শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

সৌমী আচার্য্য

                                    


সৌন্দর্য


মার সাজ দেখে থমকে দাঁড়ালো ঋতমা।গত দু তিন মাস ধরেই ঘনঘন ফোনে ফিসফাস,ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস এযে বাবার সঙ্গে কথা নয় বেশ টের পাচ্ছিলো।আজ খোঁপায় বেলফুলের মালা দেখে দরজা থেকেই বলে উঠলো,'কোথায় যাচ্ছো মা?'মেয়ের গলা পেয়ে চমকে উঠলো শেষ চল্লিশের পূরবী।আয়নায় নিজেকে দেখা থামিয়ে অস্থির ভাবে বললো,'কি রে এতো তাড়াতাড়ি ফিরলি?সবে তো সাড়ে তিনটে।'একটার পর একটা পারফিউম তুলছে আর রেখে দিচ্ছে।ঋতমা ভুরু কুঁচকে দেখলো।

-তুমি কোথায় যাচ্ছো?

-আমাদের আগের পাড়ার বোসবাবুর অপারেশন হয়েছে,তাই দেখতে যাচ্ছি।

-কি অপারেশান?

হাওয়ায় হাতড়ে বোকার মতো বলে ফেললো পূরবী,পাইলসের।খুব কষ্ট পাচ্ছিলো।উত্তর শুনে একটু বাঁকা হেসে ঋতমা বলেই ফেললো,পাইলসের রুগীকে দেখতে যাচ্ছো এমন সেজে?বাব্বা!রুগী যে এবার হার্টের ডাক্তার দেখাতে বাধ‍্য হবে মা।

-কি বলতে চাও তুমি?

-বলছি এমন সাজ তোমায় মানায় কি?বয়স নামে একটা বিষয় আছে তো।এই সাজ আর যাই হোক পঞ্চাশের মহিলাকে মানায় না।

মেয়ের রূঢ়তায় স্তম্ভিত হয়ে যায় পূরবী।আয়নার সামনে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়ে।একটা অদ্ভুত খারাপ লাগায় আয়নার দিকে চেয়ে থাকে।ঋতমার অসহ‍্য লাগে এসব।বাবা আজ তিন বছর ব‍্যাঙ্গালোরে পোস্টিং।আগে দিব্ব‍্যি মন খারাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াতো মিসেস পূরবী সরকার।রাতে খানিকটা ফ‍্যাঁচফ‍্যাঁচও করতো।এখন তো সব সময় হাসিখুশি আর উড়ুউড়ু ভাব।অসহ‍্য লাগে এসব। ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে গৌরীকে বললো,'কিছু খেতে দিবি?নাকি তাড়াতাড়ি এসেছি বলে কিছু দিবি না।'গৌরী হাঁ করে তাকিয়ে বলে,'যা বাব্বা আমি কি করলাম?হাত মুখ ধোও।স‍্যাণ্ডুচ দিচ্ছি।'ঋতমা গজগজ করতে করতে ফিরতেই গৌরী আগ্রহী।

-ও দিদি, মা এতো সেজে কোথায় যাচ্ছে গো?

-মার খাবি গৌরী,বেশী কৌতূহল তাই না?খেতে দে।

একচোট চেঁচিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।হাত,মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়।গৌরী খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে টেনে টেনে বলে,দিদি,খাবার...আর একটা কথা, মা কাঁদছে দেখে এলাম,তাই বলে গেলাম।বিরক্তিতে মাথা গরম হয়ে যায়।কি এমন বলেছে যে কান্নাকাটি শুরু করতে হলো।খাবার ফেলে সোজা মার ঘরে গিয়ে দেখে সেই আয়নার সামনেই মাথা নীচু করে বসে আছে।

-এসব কি শুরু করেছো মা?বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে।

নরম ধাতের মানুষ পূরবী। সারাজীবন বরের ধাতানি,কথার জ্বালা সহ‍্য করেছে।মেয়েও হয়েছে ঠিক বাপের মতো,পূরবীর কিছুই তারো পছন্দ নয়।এমনকি খেটেখুটে কিছু বানালেও নুন বেশী,ঝাল কম,কেন করতে যাও পারো না যখন?এসব শুনতে হয়।চোখের কোণ মুছে মেয়ের দিকে তাকান।

-রনঞ্জয়ের সাথে তোর ডিভোর্স কি জন‍্য হলো আমি কোনদিন জানতে চাইনি।গভীর রাত পর্যন্ত ফোনে কার সাথে বলিস তাও জানতে চাইনি।আগের অফিস কেন ছাড়লি?এই নতুন অফিসে মাইনে কত?রজত,প্রবীর এদের সাথে তোর সম্পর্ক কি? এমন হাজারটা প্রশ্ন আমার মনে আসে কিন্তু আমি প্রশ্নগুলো করিনা।আমার শিষ্টাচার আমায় বাধা দেয়।বড়ো হয়েছিস,উপার্জন করিস তাই মায়ের পক্ষে যা জানতে চাওয়া স্বাভাবিক সেই প্রশ্নটাও করিনা।এই যা যা কিছু তুই করিস সবটাই তোকে মানায় তমা?

ঋতমা ছটফট করে কিছু বলতে নিলে আঙুল তুলে চাপা স্বরে পূরবী বলে,'আমার কথা শেষ হয়নি।আমি জানি আমি সুন্দরী নই,আমায় এসব ভারী মালা,কানের দুল মানায় না।তবু আমি সেজেছি।আমাকে কেউ বাঁচতে শিখিয়েছে,ভালোবাসতে শিখিয়েছে।আমিও এখন ভালোবাসি।তাই আমি সেজেছি।অন‍্যদিনের মতো রাত আটটা,নটায় ফিরলে তুমি আমায় মলিন মুখে তিনশো টাকার নাইটিতেই দেখতে পেতে।'একটা গা শিরশিরে হাওয়া পড়ন্ত দুপুরকে আলসেমীতে ভরে দেয়।ঘরের পর্দা দুলে ওঠে।ঋতমা ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকায়।

-ভালবাসতে শিখিয়েছে মানে?

-মানে আমিও যে বেঁচে আছি এটা ভাবতে শিখিয়েছে।আমি তো এতদিন কোথাও ছিলাম না।কোথাও না।আজ আমিও আছি।আসলে কি জানো তোমার বাবাকে দোষ দেওয়াটা উচিৎ নয়।কোন মানুষ যখন নিজেই নিজেকে ছোট ভাবতে,হীন ভাবতে শুরু করে তখন আসলে তার আর কিছু থাকে না।এটা আমার জীবনে খুব ব‍্যতিক্রম কিছু তাও নয়।বহু মানুষ ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে এই ভাবেই বেঁচে আছে।নিজেকে ভালোবাসাটা খুব জরুরি।নিজেকে ভালোবাসলে প্রেম জন্মায় সহজ আনন্দে।

-কি আশ্চর্য নির্লজ্জতা তোমার।এই বয়েসে এসে এসব মেয়েকে বলছো!প্রেমে পড়েছো তুমি?

-তুমি ঠিক ভাবছো আমি নতুন করে প্রেমে পড়েছি।

এই বলে জোরে হেসে ওঠে পূরবী।হাসির শব্দে গৌরী রান্না ঘর থেকে দৌড়ে আসে।হাসিহাসি মুখে বলে,'কি হলো মা?তোমরা হাসছো কেন?'

-তোমরা?না রে গৌরী,তোর দিদি হাসছে না,আমি হাসছি।

-আচ্ছা মা তোমায় আজ সকালে কে ফোন করেছিলো গো?কর্তাবাবা?ঐ যে ফোনে তুমি বললে আই লাবুউ।

পূরবী আবার একচোট হেসে বললো-'আরে বাহ্,দারুণ কায়দায় দিদিকে জানিয়ে দিলি তো আমি আজ সকালে ফোনে প্রেম করছিলাম।দেখ তমা গৌরীও জানে আমার স্বাধীনতা ঠিক কতটুকু।দারুণ তাই না কিন্তু ও তোর বা তোর বাবার সীমা বোধহয় জানে না।'ঋতমা জ্বলে উঠলো।এতদূর,এতদূর এগিয়েছে মা।বাবার সামনে তো মুখে রা কাটে না।এমনকি কোনো কোনো দিন রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বাবাকে চাপা গলায় বলতে শুনেছে,'ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেছো তুমি।তোমার গায়ে এখন শীতের গন্ধ।অসহ‍্য শীত।'তাহলে এই বয়সে এই আধবুড়িকে কে এতো ভালোবাসা দেখালো?চিৎকার করে গৌরীকে ঘর থেকে বের করে দিয়েই মার উপর ফেটে পড়ে।

-নির্লজ্জতা এতো দূর মা।তোমার লজ্জা করে না ।দাঁড়াও আমি এখনি বাবাকে ফোন করছি।

পূরবী খুব শান্ত গলায় বলে,'তোমার বাবা তোমার মতোই খুব সুন্দর।আমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেনি সে,পছন্দ করেছে আবার বাবার টাকাকে।এই যে এতো বড়ো বাড়ি,গাড়ি তা কেবল একটা সাধারণ আয়ূর্বেদিক ওষুধ কোম্পানীর এরিয়া ম‍্যানেজারের পয়সায় হয়নি,এটুকু বোঝার জ্ঞান তোমার আছে নিশ্চই।তোমার বাবার একাধিক রিলেশানে জড়িয়ে পড়ার গুণটাও তুমি পেয়েছো।আমি শুধু চুপ করে থেকেছি।তোমাদের নির্লজ্জতার সীমা আমি কোনদিনই দেখি নি।তাই আমি তোমাকে কোনো উত্তর দিতে বাধ‍্য নই।তোমরা বোধহয় ভুলে গেছ স্বাধীনতা আমারো আছে।আমি তোমাদের কেনা বাঁদী নই।রক্ত মাংসের মানুষ।'

জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো কুঁকড়ে যায় ঋতমা।সত‍্যিই সে বাবার মতো।সত‍্যিই তো মার মতো নয়।বারবার পুরুষ আসে তাকে নিংড়ায় আর ছিবড়ে করে ফেলে চলে যায়।মাকে অবহেলিত দেখতেই অভ‍্যস্ত সে।পার্টিতে গেলে এককোণে মা জড়োসড়ো হয়ে থেকেছে,আর বাবার হাত একের পর এক নারী শরীর জড়িয়েছে।ঠাকুর দেখতে গেলে ঋতমার হাত ধরে বাবা হেঁটেছে,মা পেছনে একা।তাই কি মার খুশি,ভালো থাকা মানতে পারছে না?পূরবী মেয়েকে দেখে স্হির চোখে।

-আমি ছোটবেলায় তোমায় আবৃত্তি শেখাতাম মনে আছে?ক্লাস এইট পর্যন্ত প্রাইজ পেয়েছো।তারপর তোমার হঠাৎ মনে হলো আবৃত্তি বড্ডো এলেবেলে জিনিস,তোমার বাবাই বুঝিয়েছিলো সম্ভবতঃ।আসলে আমার আবৃত্তি করাটা সেই বন্ধ করে দিয়েছিলো বিয়ের পর।পাড়ায় আত্মীয় স্বজন মহলে আমার সুনাম তার ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছিল ক্রমশ।সোজা সাপটা দাবী ছিল তোমার বাবার,সংসার,রান্নাঘর এই চৌহদ্দি ছেড়ে বেরোনো যাবে না।সাধারণ মেয়ে আমি।হাজারটা গৃহবধূর মতো সংসারে জড়িয়ে থাকা প্রাণী।আমার বাবা মাও চিরকাল প্রাচীন ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে মুক্তির পথ দেখায় নি।বলেছিলাম,আমার ও বাড়িতে কোন স্বাধীনতা নেই বাবা।আমায় ভীষণ ভীষণ অপমানিত হতে হয় প্রতি পদে।মা বাবা পরিস্কার বলে দিয়েছিল,সম্মান নিজেকেই অর্জন করে নিতে হয় সে দায় নাকি আমার।বুঝেছিলাম আমিও আসলে দায় ছিলাম।বিয়ে দিয়ে ঝাড়া হাত পা হয়েছিল মা বাবা।

-নিজের বাবা মার বদনাম করছো?একটু আগে না নিজের শিক্ষার বড়াই করছিলে।

-একথা তোমার মুখে ভালো শোনায় না তমা।আমি মা বাবাকে কোনদিন অসম্মান করিনি।আজ আমার দুঃখটা কেবল জানিয়েছি।

-কিসের দুঃখ তোমার?খাওয়া পরার কোন অভাব তো নেই।

-এটুকুই বুঝি সব!আত্মসম্মান বোধ,ভালো থাকা কেবল এই দুই পেলেই তৃপ্ত হয়?আমার ভেতরেও  আকাঙ্খা আছে স্বাধীনতার,উড়ে যাবার।একথা তোমরা কোনদিন বোঝোনি।আজ সে কথা একজন আমাকে বুঝিয়েছে।আজ আমি তোমাদের চোখ রাঙানি,উপেক্ষা কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করি না।

-মা,সত‍্যিই তুমি প্রেমে পড়েছো?নতুন করে ঘর বাঁধবে নাকি?

ব‍্যঙ্গের মধ‍্যেও হঠাৎ অসহায় শোনায় ঋতমার গলা।আবার হেসে ওঠে পূরবী।হাসতে হাসতে বলে,'প্রেমে পড়লেও নতুন করে সংসার পাতার ইচ্ছে আমার নেই তমা।'একটু থেমে খুব মিষ্টি করে বলে,'আমি আবার আবৃত্তি করছি। বাবাকে ফোন করলে এই কথাটা বলো।আমার ছোটবেলার বান্ধবী যার সঙ্গে একই সাথে আবৃত্তি শিখতাম সে এখন অনেক বড় শিল্পী।নতুন করে তার সাথে যোগাযোগ হতেই আমার জীবনে সব ফিরে এসেছে।

-কে?কার কথা বলছো?

-অরুণা সেন।

-কি উনি তোমার বন্ধু!

-তাহলে এবার তোমার প্রশ্নের উত্তর পেলে?আমি কাকে ভালোবাসি?হুম্?আমি ভালোবাসি নিজেকে।এই স্বাধীনতার কিছুটা রং এখনো আমার আছে।সবটাই শেষ হয়ে যায়নি।এবার আসি!সাতটায় ফিরবো।নন্দনে আমার আবৃত্তির একটা অনুষ্ঠান আছে।কিছু লাগলে গৌরীকে বলো।

গেট খুলে যে মহিলা খোঁপায় সাদা বেলফুলের মালা জড়িয়ে,হাতে কানে ঢোকরার গয়না আর খয়েরী শাড়ি পরে বেরিয়ে গেলো সে কে?ঋতমার মা?নাকি অন‍্য কেউ?এতো সুন্দর লাগছে পূরবীকে যে ঋতমা অবাক হয়ে যায়।স্বাধীনতা মানুষকে অনেকখানি সুন্দর করে দেয় তাই না!








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন