রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়


ওয়েসিস



এদিকে অনেকটা সবুজ। এদিকে অনেকটা জমি; এখনও প্রমোটারদের নজরে পড়েনি। দূরের জনবহুল পাড়াগুলোতেও, বাড়িগুলো খুব বেশি হ'লে দোতলা। বেশ ক'টা পুকুর বা দিঘীও পাওয়া যাবে কাছাকাছি। এই মন্দিরের জমিতেও একটা পুকুর আছে, একেবারে বাধানো ঘাট সমেত। প্রায় দু একর জায়গার পাঁচিল ঘেরা জমির একদিকে বেশি নারকোল গাছ ঘেরা পুকুর। হাঁস চরে বেড়ায় সবুজ পানাঢাকা জলে, মাছেরা বুদবুদ কেটে টুকি দিয়ে যায়। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া শান্তি আর শীতলতা। আর তার ঠিক কোণাকুণি ভাবে উলটো দিকে ধবধবে সাদা রাধাকৃষ্ণ মন্দির। তার চূড়োয় সুদর্ষণ চক্রের মত একটা ধাতব চাকা আর শঙ্খ আঁকা গেরুয়া পতাকা ঝলমল করে। আগে ছোট মন্দির ছিল, সীমানার পাঁচিল ছিল না, লোহার গেট ছিল না। এখন মন্দির বড় হয়েছে, চওড়া থামের ওপর নির্ভর করে বড় নাটমন্দিরের দালান। তিন বেলা খোল করতাল বাজে। মাথার চুলে পাক ধরেছে, কাছাকাছি প্রায় এমন সকলেই দিনে একবার অন্তত মন্দিরে মুখ দেখিয়ে যান। বিগ্রহের সামনে হাত জড়ো করে, চোখ বন্ধে করে, মাটিতে সাষ্টাঙ্গ হয়, জপের মালা নিয়ে দু দণ্ড বসে... যার যার নিজের মত। ওটা এখানে আসতে গেলে একটা আবশ্যিক ব্যাপার। তবে এছাড়াও নাটমন্দিরের চাতালে, সিঁড়িতে, পুকুরের ঘাটে, অথবা এই বিস্তৃত জমির অন্য যে কোনও চোখজুড়নো জায়গায় তিন-চার জন করে বসে থাকতে দেখা যায় এনাদের। সকালেও দেখা যায়, বিকেলেও দেখা যায়। দুপুরে ভোগের পর একটু কমে যায় কারণ  ওই সময় অনেকেই একটু জিরিয়ে নিতে চান। সন্ধেবেলা গেটের আলোগুলো জ্বলে যাওয়ার একটু পরেই গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেবায়েত আর গেটের সিকিওরিটি গার্ড তার আগেই আসতে আসতে এই সব জটলা হালকা করে দিতে শুরু করে। সন্ধ্যা আরতির পর মন্দিরের দরজা বন্ধ করে রাধাকৃষ্ণের শয়নের ব্যবস্থা হয়। শয়নের আগেই বাইরের গেট বন্ধ। সেবায়েত, হ্যাঁ মন্দিরের সেবায়েত আছে... এখন সংখ্যাতেও বেড়েছে। মন্দিরের পাশে ছোট করে তাদের থাকার জায়গা, বাথরুম আর রান্নার ব্যবস্থা, জলের লাইন - সব এসে গেছে। প্রধান পুরোহিত ছাড়াও আরও দু'জন সহকারী পুরোহিত। প্রধান পুরোহিত অবশ্য আশ্রমে থাকেন না, সন্ধেবেলা নিজের বাসায় চলে যান সাইকেল করে। দুপুরে ভাত, ডাল, ভাজা, চচ্চরি, চাটনি দিয়ে ভোগ হয়। শনি রবিবার খিচুরি বা পায়েসও হয়। এখন ছোটখাটো আশ্রমই বলা চলে। খরচের টাকা আসছে, সেবার প্রণামী। ভোগের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা হবে শোনা যাচ্ছে, এত লোক আসছে দুপুরে খাওয়ার সময়। আরও বাড়বে আশ্রমের কাজকর্ম। পরিধিও বাড়তে পারে বই কি! ঘনশ্যাম গোস্বামীর ছোট্ট রাধাকৃষ্ণ মন্দির যে একদিন এমন ফলন্ত আম গাছের মত ভরে উঠবে তা উনি জীবদ্দশায় হয়ত কল্পনাও করেন নি। এখন মার্বেল পাথরের মূর্তি হয়ে পুকুর ধারে দাঁড়িয়ে থাকেন, ঝকঝকে মন্দিরের ইমারত দেখেন ওই দূর থেকেই। 

   যেহেতু মন্দির ক্রমে আশ্রম হয়ে উঠেছে, আর আশ্রমের ভেতরটা একেবারে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া ব্যাপার - তাই বেশ কয়েকদিন হ'ল তিন চারজন ভক্ত কিছুতেই মন্দির থেকে যেতে চাইছে না। সারাদিন এই মন্দিরের চাতালে, সিঁড়িতে অথবা অন্য কোথাও বসে থাকে। এমনকি রাতেও যেতে চায় না, কোনও রকমে গেটের বাইরে বার করলে সেই গেটের বাইরেই বসে থাকে। নিন্দুকেরা বলে - রাতের বেলা মন্দিরের বাইরের অঞ্চলটা খুব একটা নিরাপদ নয়। মানে, এই মন্দির হোক, আশ্রম হোক, যাই হোক... তার পাঁচিলের বাইরে আশেপাশের সব কিছু আর দুষ্টু লোকের প্রবৃত্তি তো আর রাতারাতি পালটে যাচ্ছে না? রাস্তার ধারের আলোও জায়গা বুঝে আধলা ইট ছুঁড়ে ভেঙে দেয়। রাত বাড়লে সেই সব রাস্তা দিয়ে কেউ একা যেতে চায় না। কেউ কেউ বলল - শেষে মন্দিরের সামনেই ভালমন্দ কিছু ঘটে গেলে মন্দিরের নাম জড়াবে। আবার কেউ কেউ সুবুদ্ধি দিলো - এই সুযোগে ক'টা ঘর বানিয়ে একটা মহিলা আশ্রম বানিয়ে নাও। আশ্রমের সুনাম হবে, দান আসবে। সমাজের বঞ্চিতা, অভাগিনীদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে! 
   হ্যাঁ, মহিলা আশ্রমের কথাই উঠল কারণ ওই তিন-চারজনের মধ্যে তিন জন মহিলা। দু'জন বৃদ্ধা আর একজন অল্পবয়সী। সেই অল্পবয়সী মহিলাটির আবার কোলে একটি বাচ্চা। বছর দুয়েক হয়েছে হয়ত। সবাই বাড়ি থেকে তাড়া খেয়েই এখানে, বাড়ি থাকলে কেউ এভাবে মন্দিরের আশেপাশে পড়ে থাকবে কেন? সুবুদ্ধি যদি সাত-পাঁচ বাঁচিয়ে লাভের কথা বলে, তাহ'লে তা সদোপদেশ হয়ে যায়। সদোপদেশ নিতে মন্দিরের সেবায়েতরা দেরি করল না। একটা সুদিন দেখে ক'জন জুলপিতে পাক ধরা আর কপালে টাক পড়া মাথা স্থির করল এই অভাগিনীদের জন্য একটা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা হোক। বুড়োটাকে নিয়ে অসুবিধে নেই, নাটমন্দিরের এক কোণে পড়ে থাকুক। তবে বেশি মাথায় তোলা যাবে না, নাহ'লে রোজ কেউ না কেউ এসে হাজির হবে। আপাতত এই ক'জনই থাক। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক তীর্থপতিবাবু অবশ্য সবটা মেনে নিয়েও বললেন, "চিন্তাটা ভালই, তবে একেবারেই আননোন লোকজন! একটা পরিচয় টরিচয়ের ব্যবস্থা থাকলে..." 
বুড়ি দু'টো একেবারে গলায় তুলসীর মালা নিয়ে বসে থাকে। আর মেয়েটাও নিয়ম করে মন্দিরের মেঝেতে মাথা ঠেকায়, কীর্তনের সময় গলা মেলায় উর্দ্ধ নয়ন হয়ে। এইটুকু পরিচয় আর মুখে নাম জিজ্ঞেস করে অন্যরা সন্তুষ্ট হলেও তীর্থবাবু হলেন না। 

    এও যেন একরকম স্বক্রিয় সমাজসেবা। তীর্থবাবু অবসরপ্রাপ্ত হয়েও বেশ উদ্যমের সঙ্গে সমাজসেবী হয়ে উঠলেন চট করে। তিনজনকে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া হ'ল, আর তার সঙ্গে স্বচিত্র পরিচয়পত্রও বানিয়ে দেওয়া হ'ল নিখরচায়। একদম আশ্রমের ঠিকানাই তাদের ঠিকানা। আশ্রমের ফোন নম্বরই তাদের যোগাযোগের নম্বর। শুধু আঙুলের ছাপ দাও, ছবি তোলো - ব্যস্‌! তীর্থবাবুই দায়িত্ব নিয়ে পরিচয় পত্রের ব্যবস্থা করে দিলেন। 
তীর্থবাবু কোনওদিনও রুকসারকে আগে দেখেননি, রুকসারও তীর্থপতিবাবুকে চেনে না। তবে পুলিশ কে এবং কী তা চেনে। এই গ্রামে অন্য কেউই তাকে চেনেনা বলে রুকসার নিজের নামটা খুব সহজেই প্রতিমা দাস বলে চালিয়ে দিতে পারল। কোলের ছেলেটার নাম মাধব দাস। পাশের গাঁয়ে থাকত,স্বামী বন্যায় ভেসে গেছে। এই অবধি। অভাগিনীদের দয়া করার পর এত প্রশ্ন করতে নেই, দেবস্থানের অকল্যাণ হতে পারে। 
ধর্ষণ হওয়া থেকে এই ছেলে নিয়ে এইখানে পৌঁছনো অবধি সে অনেক গপ্পো। এসব কেউ বলে না, বললে ফালতু ঝামেলা। আসল নাম বললে তো আরও ঝামেলা। তার থেকে এই আশ্রমের ওয়েসিসে প্রতিমা ছেলেটাকে মানুষ করুক। অন্ততঃ পাঁচিলের ঘেরা জায়গায় বাইরের ভয়গুলো ঢোকেনি এখনও; চোখ জুড়নো শীতলতা আছে, রান্নার গন্ধ পাওয়া যায় সময় মত। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন