে কিন্তু চলতে পারেন। অবশ্য আপনার একমাত্র জ্যেঠার ছেলে বলে কথা তাই এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এবার আমি ভয় পেলাম, ঘাড়ের নীচে একটা স্রোত বয়ে গেল। লোকটা বড্ড বেশি জানে কিন্তু কী করে? চোঁয়া ঢেকুর উঠে এল গলা বেয়ে। দিনটা চোখের উপর খোঁচা দিতে শুরু করেছে।
-আপনার জ্যেঠতুতো ভাই অবশ্য যাকে বলে অপদার্থই ছিল। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো স্বভাব। বাপের অগাধ সম্পত্তি দিয়ে রাস্তার ছেলেপুলেদের পড়া শেখানো, আরে ছ্যা ছ্যা। তার উপর অমন সুন্দর বউ দিনের পর দিন একা। আচ্ছা অণ্বেষা ম্যাডাম দারুণ আবৃত্তি করে না! শুনেছি ওয়াইন এক্সপার্ট উনি? আবার ককটেল বানাতেও দক্ষ। তার উপর ওমন ফিগার। এমন বউ রেখে...আপনি বিরক্ত হচ্ছেন তাই না! তবে লোকটাকে বিষ না খাওয়ালে আপনার সত্যি চলত না, অত বড় সম্পত্তি একেবারে পথে চলে যেত। ভালোই করেছেন তবে অণ্বেষা ম্যাডামকে ট্যাকেল করা একটু কঠিন তাই না!
লোকটার একটা কথাও আমার কানে ঢুকছে না। কেবল মনে হচ্ছে আমার আর অণ্বেষার দীর্ঘ বছরের গোপন সম্পর্ক লোকটা জানল কী করে? জ্যোতিষ্ক বিয়ে করেছিল আমার আগে। বিয়ে শেষে বাসর ঘরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল। আমি তখন বরকর্তা। অণ্বেষা দাঁড়িয়েছিল ব্যালকনিতে। অপরূপ সুন্দর। ওর চোখে অপমানিত আহত কালনাগিনী। আমি পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, মন খারাপ করছে? বর ঘুমাচ্ছে বলে? ও সোজা আমার মাথা টেনে ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল। হতভম্ব আমি সামলে নিতে সময় নিয়েছিলাম। ততক্ষণে সরে গিয়েছে অণ্বেষা। আমি চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম, ভাইয়ের দোষে আমি শাস্তি পেলাম, তুমি আমার ছোটো এবার তোমায় আমি শাসন করি?
-নাহ্ শাসনটা তুলে রাখুন, কাল, পরশু কাজে লাগবে।
সত্যিই কাজে লেগেছিল। যদিও আশ্চর্য উদাসীন অণ্বেষা। ইচ্ছে মতো পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে যেত। হাতটুকুও ছোঁয়া যেত না। এদিকে বাড়িতে বিয়ের চাপ।
-বিয়েটা করে নিন শশাঙ্কদা। বিয়ে করলে জীবন সুন্দর হয়। যেমন আমরা খুব ভালো আছি।
জ্যোতিষ্ক ক্যাবলার মতো বলেছিল, ধুর তুমি কোথায় ভালো আছো? আমি তো একটা ওয়ার্থলেস। বড়দার মতো লোক হলে তোমার জীবন সুন্দর হত। অণ্বেষা তিক্ষ্ণ তাকিয়ে বলেছিল, পারফেক্ট ম্যাচ বলে কিছু হয় না সবটাই প্রয়োজন। তোমার অর্থ আমার কাজে আসে জ্যোতিষ্ক। সেটা অস্বীকার করা যায় না। মৃদুলাকে পেয়ে প্রথম প্রথম সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করলেও একেবারেই ব্যর্থ হয়েছিলাম। তাই পরের দিকে বেপোরোয়া হয়ে উঠেছিলাম। সেদিন খুব শীত ছিল। লোকটা আবার ঘন হয়ে এল।
-আচ্ছা সেদিন সন্ধ্যায় অণ্বেষাম্যাম আর আপনাকে কি হঠাৎ উনি দেখেন নাকি ওটাও আপনাদের দুজনের ছলনা। আসলে জ্যোতিস্ক বাবু সেদিন রাতে ফিরবেন এবং আপনাদের আবিস্কার করবেন এটাই চেয়েছিলেন? আচ্ছা আপনাদের ওইভাবে দেখার পরেও উনি আপনার সাথে বসে মদ খেতে রাজি হলেন?
লোকটার দিকে তাকিয়ে খানিক হাসলাম। সবজান্তা লোকটিকে বললাম, সব জানতে চান কেন? লোকটিও ব্যঙ্গ করে হাসল, আপনার মুক্তির জন্য। খ্যা খ্যা করে হেসে বললাম, ওই যে আমার স্ত্রী বসে আছেন যান গিয়ে ওকে বলুন আমার জীবন থেকে চলে যেতে তাহলেও আমার মুক্তি। লোকটা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ।
-অথবা আপনি সরে গেলে মৃদুলার মুক্তি।
-মানে?
-মানে মৃদুলা বিয়ের দিন থেকেই আপনার আর অণ্বেষার সম্পর্ক বুঝতে পেরেছিল। বুঝেছিল অমোঘ টান আপনার। তবু চুপ করে ছিল কারণ প্রয়োজন তারও আছে। আবার যেমন ধরুন সমীরণ আজও তাকে ভালোবাসে। বহুদূর থেকে ছুটে যায় তার মৃদুলাকে দেখতে একটু ছুঁতে।
-কী কী বললেন আপনি? মৃদুলার গোপন প্রেমিক আছে?
-বাহ্ আপনার থাকতে পারে তার নয়?
-না ভাবছি এই ঢিলে, স্হূল, অকেজো শরীর কার হৃদয়ে দোলা দিল।
লোকটা হাহাহা করে হেসে উঠল। চমৎকার নাটকীয়তায় বলল, আপনি নিজেকে সুদর্শন ভাবেন তাই না! দাঁড়ান আপনাকে একটা রেকর্ড শোনাই। মোবাইল বার করে বোতাম টিপতেই ঘ্যাঁশঘ্যাঁশে শব্দ বেড়ে চলল, তারপর হঠাৎ ভেসে এল সুর, দানবের মৃত্যু হোক অঘটন। সূত্র থাকবেনা এমন দাবী করিনা তবে সূত্র হবে দুর্ঘটনার সপক্ষে। যার চরিত্র নোংরা, যার রূপ ভয়ংকর কদর্য, তার মৃত্যুও ভয়াবহ। মুখটুকু দেখবার মতো না থাকলেও চলে। আওয়াজ বন্ধ হতেই লক্ষ্য করলাম আমার খুব ঘাম হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি আবার দোকানের পিছনের দিকে হাঁটা লাগাই। লোকটা এগিয়ে আসে কাছে।
-গলাটা কার স্যার? আপনি চেনেন? আপনাকেই বলছে না তো এসব?
অসম্ভব রাগে কাঁপতে কাঁপতে লোকটার মুখোমুখি দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই পা হড়কে গেল। খানিকক্ষণ শূন্যে হাতড়ে গেলাম। শেষবার ভাবতে চাইলাম গলার স্বর কার? মৃদুলার নাকি অণ্বেষার? আকাশের বুকে লোকটার মুখ দেখলাম, কানে ফোন নিয়ে চাপা স্বরে বলল, শিকারীর শিকার হল এইমাত্র।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন