রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭

ভজন দত্ত

দ্বিতীয় পর্ব:

           হামদের ছ (ছো)

                            



খোলামাঠে আগে এই নৃত্যশৈলী প্রদর্শিত হলেও বর্তমানে প্রয়োজনমত মঞ্চেও প্রদর্শন করা হচ্ছে।তবে স্থায়ী মঞ্চ না হলে বিপদ ঘটার সম্ভবনা থেকে যায়। কারণ নৃত্যশিল্পীরা যেভাবে মঞ্চ জুড়ে দাপিয়ে নৃত্য করেন তাতে অস্থায়ী মঞ্চে কাঠের পাটাতন ভেঙে পড়তেই পারে। বিশেষ করে কোনো চরিত্র যখন দূরন্তগতিতে 'উলফা' প্রদর্শন করেন অর্থাৎ নাচতে নাচতেই শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে আবার যখন নীচে লাগাতার নেমে আসেন তখন শক্তপোক্ত মঞ্চ না হলে বিপদ ঘটতেই পারে।
সাধারণত সন্ধ্যে নামার পরই পুরুলিয়ার ফাঁকা টাঁড়জমিতে বা কোনো মাঠে এই নাচের প্রদর্শন করা হোতো। 

" সিন্দুর ভূষিত অঙ্গ,       মুষিকবাহন
সকল সিদ্ধিদাতা            হরগৌরীর বাহন
    চতুর্ভুজ গজেন্দ্রবদন, বিঘ্নবিনাশন।
                      জয় জয় হরগৌরীর নন্দন।। "
ছৌ নাচে গনেশ বন্দনার এই ঝুমুর গানটি বেঁধেছিলেন বৃন্দাবন সিংবাবু। আগেকার নাচ শুরু হত এই গনেশ বন্দনার মাধ্যমে। প্রথমে আসতেন গনেশ। ধূপ,দীপ জ্বালিয়ে,শঙ্খ বাজিয়ে শুরু হতো মূল পালা।এখন এই রেওয়াজ নেই।
বিদ্যুৎ ছিল না তখন, আলোর ব্যবস্থা বলতে ছিল হ্যাজাক।এই হ্যাজাক রাখা হোতো মাথায়। নাচের চরিত্ররা যেমন স্থান পরিবর্তন করতেন তেমনি লাইটম্যানদের স্থান পরিবর্তন করতে হতো। এখন মাঠে বা মঞ্চে উপর থেকে ফ্লাডলাইটের আলোয় এই নাচ দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়।
ছৌনাচের এককেটি দলে ১৫ থেকে ৩০ জন বা তার বেশী সদস্য থাকেন।এর মধ্যে বাজনদার থাকেন পাঁচ- ছ' জন। এক বা দু' জন থাকেন মূল সূত্রধর, গায়েন তাকে সঙ্গত করেন আরো কয়েকজন। বাকিরা প্রায় সবাই নাচ করেন।
গোল হয়ে মাঠে দর্শকেরা দাঁড়িয়ে বা বসে সহজেই এই নাচ দেখতে পারেন। বাজনদাররাও দাঁড়িয়েই বাজান।
নাচের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। পালা অনুযায়ী একেক রকম সময়।আগে সন্ধ্যায় শুরু হয়ে সারারাত ধরে চলতো এই নাচ। একেক রাতে চার পাঁচটি পালাকে অবলম্বন করে নৃত্য প্রদর্শিত হতো।বর্তমানে নানা অনুষ্ঠানে কোনো একটি পালার বিশেষ অংশ, সময় অনুযায়ী প্রদর্শন করা হচ্ছে।
পালার বিষয় সাধারণত রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে হয়।
কিছু পালার নাম - রাবণবধ, কংসবধ, অভিমুন্যবধ,মহিষাসুরবধ, পরশুরামের কৈলাশযাত্রা,বকরাক্ষসনিধন, বৃন্দাবনলীলা,কিরাত অর্জুনের শূকর বধ ,শিব-দুর্গা প্রভৃতি।
পুরুলিয়া জেলায় গম্ভীর সিং মুড়া ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি ছৌ নৃত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসাবে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হাত থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার গ্রহণ করেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে  " সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি " পুরস্কারও পান। ছৌ নৃত্যে পুরুলিয়া জেলার শ্রেষ্ঠত্ব  প্রমাণিত।তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।
বর্তমানে বিশ্বায়ণের ধাক্কায় সব সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন হচ্ছে। সিনেমা,টিভি,টিউব, ভিডিও সর্বোপরি  ইন্টারনেট ও মোবাইলের ধাক্কায় লোক- সংস্কৃতি আজ বিপন্ন। কোলকাতাতেই থিয়েটার হল বন্ধ করে বিয়েবাড়ি করতে হচ্ছে। যাত্রার মতো একটি শক্তিশালী মাধ্যমও আজ ধুঁকছে। সেখানে ছৌ নাচ আজও তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে এখানেও ধ্রুপদ শৈলী ছেড়ে ফিল্মি জগতের চটুল সুর,মাইকের ব্যবহার, দলে সদস্য কমানোর জন্য মাইকের সাহায্যে  সিডিতেই গীতিনাট্য ও বাদ্য বাজানো হচ্ছে। অনেকে মনে করেন এভাবে ছৌ নাচের ফলে সেই বীরত্বব্যঞ্জক ভাবটাই চলে যাচ্ছে।দেখা যাক ভবিষ্যৎ কি বলে! পুরুলিয়ার ছৌ পশ্চিমবঙ্গের গর্ব। পুরুলিয়ার " সিধু কানু বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়" ছৌ নাচের উপর সার্টিফিকেট কোর্স ও ডিপ্লোমা কোর্স শুরু করেছে। শুনেছিলাম চড়িদা গ্রামে গম্ভীর সিং মুড়ার নামে একটি ছৌ অ্যাকাডেমি হবে,জানিনা তার কাজ কতদূর! তা কি হবে না! ©
তথ্যসূত্র -
*অহল্যাভূমি পুরুলিয়া : সম্পাদনা -দেবপ্রসাদ জানা; দীপ প্রকাশন,কোলকাতা ২০০৩
*পশ্চিমবঙ্গ, পুরুলিয়া জেলা সংখ্যা; তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ,প ব সরকার ২০০৭
* পুরুলিয়া : তরুণদেব ভট্টাচার্য, ফার্মা কে এল এম ; কোলকাতা, ১৯৮৬
* বাংলার আভাষ ( পত্রিকা) , জুন- আগস্ট সংখ্যা, ২০০৪ ও ডিসেম্বর'০৪- ফেব্রুয়ারী' ০৫ সংখ্যা
* সাক্ষাতকার : ডঃ প্রিয়নাথ হালদার, দয়াময় রায়,
                          উজ্জ্বল দাস, মীনাক্ষী লায়েক।
আলোকচিত্র : উজ্জ্বল কুমার দাস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন