মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

পিয়ালী বসু



আশ্রয়

১)
বাড়ি ফিরেই বোমাটা ফাটালো অত্রি , … তখন সন্ধে সাত’টা , বাইরের ঘরের টিভিতে গাঁকগাঁক করে চড়া দাগের সিরিয়ালটা চলছে , একঘেয়ে সন্ধেটাকে আরও এক পোঁচ একঘেয়ে করে ।

১ নং রাজবল্লভ স্ট্রিটের এই ঠিকানাটায় , টিপিক্যাল উত্তর কলকাতা হবার জন্য যা যা দরকার তার প্রায় সবটাই আছে । সদর দরজা পেরিয়ে ভিতরে আসা উঠোনের মাঝখানে কলতলা , তাকে ঘিরে দোতলায় যাবার শ্যাওলা পড়া চলতা ওঠা সিঁড়ি , আর তারও উপরে আগাছায় মোড়া ছাদ ।
একতলার ডানদিকের ঘরটার নিয়মমাফিক ভাড়াটে অত্রি , পুরো নাম অত্রি সেনগুপ্ত … লাইফ ইন্সিওরেন্সের দালাল । কমন দেওয়ালের ঠিক পাশের ঘরটায় একঘর ভাড়াটে ঘেঁষাঘেঁষি করে। কবে থেকে রয়েছে তারা কেউ জানেনা। বোধহয় দেশভাগের সময় থেকে ।

আজ সকালেই খবরটা পেয়েছে অত্রি , শোনার পর থেকে দুপুরের টিফিন গলা দিয়ে প্রায় নামেনি তার , তক্কেতক্কে ছিল , কখন বাড়ি গিয়ে খবরটা আহেরি কে দেবে । আহেরি … অত্রির তিন মাসের বিবাহিতা বউ । হেব্বি দেখতে ! ভরন্ত ফিগার … রাস্তায় বেরোলেই পাড়ার রকের গুলতানি করা দলটাও নড়েচড়ে বসে ।

(২)
—-
সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি । আকাশ অংশত মেঘলা … ছাদের কাপড়গুলি তুলে নিচে আসছিলো আহেরি । তখন বেলা প্রায় দুটো , শাশুড়িমা নিজের ঘরে আয়েশ করে দিবানিদ্রা দিচ্ছেন , হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো ।
এক – দুই – তিন … চতুর্থবার বাজার আগেই হুড়মুড় করে দৌড়ে যায় আহেরি ।

মিনিট পাঁচেক পর ফোন রেখে নিজের ঘরে যায় সে । কপালে আড়াআড়ি তিনটে ভাঁজ এতটাই স্পষ্ট যে , পাশের রাঙা কাকিমাদের বাড়ি থেকেও স্পষ্ট দেখা যাবে ।

বাবাদের জেনারেশানে একমাত্র সেজোকাকুই বেঁচে আছেন এখনো। বাকিরা সবাই মরে হেজে গেছে কবেই। সেজোকাকু অল্পবয়েসে সাঁতার কাটতেন , বাবার মুখেই শোনা আহেরির । এক ডুবে হেদুয়া এপার ওপার করতেন । তারা তখন বউবাজারের বাড়িতে , দুই শরিক ঘর , একসাথে ।

ভাবনার অতলে ডুব দেয় আহেরি । ‘কি করা উচিৎ এখন তার ? অত্রি কে বলবে কি ? ‘
.

(৩)
——
‘শালা ! সকাল থেকেই মেজাজটা খিচড়ে আছে । গত তিনরাত ধরে ঘষটানোর পরও একটা সুর বেরোয় নি । কোন মুখে যে পলাশ দা’র কাছে যাবে ? … ‘ এবারের পার্টির পেমেন্টটা বেশ হাই ছিল , অনেক বলেকয়ে রাজি করিয়েছিলো পলাশ দা কে অর্পণ , কিন্তু …

ধুস শালা ! নিজের উপরই বিরক্তি আসছে । এক ঝটকায় উঠে বারান্দায় আসে সে । সিগারেটে দু চারটে টান দিতে দিতে দৃষ্টি মেলে দেয় সামনে … ‘আহ ! যদি এমনই ভেসে বেড়ানো যেতো ! এমনই ইচ্ছেঘুড়ি হয়ে । ‘
.
এসআরএফটিআইতে সাউন্ড এঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে কলকাতার মাটিতে পা রাখা তার বছর দুয়েক আগে । তারপর থেকে জুতোর শুকতলা খসিয়েও বলার মতো একটা কাজ জোটাতে পারে নি সে । এই অবস্থায় কি করেই বা ওকে আনা যায় বাড়িতে ? …
.
ডিপ্রেশনের আলগা ছায়াটা গেঁথে বসার আগেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে অর্পণ । স্টুডিওতে ঢুকে পড়ে । একবার আবার শুরু করা যাক । ভিকি বলতো , সকালে একটা নরম নরম ব্যাপার থাকে গলায় , যেটা বেলা বাড়ার সাথে সাথে থিতিয়ে পড়ে শেষ বিকেলে জাস্ট নুনের মতো ঝুরঝুরে হয়ে যায় । ভিকি সিং এসআরএফটিআইতে তাদের তিন বছরের সিনিয়ার ছিল । তুখোড় ছেলে ! তাইতো আজ কেমন গুছিয়ে বসেছে … একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা আপনিই বেরিয়ে আসে অর্পণের বুক চিরে ।


ক্রমশঃ 

1 টি মন্তব্য: