জয় মাতা দি
ভারী মন নিয়ে পাঞ্জাবের হোটেল থেকে চেক আউট করেছিলাম। কোনও জায়গার সাথে
এত্ত অল্প সময়ে নাড়ি নক্ষত্রের টান গড়ে ওঠা সম্ভবপর না হলেও চিনচিনে বুক নিয়ে
অমৃতসর স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা শুরু হল। শুনলাম পায়ে কোমরে প্রচণ্ড ব্যথার
জন্য সেই ট্রেন গজগমনে আসছেন। অগত্যা স্টেশন চত্বরে ফটফটে আকাশের তলায় হাত পা
ছড়িয়ে চাঁদের হাট বসল। চাঁদের হাট সহযাত্রীদের ক্লান্তি, বিরক্তিভরা কোঁচকানো
ভ্রুর সাথে উড়ে আসা ব্যঙ্গবাণে মাছের হাটে অচিরেই পরিণত হল। বেশ মালুম পেলাম রাতটি
আক্ষরিক অর্থে ‘কোজাগরী’ হয়ে উঠতে চলেছে। এরপর গজেন্দ্রগামিনীর দেখা মিলল।
‘জলদি’,’ইধার আও’, ‘উপর মে সিট হ্যায়’, ‘তাড়াতাড়ি আয়’—ইত্যাদি শব্দের মিছিল পেরিয়ে
নিজ নিজ বার্থ দখল করতেই গাইডকাকুর নির্দেশ –“যা পারেন তিন চার ঘন্টা ঘুমিয়ে নিন।“
অর্থাৎ আমার আশেপাশের বার্থের হিন্দীভাষীদের নিয়ে গবেষণা করার মত সময় নেই।
সুতরাং...।
অমৃতসর থেকে জম্মুর সম্পূর্ণ জার্নিটা যেহেতু চার পাঁচ ঘন্টার তাই সাধারণ
কুপেতেই সবার সিট ছিল। খোলা জানলা দিয়ে শিরশিরে জমাট বাতাস বাধ্য করল তখনই হালকা
পাতলা চাদর জড়াতে। অথচ অমৃতসরে কি ধুন্ধুমার গরম ছিল, মে জুন মাসে সেটাই তো
স্বাভাবিক। তাই চোখের পাতা জ্বালা করলেও ঘুমোতে মন চাইল না। ভোরের আলো ফুটতে না
ফুটতেই ট্রেনের ছুটে চলার তালে দুপাশের প্রকৃতির ধীরে ধীরে বদলে যাওয়ার দিকে চোখ
ছুটে চলল। কোথাও ঢালু জমি, ছোটো ছোটো গুল্ম ঝোপ, জমির ঢালে জল বয়ে যাওয়ার চিহ্ন
স্বরূপ নুড়ি পাথরগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঝে মাঝে ছোটো মাঝারি উচ্চতার টিলা।
কিন্তু পাহাড় কই! এ তো আমার বাড়ির পাশের সুরিচুয়া, বড়পাহাড়ির মতো এলাকা। তফাৎ শুধু
মাটির রঙে। আমার বীরভূম লাল মাটির দেশ আর এখানে সাদা নয়তো উজ্জ্বল শ্লেট রং-এর
ছোঁয়া মাটিতে। তাহলে যে শুনেছিলাম বৈষ্ণ দেবীর মন্দির পাহাড়ের চূড়োয়। মনে প্রশ্নরা
গিজগিজ করতে থাকল জম্মু স্টেশনে পা রাখতে রাখতে।
স্টেশন থেকে কাটরামুখী বাস ছোটার তালে তালে
টিলার উচ্চতা, জঙ্গলের ঘনত্ব দুই-ই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল। লোহার রেলিং ঘেরা
রাস্তার পাঁকে পাকে যে ধীরে ধীরে উপরে উঠছে তা জম্মু শহরটির ছোটো হয়ে যাওয়া তেই
মালুম পড়ছিল। যেতে যেতে তন্দ্রা ছিঁড়ে যাওয়ার মত ‘টানেল’, ‘টানেল’ চীৎকারে বাস
মুখর হয়ে উঠল। আশেপাশে পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা চোর ডাকাতের দল সশস্ত্রে যদি ঘিরে ধরে
টানেলের দুদিকের মুখে বা দুয়েকটা পাহাড়ি ভূত পেত্নী। তো নির্ঘাত হৃদযন্ত্রের চাপে
কিছু কিছু মানুষ পরকালবাসী হবেন। টিমটিমে আলোয় নিজেদের মুখ চেনা যায় না। পর পর বেশ
কয়েকটা ঘুটঘুটেশ্বরের রাজত্ব পেরিয়ে বাসের গতি কমে এল। যদিও যাত্রাপথের চমকে খিদে
তেষ্টা মাথায় উঠেছিল, সামনে পাঞ্জাবি ধাবার খুশবুতে মনে হল ছুঁচোগুলো হাঁটাহাঁটি
শুরু করেছে।
আলু গোবিওয়ালা নান কুলচা আর স্পেশাল
আনারদানা চাটনি কাঁচা পেঁয়াজ সহযোগে। নান কুলচা ওভি মাকখন মারকে। এরা বাটার না
দিয়ে খাবার খেতেই পারে না। ‘মাখন ছোড়কে’ বলে খাবারের অর্ডার দিলেও কুলচার উপর
পাবেন এক কিউব বাটার। প্রশ্ন চিহ্নসহ তাকালেই ততোধিক ভ্রু কুঁচকে উত্তর পাবেন
‘মাকখন দিয়া হি কাঁহা!’ হয়ত পাহাড়ি রাস্তার পরিশ্রমে প্রবল এনার্জির জোগান হিসেবে
মাখন, কুলচা জাতীয় খাবার গুলি খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পেটরোগা বাঙালির কি পোষায়?
ধাবার একপাশে বিক্রি হওয়া ফ্রুট সালাড চাখতে চাখতে একটা শসার দাম কুড়ি টাকা শুনে
চোখ কপালে উঠতে দেখে ভেসে এল উত্তর- ‘বহুত মেহেঙ্গা হ্যায় না! ইধার নেহি হোতা!
আপলোগ বেঙ্গল কা হো না! বেঙ্গলসে ইয়ে চীজ লানা পড়তা হ্যায়! এই জোলো স্বাদের
নিতান্ত হেলাফেলার বঙ্গদেশীয় ফসলের কি কদর! সাধেই কি বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।
ঘন্টা তিনেকের বাসযাত্রার ক্লান্তিতে কাটরা’র হোটেলে ঢুকে গরম জলে স্নান
করে পেটে চাট্টি পড়তেই চোখ টেনে আসতে লাগল। কিন্তু বৈষ্ণ মাতা দর্শনে যারা হেঁটে
ত্রিকূট পাহাড়ে চড়বেন তাদেরকে তো সন্ধ্যে থেকেই হাঁটা লাগাতে হবে। আমার প্রেশার
সুগারে ভোগা মা তো অত হাঁটতে পারবে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় হোটেলের জানলা
থেকে ত্রিকূট পাহাড়টিকে দেখতে দেখতে ভাবনার সমুদ্রে ডুবে গেলাম। মহালক্ষ্মী,
মহাকালী আর মহাসরস্বতীর মিলিত রূপ এই বৈষ্ণ দেবী। ত্রিকূট পাহাড়ে তাঁর অবস্থান।
বৈষ্ণ দেবী দর্শনে যেতে হন্টন ছাড়াও ঘোড়া(পনি), পালকি(ডুলি) বা হেলিকপ্টার
সার্ভিসের সাহায্য নেওয়া যায়।
অগত্যা ত্রাণকর্তা হিসেবে এগিয়ে এলেন গাইড কাকু আর হোটেল ম্যানেজার। এদের
বদান্যতায় সেই রকমই এক এজেন্টের আগমন ঘটল হোটেলে। আমি তো মিনিট দশেক সেই এজেন্টকে
হাঁ করে দেখে চলেছি। এজেন্ট নাকি আধুনিক পোষাকে রাজপুত্র! পশ্চিমবঙ্গে
কোনও(কোম্পানীর নয়)নিজ উদ্যোগে এজেন্ট মানেই খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা গালভরতি দাড়ি,
ক্ষয়াটে চাউনি, খোয়ানো জুতোর মালিকটির কেবল গছানোর ধান্দা। কিন্তু এই লাল টুকটুকে
সুদর্শন এজেন্টের হাসি হাসি চোখ আর মিষ্টি মধুর ব্যবহার রীতিমতো সম্মোহনের মায়াজাল
বিস্তার করবে। আপনার পকেটে রেস্ত থাকে তো নিজ গরজে আপনি এই এজেন্টকে যোগাযোগ করবেন।
যেরকম আমরা তিনটি পরিবার মিলে করলাম। যাই হোক সেদিন বাকি সহযাত্রীরা হেঁটে পড়েছে
মাতারানির উদ্দেশ্যে, আর আমরা সাকুল্যে কয়েকটি প্রাণী উদ্দেশ্যহীন। সেকারণে
সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে ত্রিকূট পাহাড়কে আলোর মালায় সেজে উঠতে দেখার অনবদ্য
অভিজ্ঞতা লাভ হল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন