রবিবার, ৮ আগস্ট, ২০২১

অনিন্দ্যসুন্দর পাল

                                   



 ধারাবাহিক- চর্যাপদ চর্যাগীতি ও সমীক্ষা


অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

তৃতীয় পর্ব


চর্যা শব্দটির মূল অর্থ আচরণ। চর্যাপদে কবিতাগুলোর মধ্যে বৌদ্ধ সহজিয়াদের আচার আচরণের বিধি নিষেধ ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা থাকায় পদকর্তারা চর্যা বলে থাকেন। তবে চর্যা শব্দটির অর্থ আচরণ হলেও গানগুলো বুঝানোর জন্য চর্যাশব্দেরই ব্যবহার হয়ে থাকে। চর্যাগীতিতে চর্যাপদের ব্যবহার অনেকটা এইরূপ। যেমন-
অই সনি চর্য্যা কুক্কুরী পাত্রঁ গাইড়।
এই উপরিক্ত বাক্যে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে এটি একপ্রকার গীতি বা গান। কিন্তু এটিকে চর্যাপদ বলা হচ্ছে। ধরে নেওয়া হয়, পদ কথাটি একমাত্র couplet বোঝাতেই গানে বা গীতিতে এর ব্যবহার। সুতরাং সে অর্থে বলা যেতেই পারে চর্যাপদ আক্ষরিক অর্থে চর্যাগীতি। যদিও প্রাচীন শাস্ত্রে চর্যাগীতি বলে বিশেষ একটি সঙ্গীত রীতির প্রচলন ছিল। কিন্তু একটি ভ্রান্ত ধারণা সবার মধ্যেই থাকে যে, চর্যাগীতি মানে সঙ্গীত বা গানকেই বুঝায়, আদতে তা নয়। মূল বিষয় এই, চর্যাগীতিগুলোর জনপ্রিয়তার জন্যই সঙ্গীতশাস্ত্রে একটি ভিন্ন ঘরানায় এই গীতিমণ্ডলীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সেই সূত্রেই ধারণা- পূর্বে গান পরবর্তীতে গীতি-রীতির উদ্ভব। আচরণ অর্থে চর্যা শব্দের ব্যবহার বৌদ্ধ শাস্ত্রে প্রচুর থাকায় বলাই বাহুল্য চর্যা অর্থে সবার পূর্বে আচরণ ও পরবর্তীতে আচরণীয় বিধি ইত্যাদি বিষয়ক কবিতা এবং তারও পরবর্তীতে সেই গুলোকেই গীতিরূপে রূপনায়ণের চেষ্টা। এতদপরেও চর্যার প্রমাণ যেমন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে মেলে তেমনিই অন্যত্র এর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। মনে করা হয় চর্যার ন্যায় এরূপ অনেক পদাবলীর অস্তিত্ব পূর্বে ছিল। বিভিন্ন পদকর্তার রচনা থেকে অনেক কয়েকটি অনুরূপ পদাবলীর সন্ধানও মেলে। বিভিন্ন রচয়িতাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় আসার আগে একটি বিশেষ তথ্য  জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। পূর্বেই উল্লেখ করেছিলাম, চর্যাগীতিকোষ রচিত হওয়ার বহু কাল পরে মুনিদত্ত বৃত্তি লিখেছিলেন। সেইজন্য তার সময় কিছু পাঠান্তর হয়েছিল। অনেকক্ষেত্রে যা মূল পাঠ অনেকাংশে ভিন্ন যেমন -





         



তিব্বতীয় অনুবাদক প্রায় মনুদত্তকে অনুসরন করলেও তাঁদের পাঠান্তর সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা ছিল না এমনটাও বলার কোনো জায়গা নেই। কারণ সেই সমস্ত প্রমানাদির কোনো তথ্যই বর্তমানে অস্তিত্ব নেই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনুদত্তের পাঠান্তর উন্নতর। যেমন- অইসনি(২.৯), ভরিলী(৮.৯), দায়(১২.৯), চান্দেরি(৩১.৫) প্রভৃতি। কোনো কোনো স্থানে দুই পাঠই তুল্যমূল্য। যেমন- 'চ্ছূপই : খন্ডই' (৬.৫), 'উইত্তা : উইএ' (৩০.৩), 'ছাড়িঅ : ছাড়িল' (৩২.৭), 'বলদ : বলদা' (৩৩.৫) ইত্যাদি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূলের পাঠ উন্নতর বটে। যেমন - 'হাড়ীত' (৩৩.১), 'নৌবানী' (৩৮.৪), 'আলে' (৪০.৫) ইত্যাদি।

আর একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, মনুদত্তের রচনার সঙ্গে মূল রচনার অনেক পার্থক্য আছে। যেমন , যেখানে লিপিকরের মূল চর্যার সব পদই ধ্রুব, সেখানে মুনিদত্ত কেবল দুটো চর্যায় ধ্রুপদ উল্লেখ করেছেন। একটিতে (২৮) চোদ্দ ছত্র ও অন্যটি (৪৩) আট ছত্র। আর বাকি সব পদকেই ধ্রুপদ বলে চালানো হয়েছে। এক্ষেতে মুনিদত্ত অনেক বেশি খাঁটি।
তবে চর্যাগীতিকোষে সংকলিত হয় নি এমন একটিমাত্র চর্যা সম্পূৰ্ণ ও কয়েকটি চর্যার কিছু পদ পাওয়া গেছে। এমনকি মুনিদত্তও তাঁর কিছু বৃত্ততেও বেশ কয়েকটি চর্যাপদ ও পদাংশ উদ্ধৃত করেছেন।

প্রসঙ্গত, পূর্বের আলোচনায় ফিরে গেলে, দেখা যাবে বিভিন্ন কর্তাদের অনুরূপ পদাবলীর মধ্যে দীপঙ্করের চর্যাগীতি, কঙ্কনের চর্যাদোহাকোষ গীতিকা ইত্যাদি বর্তমান। তাই বলা যায় চর্যাগীতিতেও ভনিতার রীতি ছিল। মুনিদত্ত যা নিজের টীকাতেও উল্লেখ করছিলেন।  তবে এর পাশাপাশি তিনি দু একটা চর্যাকর্তার নাম উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তা ভনিতা না। তবে কিছু কিছু চর্যা গুরুর নাম ভনিতারূপে গৃহীত। নিম্নে কিছু নাম দেওয়া হলো যা মূলে ও বৃত্তিতে পাই।

                 

বন্ধনীমধ্যে বৃত্তিতে উল্লেখ্য নাম ও নামরূপ

              

  




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন