মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

বনবীথি পাত্র




#ওম
#

(1)

ক'দিন ধরেই শরীরটাতে তেমন জুত পাচ্ছে না আদুরী, বুঝতে পারছে রাতের দিকে রোজই গায়ের তাপ বেড়ে আগুনপারা হচ্ছে। শরীরের আর দোষ কী! আরাম-আয়েশ তো দূরের কথা, পেট ভরে খাবারটাও কি খেতে পেয়েছে রোজদিন! মা তো জম্ম দিয়েই খালাস, বাপটার তো সংসারে মতিগতি নেই কোনদিন। জীবনে যা পয়সা কামিয়েছে, চুল্লু খেয়ে তার থেকে উড়িয়েছে বেশি। ঐ বুড়ি দাদি না থাকলে কবেই বোধহয় মরে যেত আদুরী। মরে গেলেই বেশ হত। এই গরু-ভেড়ার মত বেঁচে থাকাটা আবার বাঁচা নাকি! এমন এক পোড়ারমুখো মিনসের সঙ্গে বিয়ে হল যে বছর না ঘুরতে পেটে একখান বাচ্চা ভরে দিয়ে ভেগে গেল নিজের আশনাইয়ের মানুষকে নিয়ে। তারপর থেকে তো জীবনে একটা দিনও বিশ্রাম নেই আদুরীর জীবনে। এই জীবনখানায় কে যে আবার সোহাগ করে "আদুরী" নামটা রেখেছিল কে জানে! মনে মনে সেই নামকরণদাতাকে গালাগালি দিতে দিতে পাশ ফিরে শোয় আদুরী। আজ আর বিছানা ছেড়ে উঠতেও ইচ্ছা করছে না। কয়েক মিনিট শুয়েই উঠে পড়ে আদুরী। সুরিয়া আর বাচ্চা তিনটের চিৎকারে কানে মনে হচ্ছে তালা লেগে যাবে। 

-আজ সবকটাকে এমন মার মারব, যে আর কোনদিন এই সাত-সকালে ব্যাঁ ব্যাঁ করে কানের মাথা খাবে না।

কোমরটা নিয়ে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারে না আজকাল। তাতেও কোনরকমে ঘরের কোণ থেকে কঞ্চিটা তুলে নিয়ে বাইরের ছোট কাঠের খুপরীর দরজাটা খুলে দেয় আদুরী। দরজাটা খুলতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে সুরিয়া আর ওর তিন ছানা। সামনের উঠানে ছানাগুলো তিড়িংবিড়িং করে দুপাক খেয়েই সুরিয়ার কোল ঘেঁষে ওর ঘন পশমের মধ্যে মুখ গুঁজে দাঁড়ায়। যেন কিছুটা ওম শুঁষে নিচ্ছে মায়ের শরীর থেকে। মারবে বলে যে কঞ্চিটা এনেছিল, নিজের অজান্তেই যেন সুরিয়ার হাত থেকে খসে পড়ে সেটা। পুষ্পাও ঘুম থেকে উঠে ঠিক এইভাবেই লেপ্টে থাকতো আদুরীর শরীরের সঙ্গে। কতদিন বেটিটাকে চোখের দেখাও দেখেনি আদুরী। বুকের মধ্যেটা কেমন যেন হু-হু করে ওঠে ওর।

শরীর না চললেও ওদের নিয়ে ডিমার ধারে আসে আদুরী। বর্ষা পেরিয়ে এখন শরৎ এসেছে। নদীতে পাথর-বালি আর পায়ের চেটো ডোবা জল। নদীতে জল থাকে যখন চোখে চোখে রাখতে হয় ওদের একটু। এখন নিশ্চিন্তে ওদের ছেড়ে দিয়ে দূরে একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আদুরী। সুরিয়া আর ওর বাচ্চাগুলো মনের সুখে কচি ঘাস খাচ্ছে। মাঝেমাঝে ওদের ওপর রেগে গেলেও ওদের ভালোবাসে আদুরী। ওরা ছাড়া আর কী আছে আদুরীর জীবনে! একটা কর্তব্য পালন করতে পারলেই এবার আদুরীর ছুটি।
সুরিয়ার বাচ্চাগুলোর গা জিভ দিয়ে চেটে পরিষ্কার করছে। বাচ্চাগুলোর শরীরেও লোম বের হতে শুরু করেছে। সেই জ্ঞান হয়ে থেকে ভেড়া পালছে আদুরী। ওর অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারে সুরিয়ার বাচ্চাগুলোর লোমও ওদের মায়ের মতই হবে। ভাদ্দর-আশ্বিন-কাত্যিক তিনমাসে পুরো লোমে ঢেকে যাবে। মনে মনে হিসাব করে আদুরী। শীত তো পড়বে সেই অঘ্রাণ মাসে! অজানা খুশিতে চিকচিক করে ওঠে আদুরীর কোঠরগত চোখ দুটো।


(2)

অসময়ে ডিমা নদীতে হড়কা বানে তলিয়ে যাচ্ছিল দুটি মেষশাবক। নিজের জীবন বিপন্ন করে তাদের বাঁচাল এক বয়স্কা আদিবাসী রমণী।

খবরের কাগজের ভেতরের দিকের পাতার এককোণে ছোট্ট খবরটা অনেকেই পড়ল, অনেকের চোখ এড়িয়েও গেল।

একদল পশুপ্রেমী সাংবাদিক ছুটে গেল ডিমা নদীর তীরে রাভাদের সেই ছোট গ্রামে।

স্থানীয় কিছু মানুষ যদি না বাঁচাত, আদুরী কাল হয়তো সুরিয়ার ছানা দুটোর সঙ্গে ভেসেই যেত বানের জলে। ডিমা নদীর ধরণটাই এমনি। ভুটানে বৃষ্টি হলে হঠাৎ করেই বান এসে যায় এখানে। কালকেও এমনটাই হয়েছিল। আদুরীর হয়তো চোখ লেগে এসেছিল খেয়াল করেনি। হঠাৎ দেখে নদীতে বান আর সেখানে হাবুডুবু খাচ্ছে সুরিয়ার দুটো বাচ্চা। কিছু না ভেবেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আদুরী।

আজ আদুরী অনেকটা সুস্থ। দাওয়াতে এসে বসেছে। সাংবাদিক-ক্যামেরা আর গাঁয়ের মানুষজন সবাই ভিড় করেছে ওর উঠোনে।

এক সাংবাদিক জানতে চান,

-আপনি নিজে বানের জলে ভেসে যেতে পারেন জেনেও ভেড়ার ছানা দুটোকে বাঁচাতে গেলেন কেন?

কী যে বলবে বুঝতে পারে না আদুরী। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ভ্যাবলার মত চেয়ে থেকে বলে,

-থোড়াসা ওমের জন্যি বাবু।

তার কথার অর্থ কেউই বুঝতে পারে না। আবার জানতে চায়,

-ওমের জন্য মানে কী?

-আমার একমাত্র বিটিয়া পুষ্পার শাদির সময় জামাইবাবাকে একটা আচ্চি পশমের সুইটার দেব বলেছিলাম বাবু। কিন্তু দিতে পারি নাই। ওরা পুষ্পাকে তার জন্য আমার কাছে পাঠায় না। এবার এই সুরিয়া আর ওর বাচ্চাদের পশম দিয়ে একটা আচ্চি সুইইটার বানিয়ে দেব আমার জামাইবাবাকে। তবে না পুষ্পা বিটিয়াকে আমার ঘরে পাঠাবে ওরা। সুরিয়া আর বাচ্চারা না থাকলে আমি তো আমার পুষ্পা বিটিয়াকে কাছে পাব না কোনদিন.....


চিত্র - আশীস পাইন 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন