শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

সুবীর সরকার

                             


  
গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া


 

আর সেই নদী গঙ্গাধরের চরে চরে হাঁটতে হাঁটতে কত কত ভাবনাই যে ভাবতে হয়!ভাবনা স্থির থাকে না।সে একরকমভাবে শুরু হয়।আর গতিপথ বদলাতে বদলাতে চিরনুতনের দিকে চলে যেতে থাকে।ইয়াকুব ব্যাপারীর দুই চোখে আকাশের নীল ছায়া ফেলে।বালুবাড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইয়াকুব খুব পুরোন কোন এককালে শোনা একটা গানকে নিজের খুব গহিনে টেনে নিতে থাকে_

‘মন মোর কান্দেরে

গঙ্গাধরের ওই ভাঙনি রে দেখিয়া’

এই গান থেকে কি তীব্র এক বাইস্যাকালের ছবি উঠে আসে।নদীপাড়ের মানুষের যাপনের দুঃখ,যন্ত্রণার ছবি ক্রমে বিচুর্ণ হয়ে উঠতে থাকলে ইয়াকুব ব্যাপারির মনে পরে ছত্রশালের হাটে আলাউদ্দিন এমেলের ভোটের জুলুসের কথা!সে এক মজার নির্বাচনী সভা।ইয়াকুব ভাবে,এ কেমন ভোটের মিটিং!কেননা আলাউদ্দিন এমেলের মিটিঙে তো কোন ভাষণ থাকে না।বাইরে থেকে আসা কোন নেতার ঘর তো সেই সভায় থাকে না!থাকে খালি গান আর গান।ঢোল আর বাঁশি।আলাউদ্দিন মাস্টার নাকি আলাউদ্দিন এমেলে নাকি আলাউদ্দিন গিদাল হাতে দোতরা নিয়ে;দোতরা বাজাতে বাজাতে কোমরে নাচ নিয়ে গাইতে থাকেন গানের পর গান।লোকগান।মাটি ছুঁয়ে বেঁচেবর্তে থাকা সহজ সরল মানুষের প্রানের গান।জীবনের গান।মানুষ ঘিরে ধরে এক ভোটের নাকি গানের মিটিং!আর ভোটের পরে দেখা যায় আলাউদ্দিন এমেলে এক্কেবারেই পাশ।কি আজব কিসিমের মানুষ ছিলেন এই আলাউদ্দিন মাস্টার!সারাজীবন লোকগান আর মানুষের ছায়ায় ছায়ায় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি তার জীবন।লিখেছেন গানের পর গান।গঙ্গাধরের চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইয়াকুব আচমকা উদাস হয়ে যান।তার চোখ জুড়ে জলের মত কিছু একটা বুঝি আসতে চায়!আর চরের উত্তর শিথান থেকে ভেসে আসে আলাউদ্দিন গিদালের গানের সুর_

‘হাত্তি মার্কা কেরাসিন তেল

কায় বা আইনছেন দ্যাশতে

বাপ রে বাপ মাও রে মাও

মোর গাও ঝমঝম করে রে’

বিকেল ক্রমে ঘন হতে থাকে।আর গান গড়াতেই থাকে।





২।

শেষ বিকেলে জমে ওঠা তামারহাটের মস্ত ভিড়ের মধ্যে নেমে যেতে যেতে মহিউদ্দিন ওস্তাদের মনে পড়ে যায় গৌরীপুরের সাচি পান আর গোলকগঞ্জের গুয়ার কথা।তার জিভে আটকে থাকা সেই পান আর গুয়ার স্বাদের আহ্লাদ তাকে বিমনা করে তোলে।তার শরীর জুড়ে কেমন এক নাচের ছন্দ চলে আসে।সে হাটের ভেতর নিজেকে ছড়িয়ে দিতে দিতে কন্ঠে গান নিয়ে দু’চার পাক নেচেই ওঠে!হাটের মানুষ তার গান শোনে,শুনতেই থাকে;হাটের ব্যাপ্ততা হাটের ব্যাস্ততায় নুতন এক হাট জেগে উঠতে থাকে।হাট বুঝি গানের হাট কিংবা নাচের হাট হয়ে ওঠে!মহিউদ্দিন মাস্টার তকন গেয়েই চলেছেন গঞ্জহাটজনপদের খুব গহন থেকে উঠে আসা গান_

‘ও কি বাপ রে বাপ

ও কি হায় রে হায়

এল্যা কেনে আসিলুং মুই গৌরীপুরের হাট’

তখন হাটের চারদিক থেকে গোয়ালপাড়ার উন্মাদ করে দেয়া কাঠিঢোল বাজতে থাকে।সারিন্দা বাজাতে বাজাতে দীননাথ বর্মণ তার বাবড়ি ছাটা চুলের আন্দোলনে হাটের মধ্যে নুতন এক রঙ্গিলা হাট জাগিয়ে তুলতে থাকে।ধনকান্ত বড়ুয়া তার বাঁশিতে সাজিয়ে দিতে থাকেন অদ্ভূত এক ম্যাজিক।এক মায়া থেকে আমরা দেখি জীবন জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকা মায়াসমুদ্র।মহিউদ্দিন গানে গানে তার জীবনকে কিছুটা বুঝি গঞ্জ আর হাটের ঢলেই বিছিয়ে দিতে থাকে,কেননা এ ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই।নিয়ন্ত্রণহীন পরিসরে একটা অবসাদের বিলাপের বিষণ্ণতার গোলকধাঁধায় মহিউদ্দিন তার সমস্ত গান,নাচ,সঙ্গীসাথী নিয়ে ক্রমে প্রবেশ করতে থাকে।

এই পর্বে আমরা কিন্তু ইয়াকুব ব্যাপারিকেও দেখে ফেলি।কেননা,ইয়াকুব তখন হন্তদন্ত প্রবেশ করতে চাইছেন মহিউদ্দিন ওস্তাদের গানের ভুবন আর তামারহাটের গানবৃত্তান্তের খুব খুব ভেতরেই!





(ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন