শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

                               


 

আতিশ






" কিছুকে ভাঙা বা গড়ার জন্যে ডেলিবারেট বা ইনটেনশনাল হতে হয় না। অন্তরঝাঁপিতে উঁকি দিতে হয়। রূহ কী চাইছে। যদি তোমায় দিয়ে নির্ধারিত থাকে ধ্বংস বা সৃষ্টি, সে তন্ত্র হোক বা সংস্কার, তা ঘটবেই, সময় করিয়ে নেবে। কিন্তু শুধুমাত্র ঐতিহ্য আঁকড়ে থাকা বা ট্রেন্ডসেটার হতে গিয়ে মানুষ বড় নিষ্ঠাবান হয়ে পড়ে উদ্দেশ্যে। প্রয়োজন হয় সলিউবিলিটি, তারল্য অর্জন। আয়নার মত স্বচ্ছ সে মাধ্যমে অনায়াস খেলতে পারে তখন কালপ্রতিমার ছায়া " 



রাজহাঁসরঙা শাড়িগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাদের অধিশ্বরী কমলিনীর কথাগুলোর প্রতিধ্বনি পাচ্ছিলো স্বধা। বহুদিন হলো চারটে দেওয়াল থেকে পাথরের ছায়া ঝরাতে ঝরাতে এমন অদৃশ্য পাষাণ গেঁথে তুলছিলো সময়, ভুলে যাওয়া ডানাগুলো খোঁজা হচ্ছিলো না। অথচ এক দুপুরে, পলাতক রোদ্দুর আর কাঠবিড়ালির মধ্যে পার্থক্য কীভাবে করবে বুঝে উঠতে না পারায় তার মনে পড়লো প্রতিটি অপেক্ষার নিজস্ব সৌন্দর্য থাকে আর অপেক্ষা ঘন হতে থাকলে তার গায়ে যে সলিচিউডের পশম জড়িয়ে যায়, সে ওম থেকে খুব সহজে আর বেরনো যায় না। মুশকিল হলো তার অপেক্ষা আছে কিন্তু সে অপেক্ষার বর্ণ নির্ধারণ করতে বসলে নিজেকে রংকানা ঠাহর হচ্ছে। স্মরণে এলো সেই সঙ্কটে তার মাথায় হাত রেখে বলা কমলের (এই নামেই সে তার ঠাম্মিকে ডেকে এসেছে বরাবর) শেষ কথাগুলো।

(বেনারসে দশেরার ধুম শেষ হলে পঞ্চদশী স্বধার মেঘেদের দেশে ফেরার মেঘলা সকালে যা তিনি বলেছিলেন... আর দেখা হয়নি। ইউক্যালিপটাস ঘেরা নির্জন প্রিন্সিপাল রুমের ভারী কালো ল্যান্ডলাইনটা বেজে ওঠার বহু আগে সে টের পেয়েছিলো কমলের মুক্তি সংবাদ। অদ্ভুত কমলা রঙের আলো পিঠে ছড়িয়ে তার বেডের লাগোয়া  শার্সিতে এসে বসেছিলো সেই সকালে যখন এক গোল্ড নেপড ফিঞ্চ। এ পাখি বিরল নয় এই প্রদেশে কিন্তু অরণ্য ছেড়ে সে খুব কমই বেরোয়। বহু সাধ্য সাধনায় তার দর্শন পায় সারা পৃথিবী থেকে আসা অর্ণিথোলজিস্টরা। সে পড়তে পেরেছিলো কমলের বার্তা। বিশ্বাস অবিশ্বাসের সীমা অতিক্রম না করতে পারলে এই মায়াদিগন্তে পা রাখা যায় না, যুক্তি যাকে কাটতে পারে না, ব্যাখ্যা যার নাগাল পায় না, যেখানে নীলকন্ঠ উড়ে যায় দর্পণ বিসর্জনের পর খাঁচা থেকে আত্মারাম নিষ্কৃতির রূপকে)


--" কমফোর্ট জোন থেকে বেরোতে তোমার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে তুমি নিজেকেই প্রতি মুহূর্তে পাবে দিদিভাই। আপাত অজ্ঞাত প্রতিকূলতা তোমায় আলস্য দেবে আর সেই ই তোমায় ধীরে স্থবিরও করবে। আমি চাইবো এমন যখনই হবে, ছিঁড়ে দিও নিজেকে, ডিকন্সট্রাক্ট কোরো লিয়ারকে ভেবে নিয়ে। জানো তো সেই বিখ্যাত সাধক কখনো একই বৃক্ষের নিচে দুই বার ধ্যানে বসতেন না, যেন মায়া না বসে। অবিদ্যাকে না ভাঙলে বিদ্যা অর্থাৎ মহামায়া চৈতন্যে পা রাখেন না। তাই সতর্ক থেকো "


সুতরাং সে আজ আবার পথে, একবার ছুঁয়ে যাচ্ছে শুধু কমলভূমি। দেশ দেখা যে কী প্রবল ব্যঞ্জনাময় তা বোধ করি ঋতুপর্ণের মতো জানতে ও জানাতে কেউ পারেন নি ভারতীয় চিত্রপরিচালকদের মধ্যে। এই বিতর্কিত মন্তব্য বহুবার প্রকাশ্যে করে সমালোচিত হয়েছে স্বধা। বারবার তুলনা আনা হয়েছে কাশবনে অপু দুর্গার ট্রেন দেখাকে ঘিরে। কিন্তু সে এটা কিছুতেই বুঝতে পারে না যে, কোনো মতকে পোষণ করা সিদ্ধান্ত আর মৃগদৃষ্টির মধ্যে আদতেই কোনো পার্থক্য আছে কিনা। অতএব সন্ধ্যার গঙ্গাবক্ষ থেকে আলোকউজ্জ্বল ঘাটের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে ব্যাসকাশীর দিকে তাকানো সে নিজস্ব সিদ্ধান্তেই ভিজে নিল আরেকবার। 


বোহেমিয়ানা যাদের অকৃত্রিম একমাত্র তারাই বোধ হয় বোঝে কেন গালিব বলতেন "নশা অগর শরাব মে হোতি তো নাচতি বোতল" । আসলে নেশা হলো স্নায়ুর সেই আশ্চর্য অবস্থান যেখানে নেশারু নিজের ভিতর ঈশ্বরসত্ত্বাকে আবিষ্কার করে, দ্যা সুপ্রিমো। ফলে যে কোনো মূল্যে বারবার পৌঁছাতে চায়। সুর, সুরা, শিল্প, সাহিত্য, একাকীত্ব, দেশ দেখা সব, সব তারই অনুসন্ধান মাত্র, যে যেভাবে পায়। যে যত সংখ্যক মাধ্যম ছুঁতে পারে, তার সংবেদন ততো সূক্ষ্ম। এসব একান্তই স্বধার ব্যাক্তিগত বিচার যদিও। যে স্বাধীন চিন্তার বীজ কমল পুঁতেছিলেন প্রথম কপালে হাত রেখে তার পৌত্রীর, তাই আজ তার সমস্ত শরীর বেয়ে উঠে মস্তিস্কের কোষে কোষে ছড়িয়েছে। এই কথা সে টের পায় একা হলেই অপূর্ব একা যখন হতে পারে আর কী। সর্বদা কী আর পারে? রক্তে লবণ কার না থাকে? নাভি থেকে পারাবত কার না উড়ে যেতে চায়? পৃথিবীতে এমন আনন্দ অথবা শোকের অস্তিত্ব আছে কি যে খিদে ভোলাতে পারে? ক্ষুধাপ্রবণ নশ্বরতা, কে পারে বিনা সাধনে তাকে অতিক্রম করতে। সে তো সামান্য নারী মাত্র। উদাসীন জাস্কর উপত্যকা থেকে নির্লিপ্তির চাদর জড়িয়ে তার ক্রাইস্ট যতই তাকে ঈশ্বরী হয়ে উঠতে বাধ্য করুক, নূপুর খুলছে কই? এও আরেক সমস্যা। ঈশ্বরবোধের ভিতর স্বধা কখনো ফুল ধূপকাঠি নৈবেদ্য ঢোকাতে পারলো না। অসম্ভব শরীরী তার আধ্যাত্মিকতা। রাসজ শ্বাসে তার ভক্তি আসে না, রমণস্পৃহা জাগে।


অলীক এই অন্তর্দাহ স্বধার মধ্যে প্রত্যক্ষ করতেন কমলিনী। লিখে গেছেন। বহুবার পড়েছে সে। আজ সেই ডায়েরি বরাবরের মতো নিজের কাছে নিয়ে যেতেই তার পীতাম্বরপুরার পাথরে পা রাখা, হয়তো শেষবারের মত। 

--" দিদিভাই,

তীব্র অহং ও যন্ত্রণা সমানুপাতে সম্বল করে আমায় ছেড়ে যেতে হচ্ছে এই জন্মের মেয়াদটুকু আজ। ভেবেছিলাম মুক্ত হয়েছি, পারলাম না। আমার প্রকৃত অংশের দায়টুকু তুমি নিয়ে রাখলে। তুমি বাঁচবে আমি জানি অথচ হেঁটে যাবে যে যে ভিস্তা দিয়ে তাতে নির্ধারিত আছে এমন কাঁটারা, পা থেকে রক্ত ঝরবে না, ক্ষতরা মারিয়ানা হবে। তুমি প্রেমে বিশ্বাস করো না, সম্পর্ক মানো না, অথচ নতজানু হয়ে থাকো ভালোবাসতে। তুমি মানুষের শরীরে প্রত্যাশা রাখো ঐশ্বরিক ধারণ আর ঈশ্বরের থেকে আশা করো মানবিক বোধ। এ কি সম্ভব? আমি যতটুকু দেখছি সামনের দিকে তাকিয়ে, প্রতিবার নি:স্ব হয়ে যাচ্ছ সমর্পণ ও প্রত্যাহার শেষে। আমি নিশ্চিত জানি আধারেরা টের পাবেনা। এক উত্তরই তো প্রতিবার পেয়েছি তোমায় বুঝতে গিয়ে 'ইশক কোই সনম ইয়া আপ খুদা কমল?' এ আমার হাহাকার, তোমার প্লাবনের মতো কাঙালপণাকে তীর থেকে তীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে নোঙর ফেলতে দেখছি মাঝ দরিয়ায় যেখানে সূর্যও উদয় অস্তের নীতিহীনতায়। সদ্য রজস্বলার কী'ই বা বোধ থাকে মনের শরীর আর শরীরের মন নিয়ে অথচ তুমি সেই সময়েই আমার কাছে স্পষ্ট উচ্চারণ রেখেছিলে 'যাকে নিয়ে উত্তাল হবো আগে তো তাকে আমার মাথা পেরিয়ে আসতে হবে। চামড়ায় কিছু থাকে কি? মেটিয়াবুরুজের ট্যানারিতে শত শত ঝুলতে দেখেছি। হৃদমাঝারে রাখতে আর কাকে পারি সোনার গৌর ছাড়া? হৃদি গো হৃদি, সে না জাগলে আর এগোই কী করে?' দিদিভাই কাকে চাইবে তুমি অথবা অজস্র চাইবে। প্রতিটা চাওয়া একটা করে ভাঙনের উত্তরণ রেখে যাবে। না মানুষ কখনো ঈশ্বর হবে না ঈশ্বর কোনোদিন মানুষ। দুই'ই তো শব্দমাত্র, গড়ে নেওয়া আলেয়ার, আরোপিত সংজ্ঞার। অথচ এই দ্বন্দ্ব থেকেই উৎক্ষিপ্ত মহাজাগতিক কণার মতো আবর্তিত হতে থাকবে তুমি সমগ্র আয়ু। নিজের উপর ক্ষোভ আসছে আজ আমার। কেন চেয়েছিলাম তোমায় ব্যতিক্রমী? সাধারণ হলে না, অসাধারণ হতে চাইলে না, স্বধামাত্র হয়ে রইলে।



কমল "
চিত্র - অন্তর্জাল 

1 টি মন্তব্য:

  1. যে ডিকনস্ট্রাকশনের কথা, যে কমফর্ট জোনের বাইরে সবকিছু ছিঁড়ে চেতনায় সেই মহাবিদ্যার স্পর্শ পাওয়ার কথা বলেছেন, এই গদ্যভাষ্য ধারাবাহিকভাবে তার প্রতিটি অনুচ্ছেদে,প্রতিটি বাক্যবিন্যাসে যেন তারই প্রতিচ্ছবি রচনা করে চলেছে। এমন শৈলী আর তার অন্তর্নিহিত ভাবনাপ্রদেশ বারংবার পাঠকের সামনে জলজ্যান্ত আয়না রেখে দেয়। এমন লেখা উপহার দেওয়ার জন্য পাঠক হিসেবে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ নেবেন।

    উত্তরমুছুন