বুধবার, ১৪ জুন, ২০১৭

পার্থ সিংহ



অন্ধকারের উৎস হতে উৎস হতে উৎসারিত আলো
 


রেলের লাইনের ধারে অন্ধকার ঝুপড়িতে তীব্র কটু গন্ধ আর অশ্রাব্য গালিগালাজ যুবক থেকে বৃদ্ধ, কুলি থেকে কনস্টেবল মাথা নিচু করে ঝুপড়িতে ঢুকছে সুতীব্র নেশার টানে, কিছুক্ষন পরে গলায় বুকে জ্বলুনি সুখের আবেশে বিভোর হয়ে বেরিয়ে আসছে মাত্র ৪০ টাকায় এত্ত সুখ! সুখের পসার সাজিয়ে বসেছে কালো মেয়ে সন্ধ্যা হতে মাঝ রাত পেরিয়ে কখন ভোরের পাখি ডেকে ওঠে খেয়াল থাকে না, খদ্দেরদের সামলাতে হিমশিম অবস্থা ছেড়া কাপড়ের ব্যাগ ভরে ওঠে গান্ধী ছাপ নোটে টাকা গুনে গুছিয়ে ঘুম চোখে বাড়ি ফিরে যখন বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা ছুড়ে দেয় তখন আর সবাই জেগে ওঠে সেই তরুনী বয়েস থেকে মায়ের হাত ধরে রাণাঘাট রেল স্টেশনের কাছেই রেলের লাইনের পাশে বেআইনী চুল্লু বিক্রির ব্যাবসায় হাত পাকিয়েছিল তাপসী মন্ডল ভেবেছিল বিয়ের পরে আর করতে হবে না এই কাজ, কিন্তু তিন ছেলে-মেয়েকে বড় করার ঝক্কি রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে খাটা স্বামীর রোজগারে সম্ভব নয় বুঝেই রাতের ব্যাবসাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছে সে কিন্তু প্রতিনিয়ত অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খায়, নিত্য গঞ্জনা তার সঙ্গী আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী সবাই তাকে নিচু চোখে দেখে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ওদের সহপাঠীরা ক্ষেপায় 'চুল্লু বেচীর বাচ্ছা' বলে বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে উঠতে বসতে কথা শুনতে হয় মেয়েকে সন্তানরা মাকে জড়িয়ে কাঁদে, বলে মা এই ব্যাবসা ছেড়ে অন্য কিছু করো কিন্তু হায় তাপসী অসহায় এই অন্ধকার থেকে আলোর দিশা খুঁজে পায়না কিছুতেই সন্তানদের সে বোঝাতে পারেনা কিছুতেই এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোবার রাস্তা নেই!
হঠাৎ একদিন তাপসীর বাড়িতে হাজির কিছু তরতাজা যুবক যুবতী তারা পরিচয় দেয় নিজেদের 'মর্য্যাদা সুরক্ষা আন্দোলন'-এর কর্মী বলে এই কর্মীরা মানুষের মর্য্যাদা রক্ষায় সাহায্য করে এরাই প্রথম তাপসীকে বিকল্প পেশার স্বপ্ন দেখায় তাপসী প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি এও কি সম্ভব? তার এই ৪৫ বছরের জীবনে আজ পর্যন্ত কেউ তাকে সুস্থ সুন্দর জীবনে ফেরার হদিশ দেয়নি, কিন্তু এই ছেলে-মেয়েগুলি তাকে সাহায্য করবে বলছে নিস্বার্থে! দুরুদুরু বুকে স্বপ্ন দেখে সে আগামীদিনের হ্যাঁ এর পরের কাহিনী সিনেমার চিত্রনাট্যের মতোই, এক স্বপ্ন উড়ানের 'মর্য্যাদা সুরক্ষা আন্দোলন'-এর হাত ধরে তাপসী পৌঁছে যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনগ্রসর কল্যান দফতরের অধীন এথনিক বিউটি কেয়ার সেণ্টারে সেখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সে শেহনাজ হুসেইন এর সংস্থার তত্ত্বাবধানে রূপচর্চার প্রশিক্ষণ নেয় হাতেকলমে প্রশিক্ষণ শেষে হাতে পায় শংসাপত্র এরপর অনগ্রসর কল্যান দফতরের তৎকালীন মন্ত্রী উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ তপশিলী জাতি উপজাতি বিত্ত উন্নয়ন নিগমের থেকে ঋণ নিয়ে নিজের বাড়িতেই খুলে ফেলে আস্ত একটি বিউটি পার্লার! দেখতে দেখতে তাপসীর নতুন ব্যাবসা জমে ওঠে, লাভের টাকায় ঋণ পরিশোধ করে আজ সে মেরুদণ্ড সোজা করে সম্মানের সঙ্গে ব্যাবসা করছে শুধু তাই নয় বেকার যুবতীদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরও আয়ের দিশা দেখাচ্ছে রানাঘাটের তাপসী যেন আক্ষরিক অর্থেই দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি মুনির উত্তরনের গল্প কিন্তু না, তাপসী মন্ডলের এই জীবন কাহিনী গল্প নয়, বাস্তব সত্য

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন