বুধবার, ১৪ জুন, ২০১৭

অণুশ্রী ভট্টাচার্য্য মুখার্জী


মালিনী আন্টি 


প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেছে নাগের বাজারে একটা কফি শপে ,আমি অরুনের জন্যে অপেক্ষা করছি ,বরাবরের মতো অরুণ লেট,এখানে চুপ করে বসে থাকা যায় না ,একটা কফির অর্ডার ইচ্ছে না হলেও   দিতেই হলো  ..... আজ মন টা ঠিক ভালো নেই ,মালিনী আন্টির কথা আরও বেশী করে যেনো আমার এই সময় মনে পড়তে লাগলো 

মালিনী আন্টি  ..অদ্ভুত একজন মহিলা .. তার সাথে পরিচয় থেকে এই অবধি একটা উপন্যাস হয়ে যায় .. ভনিতা না করে আসি আসল কথায় ..

প্রায় দু আড়াই বছর আগে ,বাসে উঠেছি ,জানলার ধারে বসে আছি ,কিছুক্ষণ পরেই একজন মহিলা উঠলেন ,আমি কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছিলাম ,ভদ্রমহিলা আমার পাশে এসে বসলেন ,আমি আড়চোখে এক ঝলক তাকে দেখে আমি জানলার ধারে আরও একটু বেশী সরে যাই ,খুশি হয়ে যে সরে গিয়েছিলাম তা  নয় ,কোনো উপায় ছিলো না ,এই আমরা যারা প্রতিদিন ভালো কি মন্দ সব ঘটনার  সবসময় সমলোচনা করতে ব্যাস্ত থাকি ,ফেসবুকে নিজেদের কমেন্ট রাখি তারা মাঝে মাঝে ,বাস্তবের মুখোমুখি হলে তখনই আসলে নিজেদের চিনতে পারি ,ঠিক যেমন আমি সেদিন নিজেকে চিনেছিলাম ....

সেদিন আমার পাশে বসা ভদ্রমহিলা ছিলেন মুন্ডিত মস্তক ,মানে মাথায় চুল নেই .. সাধারণত এরকম কোনো মহিলা কে দেখলে যেটা মনে হয় নিশ্চই তার কোনো অসুখ আছে ,কোনো ছোঁয়াচে রোগ হতে পারে ,না হলে কোনো মহিলা এভাবে কখনই সব চুল কেটে ফেলতে পারেনা ,আর যেটা মনে হয় সেটা হয় নিশ্চই এর ক্যান্সার হয়েছে !!!!! ক্যান্সার একটা ভয়াবহ শব্দ ,মনে এলেই ঘেন্না ,ভয় নানান অস্বাভাবিক জিনিস মাথায় আসে .. যাই হোক সেই মুহূর্তে সহানুভূতির থেকে সতর্কতার দৃষ্টিভঙ্গী কাজ করছিলো ..... আমি জানলার দিকে চেপে বসতেই ,ভদ্রমহিলা বললেন -তুমি ইন্দ্রাণী না ??

-আমি বেশ চমকে গেলাম 


-হ্যাঁ মানে আপনাকে ঠিক তো ..


-তুমি বাবাই ' মামাতো বোন তো ?তোমার পিসির বাড়ির পূজোতে দেখা হয়েছিল ,আমি ওদের পাশের বাড়ি থাকি ,তুমি সেই আমাকে দেশলাই এনে দিলে ,আমি প্রদীপ জ্বালাতে পারছিলাম না .....


- আপনি মালিনী আন্টি ,আমি ঠিক বুঝতে পারেননি,কেমন আছেন ?আর আপনার মেয়ে ?


-উঁনি মাথা নিচু করে স্মিত হাসি হেসে বললেন -


-তোমার মা কেমন আছেন ?পিসির বাড়ি এলে এসো পারলে মা কে নিয়ে ..


আমি দেখলাম যে আমি একটু বোকা বোকা কথা বলেছি ,উঁনি নিজে এতো অসুস্থ আর আমি জিজ্ঞাসা করছি কেমন আছে ,,প্রসঙ্গত,উঁনি মানে মালিনী আন্টি আমার পিসির বাড়ির পাশেই থাকেন ,সেইবার সত্য নারায়ণ পুজোর সময় দেখা হয়েছিলো কিন্তু তখন ওনার ছোটো চুল ছিলো ,শুনেছিলাম ওনার মেয়ে অসুস্থ ,, মেয়ের নামেই পুজো দিতে এসে ছিলেন ,যাইহোক দেখলাম বাস টা জ্যামে আটকে আছে আর আমার গন্তব্যে সামনেই তাই ভাবলাম এটা কে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগাই ..

-আমি নেমে যাই আন্টি ,জ্যামে যতক্ষণ বাস আটকে থাকবে ততক্ষণে আমি পৌঁছে যাবো ..


- ,বাস আর কতক্ষণ আটকে থাকবে ,শুধু শুধু হাঁটবে ?


-নানা আন্টি,এইটুকুই তো রাস্তা ,আমার কোনো অসুবিধা হবে না ,আসছি আন্টি ,বাই ..


-আচ্ছা এসো ,ভালো থেকো ..


আমি সেদিন নেমে যাই বাস থেকে,মালিনী আন্টির কথা ভেবে খারাপ লাগছিলো কিন্তু এই ব্যাস্ত শহর আমায় মালিনী আন্টি কে ভুলে যেতে বাধ্য করলো .....

প্রায় দুমাস পর একদিন সকালে হটাৎ বাবাইদার ফোন ,

-হ্যালো শোন ,এখুনি একটু আসতে পারবি ?আর শেষ রক্ষা হলো না রে ,মালিনী আন্টি বাড়িতেই আমি ,চলে আয় পারলে .....


আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি ,সাথে সাথে দৌড় লাগিয়ে ছিলাম ,খারাপ লাগছিলো এই ভেবে যে আর কখনো মালিনী আন্টির সাথে দেখা হবে না .....আমাদের বাড়ির থেকে পিসির বাড়ি বেশী দূর নয় ,তাই তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম .....

কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তা আমি স্বপ্নে ভাবতে পারিনি .....

মালিনী আন্টি তাঁর মেয়ের মৃতদেহের সামনে বসে আছে ,দেখলাম মৃতদেহটিও  মুন্ডিত মস্তক .. কিছু বুঝলাম না ,দাদাকে জিজ্ঞাসা করতেই হলো ..

-তুই যে বললি ,মালিনী আন্টি .. এতো ওনার মেয়ে !!!!!


-চুপ কর ,কি বলছিস ,ওনার মেয়ে অনেকদিন ধরেই তো ক্যান্সারে ভুগছিলো


-কিন্তু তাহলে ওনার চুল কেনো ছিলো না ?ওনার সাথে আমার কয়েক মাস আগে দেখা হলো তখনও উঁনি বললেন ,যে চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল থেকে ফিরছেন ,আমিতো তাই ভেবে ছিলাম যে উনিই  ..


-না ........আরে  উঁনি ওনার মেয়ের জন্যে হাসপাতালে গিয়েছিলেন ,আর ওই চুল ..


এরমধ্যেই হটাৎ করে দাদাকে কেউ একজন ডাকলো ,দাদা আর তখন কিছুই বলতে পারলো না ..

এরপর আমি প্রায়ই যেতাম মালিনী আন্টির বাড়ি ,কারণ মেয়ে মারা যাবার পর উঁনি প্রায় একা হয়ে গিয়েছিলেন ..একদিন আর কৌতুহল না চেপে রাখতে পেরে বললাম ..

-আন্টি ,তুমি এরকম থাকো কেনো ?তোমাকে যেদিন বাসে দেখেছিলাম ,আমি সেদিন  তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম ..


-কি ভেবে ছিলি আমার ক্যান্সার ?সবাই তাই ভাবে ,আসলে কি জানিস ?আমার মেয়েটা আর কতো বড়ো ছিল বল্ ?তোদের থেকেও কতো ছোটো ,কলেজে পড়তো ,সেই মেয়ের নিজের চুল নিয়ে ফ্যাশন কম ছিলো না ,আজ এই কাটিং তো কাল এই কাটিং ,তারপর বিভিন্ন রকম হেয়ার কালার ,কতো রকমের এক্সপেরিমেন্ট করতো ,কতো লম্বা চুল ছিলো জানিস ?কোমরের নীচ অবধি ,আমার কাছে খালি বকা খেতো ,বারবার বকা দিতাম ওকে ,বলতাম অতো সুন্দর চুলটা কে কেনো বারোটা বাজাচ্ছিস্??কিন্তু তখনও বুঝিনি ওর এই চুল আর থাকবেই না ,যখন ওর ব্লাড  ক্যান্সারের জন্যে কেমো নেওয়া শুরু হলো তখন থেকে ওর চুল আসতে আসতে উঠে যেতে লাগলো ,প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলো ,কিছু থেকে আয়নায় মুখ দেখতে চাইতো না ,একবার তো আয়না ভেঙেও ফেলেছিলো ,যে চুল ওর অতো প্রিয় সে চুল কে এইভাবে হারাবার যন্ত্রণা মেনে নিতে পারেনি ,তাই তখন আমি ওকে মানসিক ভাবে জোর দেওয়ার জন্যে ,আমিও চুল কেটে ফেলি ,ওর চুল যত ছোটো হতে লাগলো আমিও আমার চুল তত ছোটো করে ফেলতে লাগলাম ,এরপর একদিন ওর মাথাতে আর চুল থাকলো না সেদিন থেকে আমার সব চুল কেটে ফেললাম..... ,কি করে পারতাম বল্ ?মা হয়ে নিজের মেয়ের সামনে চুল বাঁধতে !! ওর শারীরিক যন্ত্রণা টা না পারি কিন্তু ওর মানষিক যন্ত্রণা টা একটু ভাগ করে নিতে চেয়ে ছিলাম ..... যখন পাঁচ বছর তখনই ওর বাবা মারা যায় ,আমি শশুর বাড়ি থেকে এই বাপরে বাড়িতে এসে উঠি ,আস্তে আস্তে আমার  বাবা মা মারা গেলেন ,তারপর আমরা মা মেয়ে একসাথে এই বাড়িতেই বেশ কাটাচ্ছিলাম দিনগুলো হটাৎ ওর ক্যান্সার ধরা পড়ায় সব শেষ হয়েগেলো আর আমি চিরতরে একা হয়েগেলাম ,আত্মীয় সজন তো কবেই সরে গিয়ে ছিলো কিন্তু তোর পিসি দের মতো ভালো  কিছু প্রতিবেশী পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য রে .....


আমি সব কথা শুনে বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলাম ,ভাবলাম কতো সহজেই আমরা দুই আর দুইয়ে চার করি ,কিন্তু কখনো ভেবেই দেখিনা যে দুই আর দুই পাশাপাশি রাখলে বাইশ হয় যেটা চার এর থেকে অনেক বেশী ,,আমিও সেদিন বাসে মালিনী আন্টি কে দেখে দুই আর দুই চার করেছিলাম কিন্তু আসল সত্যি টা আরও বড়ো কিছু ছিলো ,সেটা ভেবেই দেখিনি ,আসলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীটা অনেক সময় সংকীর্ণ হয়ে যায় তাই আমরা সঠিক জিনিসটা চোখ থাকলেও দেখতে পাইনা .....

সেদিন কথা বলার শেষে মালিনী আন্টি কে বলেছিলাম যে আমিও তো তোমার আর একটা মেয়ে সেই মেয়ের দায়িত্বই আজ পালন করার চেষ্টা করছি ..

মালিনী আন্টি কে দেখাশোনা করার জন্যে একজন বিশ্বস্ত  পরিচারিকা ঠিক করে 
দিয়েছিলাম ,আজ সকালে সেই খবর দিলো যে আন্টির একটা এট্যাক হয়েছে ,পিসতুতো দাদারা আরও প্রতিবেশী রা মিলে নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিয়েছে ,অবস্থা ভালো নয় ,আমি আমার বন্ধু 
অরুণকে মালিনী আন্টির কিছু রিপোর্ট এর কপি দিতে এসেছি  কারণ অরুনে' এক কাকা  বিখ্যাত এক  বেসরকারী হাসপাতালে একজন বড়ো কার্ডিওলজিস্ট ,উঁনি সব শুনে 
রিপোর্টগুলো চেয়ে পাঠিয়েছেন আর ,উঁনি সবরকম ভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন ,সেরকম হলে ওনার ওখানেই ভর্তি করে দেওয়া হবে ,মালিনী আন্টিকে ,কফি টাও শেষ হয়েগেছে ,কফিশপের কাঁচের দরজার ভেতর থেকে দেখতে পাচ্ছি অরুণ বাইক থেকে নামলো ,এখন তাড়াতাড়ি ওকে এই রিপোর্ট গুলো দিয়েই আবার মালিনী আন্টি কে দেখতে ছুটবো ,ভিসিটিং আওয়ার  আবার শেষ না হয়ে যায় .....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন