পাগল যে তুই, কন্ঠ ভরে
জানিয়ে দে তাই সাহস করে
-
প্রয়াত সাহিত্যিক নীলকন্ঠর একটি রম্য রচনা গ্রন্থে (নামটা
মনে নেই) শুরু করেছিলেন এই বাক্যটি দিয়ে –“ইতিহাসে অনেক পাগলের কথা আছে, কিন্তু
পাগলদের কোন ইতিহাস নেই । সত্যিই তো ইতিহাসে আমরা কত পাগলের কথাই না জেনেছি –বিত্তবান
পাগল, নিষ্ঠুর পাগল, দয়ালু পাগল, ধার্মিক পাগল, পন্ডিত পাগল আরো কত ধরণের ।
বিদ্বান ও জ্ঞানী সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলককে তো ইতিহাস ‘পাগলা রাজা’ বলেই দেগে
দিয়েছে । ইতিহাস তো সেদিনের ব্যাপার । ইতিহাস ছেড়ে পুরাণে উঁকি মারলেও তো পাগলের দেখা
মেলে মানে আমরা সে রকমই ভাবি । আমাদের বিশ্বাস মতে প্রাচীনতম বা আদি পাগল হলেন দেবাদিদেব মহাদেব, যিনি পাগলা ভোলা নামে অখুশি
হয়েছেন এমন কেউ বলেন না । একটা সিনেমার গান শুনেছিলাম – “আহা রে হৈমবতী শিবসোহাগী
রাজার নন্দিনী, তার কপালে পাগলা ভোলা লোকে কি কবে...”। লোকে তাঁকে পাগলা ভোলাই বলে আর সেই পাগলের মত স্বামী পাওয়ার
জন্য মেয়েরা শিবরাত্রী তে কত জল আর জল মেশানো দুধ ঢালে ‘পাগলা ভোলা পার করেগা’ বিশ্বাসে
!
একটা কৌতুকী শুনেছিলাম
ছেলেবেলায়,সেটা বলি
। প্রধাণমন্ত্রী নেহেরু গিয়েছেন রাচীর পাগলা গারদ পরিদর্শণে
। এক পাগল জিজ্ঞাসা করলো তুমি কে বাপু ? নেহেরু বললেন আমি প্রধাণমন্ত্রী জওহরলাল
নেহেরু । পাগলটা হেসে বললো,এখানে আসার আগে আমিও তাই বলতাম । দুদিন থাকো, ঠিক হয়ে যাবে । অমোঘ সত্য বলেছিল পাগলটি । পাগল না হয়ে ‘পাগলের মেলায়’দুদিন
থাকা কি চাট্টিখানি কথা !আমায় দে মা পাগল করে’বলে আমাদের কত আকুতি !স্বর্গ নাকি আমাদের পরম কাঙ্খিত
গন্তব্য, সেখানেও নাকি পাগলের মেলা, মানে মেলাই পাগল ! সেই যে পান্নালাল
ভট্টাচার্য গীত শ্যামা সঙ্গীত “স্বর্গেতে পাগলের মেলা, যেমন গুরু তেমনি চেলা” আমরা
শুনে আপ্লুত হই !
পাগলদের মহা
গুন যে তাদের পাগল বললে মোটেই রাগ করে না বরং উপেক্ষা, অবহেলার হাসি হাসে । মহা
বিজ্ঞানী নিউটন ছেলে বেলায় কত শুনেছেন পাগলা ছেলে পরিচয় । পাগলই তো ~ নাহলে গাছ
থেকে টুপ করে আপেল পড়তে দেখে কোথায় সেটা আগে খাবে, তা না করে দুনিয়ার ভাবনার জট
ছাড়াতে লাগলেন যে আপেলটা মাটিতে পড়লো কেন, শূন্যে ভেসে থাকলো না কেন ? আসলে
পাগলামি ছাড়া সর্বোচ্চ মেধা অর্জিত হয় না। বিজ্ঞান নাকি এমন কথাও বলেছে । বিশ্ব
বন্দিত মার্কিন সাহিত্যিক এডগার এলেন পো একবার বলেছিলেন ‘‘লোকে আমাকে পাগল বলে ৷ কিন্তু পাগলামিতেই বুদ্ধিবৃত্তির সবচেয়ে শিখরস্পর্শী অবস্থান নিহিত কিনা সেই প্রশ্নের এখনও সুরাহা হয়নি” ৷ আর সৃষ্টিছাড়া পাগলামির মধ্যেই চিত্রশিল্পী ভ্যানগখের সৃষ্টিশীলতা তাও
কারো অজানা নয় । বাঙালির ঘরের লোক ঋত্বিক ঘটক তো আছেনই । ভার্জিনিয়া উলফের মত
সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকও পাগল বলেই চিহ্নিত হয়েছিলেন। উলফের নিজের বয়ানে ‘‘আমি বিয়ে করে ফেললাম এবং আমার মাথায় যেন আতশবাজির আগুনের ফুলকি ফুটতে শুরু করল৷ পাগলামির অভিজ্ঞতাটা আসলেই ভয়াবহ ভীতিকর৷ কিন্তু, আমি এখনই খুঁজে পাই যে, আমি যা কিছু লিখেছি, যেসব নিয়ে লিখেছি তা ওই আগুনের লাভাতেই জন্ম নিয়েছিল” ৷ এমন সৃষ্টিশীল মানুষ শেষ পর্যন্ত পকেটে ভারি পাথর রেখে নদীতে ঝাঁপিয়ে
নিজেকে শেষ করেছিলেন । প্রতিভাই পাগলামি আর আমরা অ-পাগলরা ক্ষুধিত পাষাণের পাগলা
মেহের আলির ‘সব ঝুট হায়, তফাত যাও’ চিৎকার শুনে তফাতেই থাকি ।
বাঙালি বেশ
একটা প্রবাদ চালু করেছে অনেকদিন আগে থেকে ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়’ । যদিও ছাগল সব কিছু খায় না, বরং মানুষই ছাগল সহ সব
কিছু খায় । আর পাগলেরাও বেশি কথা মোটেই বলে না । মহা বিজ্ঞানী আত্মভোলা নিউটনের
কথাই বলি । এক রাত্রে বন্ধুকে তার বাড়িতে খাবার নিমন্ত্রণ করে ভুলে গেছেন । বন্ধু
যথা সময়ে এলেন, নিউটন গণিতের জটিল সূত্র সন্ধানে মগ্ন, কোন কথা নেই । বন্ধু ভাবলেন
টেবিলে রাখা খাবার প্লেটটি তার জন্য রাখা । তিনি কথা না বলে খেয়ে নিলেন । তারপর
নিউটন আত্ম নিমগ্নতা কাটিয়ে খালি প্লেটটা দেখে বললেন ভাগ্যিস তুমি এসেছ, নাহলে
বুঝতেই পারতাম না যে আমি এখনো খাইনি ।
বৃটিশ গণিত
বিজ্ঞানী অলিভার হেভিসাইডকে তাঁর বন্ধুরা পাগল আখ্যা দিয়েছিলেন । তিমি বড় বড়
গ্রানাইট পাথরখন্ড ঘরে ব্যবহার করতেন আসবাবপত্র হিসাবে । মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে স্কুলছুট স্ব-অর্জিত মেধা সম্পন্ন গণিত বিজ্ঞানী ‘পাগল’
হেভিসাইড ‘ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিসম’ বিষয়ে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন ।
রবীন্দ্রনাথ যতই
লিখে যান না কেন “পাগল শব্দটা আমাদের
কাছে ঘৃণার শব্দ নহে”। কারো কারো কাছে কিন্তু এটা ঘৃণার শব্দ, এমনই
মনে করেন তাঁরা । কোন রাজনীতিক নেতা-মন্ত্রীর ভাষণ শুনে তাকে
পাগল বললে কিন্তু আর রেহাই নেই । কিল চড় লাথি জুটলে তা হবে কম, মানহানির মামলাও
ঠুকে দিতে পারেন তাঁরা । পাগলদের কিন্তু পাগল বললে তারা তেড়ে মারতে আসে না । এই যে মাঝে মধ্যে দু একটা পাগল হাওড়া ব্রীজের টং’এ উঠে মজা পায় এই দেখে যে তার জন্যই
অ-পাগলদের কত হুলস্থুল , কত লোক ঘাড় উঁচু করে তার কান্ডকারখানা দেখছে । তো, সেই
লোকটা যদি বলে ব্রীজটা তৈরি করতে কত নাটবল্টু লেগেছে সেগুলো গুনে দেখার জন্যই ওপরে
উঠেছি, তাহলে ? মেহেনত করে উঠেছে যখন নেমেও তো আসতে পারে ! আচ্ছা, লোকটা যদি হাওড়া
ব্রীজের টং’এ উঠে আবার নেমে এসে অ-পাগল ট্রাফিক পুলিশ বা কোন লোককে সেলাম ঠুকে বলে
ওপরটা ঘুরে এলাম স্যার, অনেক অক্সিজেন নিলাম
! তাহলে ?
আমাদের রোজকার জীবন-ছন্দের বাইরে কারো যাপন
একটু অন্যরকম হলে কিংবা আমাদের স্থুল দৈনন্দিন চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের চৌহদ্দির
বাইরে গেলেই তাকে পাগল বলে দেগে দিই । শ্রী চৈতন্যদেবকে তো খ্যাপা বলেই আমরা ভক্তি
করি । ‘মেরেছো কলসির কাণা, তা বলে কি প্রেম দেবো না’ ? খ্যাপা ছাড়া কে কবে এমন কথা
বলতে পারে ? চৈতন্য দেব থেকে প্রেম বিলনো সবাইকেই খ্যাপা বলেই ভক্তি করি । আর পাগল
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব তো আছেনই । যশোর জেলার রাখাল বালক কানাই শেখ গরু চরাতে চরাতে
মুখে মুখে দেহতত্বের বাঁধতেন । পরিশীলিত অ-পাগল আমরা তাঁকে ‘পাগলা কানাই’ হিসাবেই
চিনলাম । কিংবা কালনার ভবেন্দ্রমোহন সাহা হয়ে গেলেন ‘ভবা পাগলা’ যার কৃষ্ণপ্রেম ও
শ্যামা বিষয়ক গান একালেও শহুরে শিল্পীরা গাইছেন ।
আবার সেই বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথকেই শিরোধার্য
করি । বলেছেন “প্রতিভা খ্যাপামির এক প্রকার বিকাশ কি না এ কথা লইয়া য়ুরোপে
বাদানুবাদ চলিতেছে–কিন্তু আমরা এ কথা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত
হইনা। প্রতিভা খ্যাপামি বৈকি, তাহা নিয়মের ব্যতিক্রম, তাহা উলট
পালট করিতেই আসে–তাহা আজিকার এই খাপছাড়া সৃষ্টিছাড়া দিনের
মতো হঠাৎ আসিয়া যত কাজের লোকের কাজ নষ্ট করিয়া দিয়া যায়–কেহ বা
তাহাকে গালি পাড়িতে থাকে, কেহ বা তাহাকে লইয়া নাচিয়া -
কুঁদিয়া অস্থির হইয়া উঠে”।
রবীন্দ্রনাথকে সাক্ষ্য মেনে অ-পাগল আমার একটা চাওয়াও জানিয়ে রাখি । আমরা
অপাগলরা তো ক্রমেই পৃথিবীটাকে আর বাসযোগ্য রাখছি না । ‘পাগলা দাশু’রা নেই, আমরা
বিপন্ন শৈশব বলে হাহাকার করছি । আর কোন ‘পাগল ঠাকুর’ রামকৃষ্ণ, ‘ভবা পাগলা’ কিংবা
‘পাগলা কানাই’রাও নেই । আমরা বরং এই চাওয়াটাকেই জানিয়ে দিই যে স্বর্গের মত মর্তেও
পাগলের মেলা বসুক আর আমরা ‘পাগল ভালো করো মা’ না বলে বলি ‘পাগল যে তুই, কন্ঠ ভরে
জানিয়ে দে তাই সাহস করে’ ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন