মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

শিল্পী মিত্র হাতি

বড়লোক
-----//-----

রুখু শুখু মলিন বদন,কোকড়া কাল চুলের এক কৃষ্ণকলি হাতে একটা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে চলেছে সামনে, পিছনে গুটিকয়েক কাছাকাছি বয়সের, সব মিলিয়ে জনা পাঁচ ছয়। গ্রামের মাটির রাস্তার দুপাশের ঝোপ ঝাড়ের অগোছাল, এলোমেলো আগাছাগুলো সেই কঞ্চির বাড়ি খেয়ে চলেছে, একবার এপাশে, একবার ওপাশে। এ গ্রাম তো কবির আঁকা ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় নয়, এ যে একেবারে রুক্ষ, মলিন, দারিদ্র্যের কঙ্কাল। না আছে বিজলির আলো, না শিক্ষার আলো। আয়লার বিধ্বংসী ঝড় মাটির উর্বরতা আরো সর্বনাশ করে গেছে। মেয়েরা কাঁকড়া, চিংড়ির মীন ধরতে আর ছেলেরা মধু আনতে কখনও বাঘের পেটে চলে যায়। সরকারের সুনজর থেকে বঞ্চিত, অবহেলিত।

 পালের গোদা মেয়েটি ছুটকি, ইস্কুল টিস্কুল এখন সব লাটে। কাঠ পাতা, গেড়ি গুগলি কুড়োনের নামে রোজই এমন নেতৃত্ব দেয়, কচি মুখগুলো  অচেনাকে চিনতে চিনতে এ গ্রাম ছেড়ে ও গ্রামে এসে পড়ে। আজ বেশ অনেকখানি এসে পড়েছে, সরকারি অফিসারের বাংলোর কাছে। বাব্বা এক্কেবারে দোতলা, কি বড় বাড়ি, তায় সামনে একখান বড় গেট, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। মুগ্ধ চোখগুলো বাড়িটাকে গিলতে থাকে।একদম নিরালা, নিশ্চুপ মেরে আছে যেন। বাড়ির ভিতর থেকে  ঝাঁকড়া মাথা গোলাপি লাল গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল পাঁচিলের শাসন না মেনে একেবারে রাস্তার দিকে নুয়ে পড়েছে। এত সুন্দর লালচে গোলাপি ফুল আগে দেখেনি, এর আগেও কম অভিযান তো করেনি!! কি নাম এ ফুলের কে জানে!!

ফুল বলতে তো গ্রামে আনাচে কানাচে ভাটি ফুল, তাও শীতকালে, আর তো ওই নিম, সজনে, এগুলো তো ফুলের গোত্রে তেমন পড়েনা। জবা, টগর এমন কয়েকটা কুলীন ফুলেরা থাকলেও তা নগন্য।
অভিযানে নেত্রী দলকে থামিয়ে বলে,' এই ফুলগুনো পেইড়ে চল ঘর নে যাই, কি সোদর লয়?'                   সমবেত  'আ্যা....'                                           
 সবার সায়-এ সাহস পেল নেত্রী। 
'দাঁড়া তবে'                                         
তরতর করে গেট বেয়ে পাঁচিলে উঠে যেই না ফুলে হাত, তেড়ে এল দরোয়ান,
' এই কে রে? লাব, লাব বলচি, ফুল চুরি হচ্চে আ্যা, তোদের সাহস তো কম লয় দেকচি'। 
ক্যাপ্টেন তখন পাঁচিলে, নীচের দলবল ধাঁ, চিহ্নটি নেই।                     
 'এই ছেমড়ি, লেবে আয় বলতিচি'     
' আগে বল কিছু বলবেনি'               
'ফের কতা, লাবতে বলিচি লাব, না'লে...'                                           ধপ, সঙ্গে সঙ্গেই ভূপতিত।                 
' এই কান ধর, ধর বলচি, পরের বাড়ির ফুল চুরি করতিচিস, নজ্জা করেনে?'                                          নতমস্তকে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল মাটিতে ঘষছে ছুটকি আর মুখটা নীচু করে দু কানে দুহাত। এ মুদ্রা ভেঙে সহসা দরোয়ানের চোখে চোখ,
' এমন সোদর ফুল কি দেকিচি, তাই গোটা কতক ঘর নে যাব ভেবিচি'।             
 'তো দেকিসনি বুলে চুরি করতে হবে?'                                   উত্তর নেই।
'বলি ফুল নে থুবি কুতায় আ্যা? ঐ মাটির ঘরে? জানিস নে, এফুল বড়নোকের বাড়ি হয়? তোরা কি বুজবি শুনি, শালা খেইতে পায়না, ফুল দে ঘর সাজাবে? শালা ভিকিরির বাচ্চা, ভাগ এখান থিকে, ভাগ'।

************
শীত শেষ, এবার বসন্তের হাওয়া লেগেছে প্রকৃতিতে। মাধবীলতায় যেন ছেয়ে গেছে। আছে জবা, টগর, অপরাজিতা, তাদের লাল, গোলাপী, সাদা, নীল কত রঙ। স্বামী গেছে শহরে। কি একটা কৃষি সমবায়ের লোন নিতে। গতবার আলুচাষে খুব মার খেয়েছে, এবার মহাজন বলেছে কম টাকা দেবে। তাই অন্য কোন উপায়ে লোনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেই চেষ্টা। ছেলেটা ছোট, পাড়ার খিচুড়ি ইস্কুলে যায়, মেয়েটা সরকারী ইস্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে, মাস্টাররা বলে ছেলের থেকে মেয়েটার মাথা ভাল।

গ্রামের ইস্কুলের সৈকত মাস্টার এবারে পঁচিশে বৈশাখে কী একটা নাটক করাবে। রোজ বিকেলে ইস্কুল মাঠে মহড়া হয়, মেয়েটা নাটকে অংশ নিয়েছে, মাকে বলেছে যেদিন হবে অনুষ্ঠান,নিয়ে যাবে। নাটকের নামটা যেন কি বলেছিল বটে, ভুলে গেছে, আজ মেয়েটা এলে জেনে নেবে।  মেয়ে বাড়ি ফিরে পড়তে বসে, তাদের মা রান্নাঘরের কাজ সেরে দুদণ্ড ছেলেমেয়ের কাছে এসে ফ্যানের নীচে বসে হাওয়া খায়, শরীরটা জুড়োনোর সাথে মনটাও জুড়োয়, পড়া শোনে, কত কি জানতে পারে দেশ বিদেশের নানা অজানা গল্প, জ্ঞান বিজ্ঞান, আরো কত কি। অনেক কিছু শিখেও গেছে।

'হ্যা রে, মানু তোদের নাটকের নামটা যেন কি কইছিলি'                             
'রক্তকরবী'                                       
'অ, তা অক্তকরবী মানে কি রা?'     
'রক্তকরবী একটা ফুলের নাম।'       
' অ, তা দেইখতে কেমন পারা?'                                                                  'লাল- লাল,  গোলাপী থোকা থোকা,  গাছটাও ঝাঁকড়া পানা, মিষ্টি ঘ্রাণ ও আছে গো মা ফুলগুলোর ।                                 
'এই বর্ষায় একখান ডাল এইনে লাগাস দিকি, কেমন ধারা ফুল, দেইখতে হবে নে?'                             
*************

সেই পাঁচিল, থোকা থোকা লাল গোলাপী ফুল, কানমলা, আর গা জ্বালান 'ভিকিরির বাচ্চা'। বড়লোকের দাম্ভিক ফুল আজ আলো করে ছুটকির উঠোনে। ছুটকি ফুলগুলো নাকের কাছে টেনে লম্বা শ্বাস নিয়ে মনে মনে হেসে আর ভাবে, আজ তাহলে ও সত্যি একজন বড়লোক বটে।

1 টি মন্তব্য:

  1. মাঝে মাঝে মনে হয় এই মেয়েটা কেন শুধু এমন করুণ রসের গল্প লেখে। পড়ে চোখ আদর হয়ে যাওয়ার পর বুঝি এটাই কেরামতি। কি অদ্ভুত লেখা আবারো মন খারাপ হয়ে উঠল।

    উত্তরমুছুন