প্রশ্নচিহ্ন
আজ শ্বশুরমশাইয়ের বাৎসরিক শ্রাদ্ধ।অনেক কথাই রত্নার মনে পড়ছে।শ্বশুরমশাই রত্নাকে খুব ভাল বাসতেন।মজার ব্যাপার,শাশুড়ীমা বড় ছেলে,বড় বৌমা ও বড় নাতনীকে বেশি ভালবাসতেন আর শ্বশুরমশাই ছোট ছেলে,ছোট বৌমা মানে রত্না ও ছোট নাতনীকে বেশি ভালবাসতেন।রত্নার মেয়ে ছোট্ট থেকে দাদুর গায়ে ঠেসান দিয়ে বসে দাদুর বাঘ মারার গল্প শুনত।আরব্যরজনীর ছবি দেখে পাতা খুলে দিত দাদুকে পড়ার জন্য।তখনো কথা বলতে শেখেনি।দাদু পড়ে শোনাতেন।
সেদিন রত্না মেয়েকে এক ঘা মেরেছিল বলে শ্বশুরমশাই খুব বকেছিলেন।রত্না রাগ করে বাপের বাড়ী চলে গিয়েছিল মেয়েকে নিয়ে।এদিকে রত্নাকে বকাবকি করে শ্বশুরমশাইয়েরও খুব খারাপ লেগেছিল।উনিও খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন।পরদিন রত্না ফোনে জানতে পারে উনি খুব অসুস্থ। তীব্র মাথার যন্ত্রণা। লোকাল ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন কিন্তু পুরো সারছে না।বিকাল থেকে ওনার কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে,কি বলছেন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।পরদিন সকাল থেকে উনি আর একদমই কথা বলতে পারছেন না।রত্না বিকালবেলা শ্বশুরমশাইকে দেখতে এল।উনি সোফায় বসেছিলেন,একবার উঠে টটয়লেট গেলেন কিন্তু কথা বলছেন না।রত্নার ভাল লাগলো না,ঠিক করল, পরদিনই জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে আসবে।শ্বশুরমশাইকে প্রণাম করতেই উনি মাথায় হাত রেখে বললেন,'ভাল থেকো, সাবধানে থেকো '।সবাই অবাক।ওটাই ওনার শেষ কথা,আর কোনো কথা উনি বলেননি।
পরদিন রত্না ফিরে এল।এসে দেখল,শ্বশুরমশাইয়ের অবস্থা আগের দিনের থেকে অনেকটা খারাপ।শহরের সব থেকে নাম করা ডাক্তার ডাকা হলে উনি জানালেন ওনার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে এবং জিভটা প্যারালাইসিস হয়ে গেছে,তাই কথা বলতে পারছেন না। এক্ষুনি কোনো নার্সিংহোমে ভর্তি করা দরকার।ছোট ছেলে হতবুদ্ধি, কিছু ভাবতে পারছে না।দাদা উত্তর বঙ্গে থাকেন।রত্না হাল ধরল। দাদাকে ফোন করল,কলকাতায় পরিচিত এক নার্সিংহোমে ফোন করে,নিজের ভাইদের ফোন করে সব জানাল। অ্যামবুলেন্স এলে,রত্নার ভাইয়েরা এসে ওর শ্বশুর-শাশুড়ী ও স্বামীকে নিয়ে রওনা হল।
নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়ে, রত্নার স্বামী ফোন করে সব জানিয়েছে।দাদা এসে পৌঁছে গেছেন ওখানে।শ্বশুর মশাইয়ের স্ক্যান করা হয়েছে।রিপোর্ট দেখে ডাক্তার রাত ৯টায় অপারেশন করবেন বলে জানিয়েছেন।
রত্না ওর মেয়ে,বড় জা তার মেয়ে,ননদ ও তার ছেলে বাড়ীতে রয়েছে।বাচ্চারা সবাই ছোট। সবাই ওরা একসঙ্গে ঘরে সোফায় বসে কথা বলছিল,কারো মন ভাল নেই।রাত ৮.৩০ বাজলে রত্না উঠে গিয়ে মেয়ের দুধ-রুটি নিয়ে এল।মেয়েটা খেতে বড় দেরী করে।খানিক পরে ওর ননদ আর জা বাচ্চাদের নিয়ে রত্নার ঘরে গিয়ে শুয়ে শুয়ে কথা বলতে লাগলো, আবছা শোনা যাচ্ছে।একটা ঘর পরে রত্নার ঘর।লোডশেডিং চলছে।বাড়ীর ইনভার্টারের ব্যাটারীগুলো অর্ডার দেওয়া হয়েছে,এখনো আসে নি।কোনোক্রমে একটা আলোই জ্বলছে ড্রয়িংরুমে টিমটিম করে।রত্না খাওয়াচ্ছে মেয়েকে।ঘরের দরজাটা খুললেই উঠোন।দরজার ওপর-নীচ চারটে পাল্লা,গরাদ দেওয়া জানালার মত।ওপরের দুটো পাল্লা খোলা আছে।সেখান দিয়ে ঘরের আলো উঠোনে গিয়ে পড়ছে অল্প একটু জায়গা জুড়ে।আকাশে চাঁদ ছিল না,দুদিন পরেই অমাবস্যা, তাই উঠোনে যেটুকু ঘরের ক্ষীণ আলো পড়েছিল,বাকীটা অন্ধকার। এক গা ছমছম করা দৃশ্য।
রত্না ভাবছে,বাবার অপারেশন শুরু হবে এইবার।তারপর হঠাৎই ঘরে যেন এক হিমেল হাওয়ার স্রোত বইতে লাগলো,গা শিরশিরানি ঠাণ্ডা। রত্না যেন কেমনই হয়ে গেল।হাতে দুধ-রুটির বাটি নিয়ে বসে আছে,মেয়ের মুখে দিচ্ছে না,মেয়েও চুপ করে বসে আছে টুঁ শব্দটি নেই।রত্নার মনে হচ্ছে পৃথিবীর কোনো নির্জন হিমশীতল কোণে রয়েছে সে,সারা পৃথিবীতে বুঝি জনমানব নেই,কেউ কোথাও নেই।তার সারা শরীর ভারী হয়ে উঠল,নড়াচড়ার ক্ষমতাও সে হারিয়ে ফেলল।এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর কিছুটা যেন সম্বিত ফিরে পেল সে।কানে এল,ঘরের পিছনে দালানে রাখা শ্বশুর মশাইয়ের প্রিয় সাইকেলে একটা খুটখাট মৃদু আওয়াজ।
এবার একটু জোর সঞ্চয় করে রত্না ক্ষীণ করে ডেকে ওঠে।ওরা কি হয়েছে,কি হয়েছে করে রত্নার কাছে আসে।রত্না ওদের কাছে থাকতে বলে। খানিক পরে সামনের বাড়ীর বৌদি এসে খবর দিলেন,রাত ৯টায় অপারেশনের সব ব্যবস্থা করে OT তে নিয়ে যাবার সময় তার শ্বশুর মশাই মারা গেছেন।ওনার বাড়ী ফোন করে সবাইকে একটু সামলাবার জন্য ওর স্বামী বৌদিকে অনুরোধ করেছেন। রত্নার শ্বশুর মশাই সারাদিন ঐ drawing room এ ঠিক যেখানে রত্না বসেছিল সোফায়,ঐ জায়গায় বসে কাগজ পড়তেন,TV দেখতেন।এই ঘটনার পর অন্ধকার হলে রত্না এক মূহুর্ত একা থাকতে পারত না।এটা কাটতে রত্নার প্রায় বছর কেটে গিয়েছিল।এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।কেউ কেউ শুনে নানারকম আধিভৌতিক, আজগুবি সব কথা বলেছেন,রত্নার এসবে একদম বিশ্বাস নেই কিন্তু যেহেতু নিজের জীবনের ঘটনা তাই রত্না ঠিক বুঝে উঠতে পারে না,একটা দোটানায় থাকে।বিশ্বাস করতে মন চায় না,অবিশ্বাস ও করতে পারে না।সেদিন তাহলে কি হয়েছিল? আজও তার মনে এটা এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন