রবিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২১

সুবীর সরকার

                           


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া
সুবীর সরকার


৫.
সব হাট কি একরকম!সোমবারের হাটের ভেতর কি খুঁজে পাওয়া যাবে বুধবারের হাট! তামারহাটের রঙের সাথে কি পুরোপুরি মিল থাকা সম্ভব রতিয়াদহ
হাটের!ছত্রশালের হাটের পাখিদের কি দেখা মেলে পানবাড়ির কোন এক শনিবারের হাটে!
সব হাট একরকম হয় না।সব গান একরকম হয় না।
সব গঞ্জ আর গাঙ একরকমের হতে পারে না।
প্রবেশ আর প্রস্থান দিয়ে এক একটি হাটপর্ব রচিত হতে থাকে।আর লোকমান পাগলার হাটে ধুলোর ঝড়সমেত ঢুকে পড়ে জোড়া মহিষ।গদাধর নদীর কোন বা চর থেকে বাথান ভেঙে এরা বুঝি চলে এসেছে এই হাটে ভেতরে।সমস্ত হাট জুড়ে একটা হুড়াহুড়ি লেগে যায়।মানুষের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ।তখন কোথায় ইয়াকুব ব্যাপারী কোথায় মহিউদ্দিন ওস্তাদ কোথায় লোকমান!ভরা হাটের কোলাহল থেকে সরে আসতে আসতে ময়কান্ত মৈশাল তখন খুঁজতে শুরু করে বাথান পালানো সেই জোড়া মহিষদের।তার হাতে দীর্ঘ পেন্টি।মাথা গামছা দিয়ে পাগড়ির মত করে বাঁধা।প্রায় তিন কুড়ির পেশীবহুল সুঠাম শরীরের পেশীগুলো একত্রিত করে 
ময়কান্ত তার কণ্ঠে তুলে আনেন মহিষের কণ্ঠের আকুতি।এই ডাক শুনে সেই জোড়া মহিষ কেমন থমকে দাঁড়ায়।তাদের বড় বড় চোখে কেমন মেঘের ছায়া!একটু বাদের দেখা যাবে সেই জোড়া মহিষ অদ্ভুত আহ্লাদ নিয়ে হেলে দুলে ময়কান্তর পিছনে পিছনে সেই বাথানের পথ ধরে ফেলেছে।গদাধর নদীর কোন বা চরের খুব অন্দর থেকে ভেসে আসছে 
হাহাকার ভরা গানের সুর_
"আরে ও  মৈষের  দফাদার ভাই
ডালা সাজাও ডালা সাজাও
চল মৈষের বাথানে যাই রে"
ময়কান্ত তার জোড়া মহিষ নিয়ে বাথানে চলে যেতে থাকে।কিন্তু হাট ভেঙে যায়।
৬.
ইয়াকুব ব্যাপারী মহিউদ্দিন ওস্তাদ লোকমান পাগেলাকে ভুলে গিয়ে আপাতত আমরা ঢুকে পড়তেই পারি বালাজানের হাটে।গঙ্গাধরের বাতাসে নদীর বালু উড়ে আসছে হাটের মস্ত খোলের ভেতর।শরীর ভরতি বালুকণা মেখে গরুহাটির উত্তর শিথানে
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সাজু  চোরা।না,সাজু চোর নয়।তার নাম সাজু মোহাম্মদ। হাটে হাটে গরুর দালালি করে বেড়ায়।আর "চোর চুন্নি" পালাগানে
সাজু চোরের ভূমিকায় অভিনয় করে।তার শরীরের পরতে পরতে তীব্র এক নাচের ছন্দ লুকিয়ে আছে।সাজু চোরার পালা দেখার জন্য মানুষ হামলে পড়ে গানবাড়িতে।সাজু মোহাম্মদকে এখন আর কেউ চেনে না।সবাই সাজু চোরাকে একনামে চেনে।সাজু যখন নেচে নেচে শরীরে অদ্ভুত পাক দিতে দিতে গেয়ে ওঠে_
"ও কি হায়রে হায়
আজি মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়"
তখন সমগ্র গানবাড়ি জুড়ে কি এক উন্মাদনা!
সাজু চোরা ছিল গানমাস্টার মঈনুদ্দিন এর শিষ্য।
মঈনউদ্দিন আবার ছিল আলাউদ্দিন এমেলের সাকরেদ।সারাজীবন এই গান,এই নাচ,রাতের পর রাত গানবাড়ি নিয়েই জীবন কাটে সাজু চোরার।
গরুর দালাল সাজু চোরা গরুহাটির ভেতর দাঁড়িয়ে 
কি ভাবছিল!রহস্যমোড়া গানবাড়ির কথা।নাকি সওদাপাতি নিয়ে বাড়ি ফিরবার কথা!তার শরীর জুড়ে নাচের ছন্দ ক্রিয়াশীল থাকে আর হাটের অন্ত মধ্যে সাজু ছড়িয়ে দিতে থাকে গুনগুন সুরের কোন এক গান,যা দূরাগত হওয়ার ডানায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমস্ত হাটের পরিসরে_
"ওরে ফুলবাড়ীত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিতে যামো হামরা গরুর গাড়িত চড়ি"
এইভাবে পুরোন হাটপর্ব শেষ হয়ে যায়।নুতন নুতন হাটগুলোর হাট হয়ে উঠবার জন্যই হয়তো বা!

          



ক্রমশঃ
(চিত্রঋণ- সুবীর সরকার)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন