মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

হিমাংশু চৌধুরী


শীতের সাতসতেরো 



হ্যাঁ, শীত আসছে। যদিও আজকের কোলকাতায় তিনি ক্ষণিকের অতিথি, যাকে বলে, ব্লিংক অ্যান্ড ইউ মিস, তাহলেও, একটা বেশ আনন্দ আনন্দ ভাব তো হবেই। বছরে ন'টা মাস দম চাপা ভ্যাপসা গুমোট গরম থেকে অন্তত তিনটে মাসের জন্য মুক্তি তো মিলবে।

ছোটবেলায় শীতকালের আগমনটা আরো আনন্দদায়ক ছিলো, কারণ, একে তো নভেম্বরের শেষের দিকে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হতো, তারপর শুধু খেলা আর খেলা। এই সময়ে শহরে আসতো সার্কাস আর কমলালেবু,  একসাথে। সার্কাস দেখার উত্তেজনায় আগে পরে মিলিয়ে দশদিন ঘুম হোতো না। গতবারে কি দেখেছিলাম, এবারে নতুন কি দেখবো, রাত্রে লেপের আড়ালে ঢুকে সেই আলোচনা চলতো, যতক্ষণ না মা পিঠে দু'চার ঘা দিচ্ছে। আর ভাই বোনরা মিলে কমলালেবু খাওয়ার প্রধান আকর্ষণ  ছিলো, কে কত তাড়াতাড়ি লেবু খেয়ে খোসাটা টিপে ঐ তৈলাক্ত রসটা কারো চোখে ঢুকিয়ে দিতে পারছে! বাবা মার কাছে কম বকা খেয়েছি এইজন্য! আর দুটোই যখন একইসাথে হতো, অর্থাৎ, রবিবার খাসির মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে বেরিয়ে সবাই মিলে ময়দানে বা সিঁথির মোড়ে গিয়ে কমলালেবু খেতে খেতে সার্কাস দেখা, তখন তো সোনায় সোহাগা।

আর কতগুলো জিনিষ খুব মনে পড়ে। আমার ঠোঁট প্রথমেই ফেটে চৌচির হয়ে যেত। বস্তুত, আমার ঠোঁট ফাটলেই লোকে বুঝতে পারতো, শীত চলে এলো। তারপরের চারমাস হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলতো আমার লিপস আর সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম এর। মোটামুটি বোরোলিন লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার সাইমন্ডসের মতো ঠোঁট করে আমায় রাখতে হতো সর্বদা। ওটাই আমার হলমার্ক ছিলো। বহুদিন অবধি এই অভ্যাসটা বজায় ছিলো।  আমার জীবনসঙ্গিনীকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছি, আমার কোন ব্যাপারটা তুমি প্রথম লক্ষ্য করেছিলে? দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সব সময় একই উত্তর পেয়েছি- মুখ নয়, চোখ নয়, চুল নয় কেত নয়- বোরোলিন (তখন ক্লাস ইলেভেন)।

তখন বোধহয় শীত আরো এক দেড়মাস বেশি থাকতো। কালিপুজোর দিন যেহেতু একটু বেশি রাত অবধি বাইরে থাকার পারমিশন ছিলো, সেইদিন সোয়েটার মাফলার না পড়লে মা বাড়ি থেকে বেরতে দিতো না। দু'দিন পরে রাতভর জলসায় পাছে যাওয়ার অনুমতি না পাওয়া যায়, তাই মা'র কোন কথায় তখন না করা যেত না। আর ওদিকে ফেব্রুয়ারির শেষ, এমনকি মার্চেও গায়ে ঢাকার দরকার হতো।

আর ছিলো পঁচিশে ডিসেম্বরের পিকনিক। সেই কুয়াশামাখা ভোরে আমরা বেরিয়ে পড়তাম। সব সরঞ্জাম ভাগাভাগি করে বয়ে নিয়ে যেতাম খাল পেরিয়ে বালির চরে। তখন বুঝিনি, এখন জানি সেই জায়গাটা ছিলো বিধাননগরের শৈশবাবস্থা। বিশাল বিশাল মোটা পাইপ পেতেছিল জার্মান সংস্থা হিউম পাইপ অ্যান্ড কোম্পানি। বড় বড় পাম্প দিয়ে গঙ্গা থেকে বালি আর জল একসাথে মিশিয়ে এনে ফেলেছিল পূর্ব কলকাতার এই জলাভূমিতে। সেই জলাভূমি বুজিয়ে তৈরি হলো সল্ট লেক। আমরা অত শত জানতাম না। আমরা বলতাম, বালির চর। গোটা সল্ট লেকে তখন আবাসিকের সংখ্যা হাতে গোনা যাবে, উল্টাডাঙ্গার দিক থেকে ঢোকার রাস্তায় কিছু বাড়ি হয়েছে, বাকি বিস্তীর্ণ জায়গা ধূ ধূ করছে বালি আর বালি, মাঝে হোগলা আর গোলপাতার বন। সেক্টর টু আর থ্রি তে তখন হাতে গোনা দুয়েকটা বাড়ি।  যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়নি তখনো। বিস্তীর্ণ বালির চরের মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে দুটো বাড়ি। ওয়াটার হাউস (মনে হয় সলটলেকে জল সরবরাহের মেইন পাম্প ওখানে বসানো হয়েছিল), আর পাওয়ার হাউস (বিদ্যুৎ দপ্তরের বাড়ি)। কত যে শিয়াল পরিবার তাদের ছানাপোনা নিয়ে ওখানেই বাস করতো। রাত বাড়লেই প্রহরে প্রহরে তাদের সমবেত হুক্কাহুয়া ধ্বনিতে চারপাশ মুখর হয়ে যেত, তবে সেটা শীত গ্রীষ্ম বারোমাসই। পিকনিকে যাতায়াতের পথে দুখিয়ার ক্ষেত থেকে তাজা মটরশুঁটি দু'চারগাছা ছিঁড়ে নিয়ে চিবোতে চিবোতে যাত্রা। এখন যেখানে বাইপাস, ঠিক তার পূর্বদিকেই ছিলো একটা বেশ বড় খাল (আমরা ভাবতাম নদী, পরে জেনেছি, ওটা ছিলো, কেষ্টপুর খালের সাথে বিদ্যাধরী নদীর সংযোগকারী চ্যানেল)। রীতিমতো নৌকা চলতো সেখানে, জোয়ার ভাঁটা খেলতো। বাঁশের তৈরি নড়বড়ে সাঁকো পেরিয়ে ওপারে পৌঁছাতে হতো। ওপার থেকে আবার আধঘণ্টাটাক আল ধরে হেঁটে পিকনিকের জায়গায় পৌঁছানো।সেখানে পৌঁছানোর পরে একটা জায়গা সুবিধে মতো পছন্দ করে নিয়ে বসে পড়া। হোগলাবন আর গোলপাতার জঙ্গল থেকে গোলপাতা ছিঁড়ে নিয়ে বালির উপর পেতে দেওয়া। তার উপরে ভাড়া করা জাম্বো সাইজের শতরঞ্চি পেতে বসার ব্যবস্থা। বড়রা রান্নাবান্না, আর আমরা খুচরোরা ব্যাডমিন্টন বা ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেট খেলায় ভা সিম্পলি দৌড়াদৌড়ি করায় মত্ত হয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে হাওয়া উঠলে সব বালি বালি হয়ে যেত, কিন্তু তাও খেতে কারোর কোনদিন অসুবিধে হয়নি। শরের জঙ্গল থেকে আসন্ন সরস্বতীপূজার জন্য ভালো দেখে খাগের কলম জোগাড় করাও এই বাৎসরিক পিকনিকের অবশ্য কর্তব্য ছিলো। আর বেশি অ্যাডভেঞ্চারাস কয়েকজন জলা জায়গায় নেমে বেলে মাছ ধরতো, আর শোলাগাছ তুলে নিয়ে আসতো। এখনকার টোপোগ্রাফি অনুযায়ী জায়গাটা করুণাময়ীর আশেপাশেই হবে। এখনকার সল্টলেকের বাসিন্দারা কল্পনাও করতে পারবেন না, উনিশশো সাতাত্তর সাল অবধিও চিত্রটা এরকমই ছিলো।

আর ছিলো ক্রিকেট খেলা। বন্ধুরা মিলে পিচ তৈরি করে রীতিমতো ডিউস বা কর্কড বলে (আমরা বলতাম, কর্কেট) খেলা। আগামী দু'মাস সকালে ক্রিকেট, দুপুরে ক্রিকেট, বিকেলে ভলিবল। ও ক'দিন ফুটবল তোলা থাকতো। তিনি আবার বেরোবেন কোয়াটার্লি পরীক্ষার পরে। খেলাধূলা সবই হতো অধুনা চকচকে হয়ে বন্দী হয়ে যাওয়া সুভাষ সরোবরে। বিশাল লেক, তার পাশে গোটা পাঁচেক আলাদা আলাদা মাঠ। এক একটি এক এক রকম খেলার জন্য নির্দিষ্ট।  কোথাও ভলিবল কোর্ট কাটা হয়েছে,  কোথাও বারপোস্ট লাগিয়ে ফুটবল হয়। মাঠগুলো বড় বড় ক্লাবের দখলে। এবারে আমরা যখন টিফিনের পয়সা জমিয়ে ডিউস বলে ক্রিকেট খেলা শুরু করবো ভাবছি, তখন, প্রধান সমস্যা দাঁড়ালো মাঠ আর পিচ। প্রতিষ্ঠিত মাঠগুলো বড়দের দখলে। কুছ পরোয়া নেহি- অ্যানুয়াল পরীক্ষার পরের দিনই হই হই করে আমরা নেমে পড়লাম মাঠ হাসিলের কাজে। জঙ্গল পরিষ্কার করে মাঠ, কোদাল দিয়ে মাটি কেটে দুরমুশ করে রীতিমতো ফিতে দিয়ে মেপে পিচ তৈরি করা হলো। তারপরে সুভাষ সরোবর থেকে বালতি বালতি জল এনে দুরমুশ করা হলো। তাও যখন মনোমত হচ্ছেনা, তখন পাশের ফার্স্ট ডিভিশন মাঠ থেকে (সেই সময়, ১৯৮৪-৮৫ সালে, সুভাষ সরোবরে সিএবি ক্রিকেট লীগের কিছু খেলা পড়তো) মালীকে কিছু ঘুষ দিয়ে রোলার টেনে এনে রোল করে পিচ তৈরি করা হলো।  তারপরে আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত ডিউস বা 'কর্কেট' বলে ক্রিকেট খেলা শুরু হলো। পয়সা কম ছিল,  তাই একজোড়া প্যাড কিনে দুই ব্যাটসম্যান শুধু ফ্রন্টফুটে একটা করে প্যাড বেঁধে খেলতো। ব্যাট করার সময় পাশের রাস্তা দিয়ে যদি কোন ঝিঙ্কু মামণি যেত, তবে বলটা চার ছক্কা মেরে ওদিকে পাঠিয়ে একটা এক্সট্রা স্যোয়াগ নেওয়ার  ব্যাপার ব্যাটসম্যানের,  আর বল মিস করলে বা প্যাডে লাগলে, বা বরাতজোরে কেউ যদি সত্যিই আউট হয়ে যায়, তাহলে বোলারের হাউজ্জ্যাট ধ্বনিতে কাককোকিল উড়ে যেত গাছ থেকে। সকালের খেলা শেষে লাঞ্চ ব্রেক, তারপরে আবার দুপুর থেকে বিকেল অবধি। ঠিক চারটের সময় ভলিবল মাঠে। সাড়ে পাঁচটা অবধি ভলিবল। তারপরে পাড়ায় ফিরে কাইট জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা। তখনকার কাঠের ফ্রেমের র‍্যাকেটগুলো একিটা ত্রিকোনাকৃতির ফ্রেমের মধ্যে বেঁধে রাখতে হতো সারা বছর, না হলে বেঁকে যেত। বহু বছর পরে সেদিন আমাদের পুরনো বাড়িটা ভেঙে নতুন করার সময়ে সেই র‍্যাকেট আর ফ্রেম বেরলো লফট থেকে, তারগুলো ছিঁড়ে গেছে, যেমন কেটে গেছে আমাদের জীবনের অনেকগুলো তার।

আর মনে পড়ে ইফতিকার চাচা'র কথা। বহুদিন ভেবেছি তাঁর কথা লিখে যাবো কোথাও না কোথাও। ইফতিকার চাচা ছিল সদাহাস্যময় ফিল্মি হিরোর মতো দেখতে কাশ্মিরী শালওয়ালা।  সেই সময় শীত পড়তে না পড়তেই একঝাঁক পরিযায়ী পাখিদের মতো কলকাতায় নেমে আসতো দেবদূতের মতো দেখতে একদল কাশ্মিরী যুবক। কাঁধে তাদের গাঁঠরি,  তার ভিতরে হরেক রকম পশরা। শাল সোয়েটার পঞ্চো মাফলার জ্যাকেট মায় উলেন মোজা দস্তানাও। মাইজী, শাল লিবেন বলে একমুখ হেসে ইফতিকার ঢুকতো আমাদের বাড়িতে, তারপরে গাঁঠরি খুলে বসতো।  ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতো রংবেরঙের শীতের পোষাক। আর আমরা কচিকাঁচাদের জন্য বেরতো আখরোট আর খোবানি। এরপরের চার পাঁচ মাস তার আনাগোনা লেগেই থাকতো। নিম্নবিত্ত পরিবারে এইসব সওদা বিক্রি করে মাসিক ইনস্টলমেন্টে সেই টাকা আদায় করাই ছিল তাদের ব্যবসার ইউএসপি। 

ধীরে ধীরে ইফতিকার চাচার আসা যাওয়াটা একদম স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেল। ওর বিবি, বাচ্চাদের নাম সব আমার মুখস্থ হয়ে গেল। সময় কেটে গেল। যাবার সময় প্রতিবার আমাদের কাশ্মীরে আমন্ত্রণ করে যেত। আমার মা'কে বলতো, "ওখানে এসো দিদি, আমার বাড়িতে থেকে কাশ্মীর ঘুরবে।" সে আমন্ত্রনের আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে যায়।

তারপরে সত্যিই একদিন কাশ্মীর ঘোরার প্রোগ্রাম হলো আমাদের। আমি সে'বছর মাধ্যমিক দিয়েছি। মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই যাওয়া হবে। আত্মীয় বন্ধু মিলিয়ে প্রায় পনেরো জনের দল। এত লোক নিয়ে  যাওয়া, আগে থেকেই হোটেল বুক করে রাখা হলো। যদিও ইফতিকার চাচা তার বাড়িতে উঠতে বলেছিল, কিন্তু সেটা প্রশ্নের বাইরে বলে, তাকে বলা হয়নি কিছুই। তবে ইফতিকার চাচা তার ঠিকানা দিয়ে গেছিল। তখন তো আর এরকম মোবাইল ফোনের সুবিধে ছিল না। যাবার পনেরো দিন আগে কী মনে করে বাবা একটা পোষ্টকার্ড ফেলে দিল ইফতিকারের ঠিকানায়। কবে যাচ্ছি, কী ট্রেনে যাচ্ছি, জম্মু কখন পৌঁছাব, শ্রীনগরই বা কখন ঢুকবো, কোন হোটেলে উঠবো, ইত্যাদি ইত্যাদি।

কাশ্মীর যাত্রার উত্তেজনায় আর ইফতিকার চাচার কথা মনে নেই। শুধু অপেক্ষা, কখন পৌঁছাবো। তারপরে তো জম্মু পৌঁছে সেখান থেকে প্রায় বারো ঘন্টার মনোরম কিন্তু কষ্টকর বাসযাত্রা পেরিয়ে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ হোটেলে উঠে সবে গরম জল দিয়ে হাত পা ধুয়ে বসেছি, বাইরে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, ঠান্ডায় হাতপা কাঁপছে,  হঠাৎই শুনি আমার জামাইবাবুর নাম ধরে কে চিৎকার করছে, আর দরোজা ঠকঠক করছে। দরোজা খোলা হলো, দেখা গেল, ইফতিকার চাচা দাঁড়িয়ে আছে।

তারপরে তো তার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল, কেন আমরা তার বাড়িতে না উঠে হোটেলে এসে উঠেছি। আধা ঘন্টা ধরে মাথা চাপড়ে হা হুতাশ করলো, বকলো, তার পরে বলতে শুরু করলো, হোটেল ছোড় দো, হামারা ঘর চলো। একেবারে স্যুটকেস-টেস তুলে বাইরে নিয়ে যায় আর কী! অনেক বুঝিয়ে তাকে নিরস্ত  করা হলো, যে হোটেলে পেমেন্ট হয়ে গেছে, এখন কী আর ছেড়ে যাওয়া যায়! হোটেল তো আর টাকা ফেরত দেবে না! মুখে এই কথা বললেও, মনে মনে আমরা সবাই ভাবছিলাম,  গরীব মানুষ (গরীব বলেই তো শাল বিক্রি করতে যায়, নাকি?), তার বাড়িতে এতজন গিয়ে বিব্রত করার কোন মানেই হয়না। শেষ অবধি সে আগলে সানডে দুপুরে সবাইকে তার বাড়িতে দাওয়াত খেতেই হবে কথা নিয়ে বিদেয় হলো। এছাড়া কথা দিতে হলো পরদিন থেকে সে আমাদের ঘোরার ব্যবস্থা করে দেবে।

কথামতো সত্যিই সে কাজ কামাই করে পরেরদিন থেকে আমাদের শ্রীনগর ঘোরাতে শুরু করলো। বিভিন্ন গার্ডেন, ডাল লেকে শিকারা ভ্রমণ -সবই বাজার চলতির থেকে অনেক কম মূল্যে করিয়ে দিল। তখন কাশ্মীর সবে অশান্ত হতে শুরু করেছে। এদিকে সেদিকে ছুটকো ছাটকা গন্ডোগোলের খবর হচ্ছে মাঝে মাঝে।  তবে তখন কাশ্মীরের থেকেও ঢের বেশি অশান্ত ছিল খলিস্তানি আন্দোলন। আমরা যখন শ্রীনগরে ঘুরছি, সেদিন হঠাৎই শুনলাম শহরের উল্টোদিকে গাড়ি বিস্ফোরণ হয়েছে। ইফতিকার চাচা আর তার ভাই আমাদের সাথে ছিল, তারা অভয় দিল, তোমরা একদম চিন্তা করবেনা, তোমরা আমাদের মেহমান আছো।

রবিবারের দিন সক্কালবেলায় সে দুটো বড় গাড়ি নিয়ে হাজির, তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাদের হোটেলটা ছিল ডাল লেকের  কাছে লালচকের উপরেই। সেখান থেকে গাড়িতে ইফতিকারের বাড়ি যেতে লাগলো খুব বেশি হলে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। আমরা মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছি, ভাবছি হয়তো কোন ছোটখাটো কাঁচা বাড়ির সামনে গাড়ি থামবে। যখন গাড়ি গিয়ে সত্যি সত্যি ইফতিকার চাচার বাড়ির সামনে থামলো, তখন যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।

বড় রাস্তা থেকে একটা বাই রোড নেমেছে সবুজ মাঠের মধ্যে। চারিধারে অসংখ্য রঙবেরঙের ফুল ফুটে আছে, তার মাঝে সাদা ক্রিকেট ফেন্সের ভিতরে একতলা বিশাল বাড়ি, সামনে নিজস্ব লন, দরজা জানালা পুরো কাঁচের তৈরি, আর পুরোটাই শ্রীনগর শহরের মধ্যে। সাদা কাঠের ফেন্স, সবুজ দরজা জানালা আর রঙিন বাগান মিলিয়ে এক অদ্ভূত মায়াজাল সৃষ্টি করেছে।

আমরা এরকম বাড়ি দেখতে অভ্যস্ত নই। জানিনা, আলিপুরের দিকে এরকম থাকতেও পারে (তখনও সল্টলেক নির্মীয়মাণ),  কিন্তু আমরা থাকি বেলেঘাটার নিতান্ত নিম্নবিত্ত অঞ্চলে। সেখানে অধিকাংশই টালি বা খোলার চালের বাড়ি, দুচারটে পাকা বাড়ি। এরকম বাড়ি  ক্ষমতা থাকলেও  কেউ সেখানে করবেনা। দু'দিনে কাঁচ ভেঙে সব চুরি করে নিয়ে যাবে। এতই অবাস্তব লাগছে যে কে যেন জিজ্ঞেস করেই ফেললো, "চুরি হয়ে যায়না?" জবাবে সিনা টানটান করে চাচা বললো, "ইয়ে কাশ্মীর হ্যায়, ইঁহা চোরি নহি হোতা।"

আমরা গাড়ি থেকে নামতেই হইহই করে পুরো পরিবার নেমে এল আমাদের অভ্যর্থনা করতে। ইফতিকার চাচার বুড়ো বাবা মা, তিন ভাই, তাদের বিবিরা, ছেলে মেয়ে সবাই।  আমাদের হাত ধরে বসার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। মেঝেতে পুরু গালিচা পাতা, বসার সাথে সাথে চা আর স্ন্যাক্স এল। 

তখন, টেপ রেকর্ডারের যুগ। কলকাতার হিট ছবি তাপস দেবশ্রীর ভালোবাসা ভালোবাসা আর লাল গোলাপ। হঠাৎই শুনি টেপ রেকর্ডার চালানো হয়েছে, তাতে বাজছে বাংলা গান। ভালোবাসা ভালোবাসা ছবির। "খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে", "যত ভাবনা ছিল, যত স্বপ্ন ছিল"; তারপরেই বেজে উঠলো "এই ছন্দ, এ আনন্দ"... ইত্যাদি ইত্যাদি। মেহমান নওয়াজি করতে পেরে ওরাও খুব খুশি। আমাদের এই গান শোনাবে বলে অনেক কষ্ট করে ইফতিকার চাচা খোদ কাশ্মীরের বুকে বসে  বাংলা সিনেমার গানের ক্যাসেট জোগাড় করেছে! কী করে তা সম্ভব হলো কে জানে!

গল্পে গল্পে বেলা হলো। দাদিজী এসে জানালেন, খানা তৈয়ার হ্যায়, লাগা দুঁ? সবাই সম্মতি দিলে খানা লাগানোর ব্যবস্থা হলো।

খানা লাগানোর সিস্টেমও আলাদা রকম। প্রথমে বড় বড় ডেকচি করে খাবার এনে রাখা হলো মাঝখানে।  তারপরে চারিদিকে দস্তরখান পেতে আমরা বসলাম।সবাইকে ঝকঝকে বোন চায়নার প্লেট দেওয়া হলো। ভাত, রুটি, পরোটা, ডাল, সব্জি, পালং শাক দিয়ে বানানো মাটন কারি, চিকেন কারি, আর আলুবোখরার চাটনি- এই হলো মেনু। সেল্ফ সার্ভিং, যে যেটা এবং যতটা প্রয়োজন নিয়ে নাও। ওরা সবাই পাশে বসে আছে, দরকার মতো তরকারি বা মাটনের হাঁড়ি এধার থেকে ওধারে এগিয়ে দিচ্ছে। শেষ হয়ে গেলে আবার পালটে নতুন হাঁড়ি নিয়ে আসছে। গল্প করছে। আচ্ছাসে খাও, আম্মিনে খুদ বানায়া। 

গল্পে গল্পে জানা গেল, ইফতিকার চাচার বড় ভাই ওখানকার সেক্রেটারিয়েটে (যা এখানকার রাইটার্সের সমতুল) ক্লার্কের চাকরি করে। মেজ ভাই উকিল, ছোট ভাই সরকারি রোডস ডিপার্টমেন্টে চাকুরি করে, আর ইফতিকার নিজেও চাকরি করে। 
সবাই প্রতিষ্ঠিত,  তাহলে এত কষ্ট করে কলকাতা গিয়ে রাস্তায় ফেরি করার দরকার কী? উত্তরে জানা গেল, দাদা পরদাদার ব্যবসা, আচ্ছা চলতা ভী হ্যায়, বন্ধ করনেকা দিল নহি হ্যায়। উসসি লিয়ে সর্দিমে ছুট্টি লেকে সব কলকাতা চলা যাতা হ্যায়। বোঝ কান্ড! আমাদের এখানকার রাইটার্সের বড়বাবু, যতই লাভ হোক না কেন, ছুটি নিয়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে মাথায় পিঠে গাঁঠরি বেঁধে রাস্তায় ফিরি করতে পারবে?

ইফতিকার চাচার সাথে যোগাযোগ ছিল ২০০৫-০৬ অবধি। তারপরে চাচা আর নিয়মিত আসতোনা। মাঝেসাঝে একটা চিঠির আদান প্রদান। সেটাও কালের নিয়মে বন্ধ হয়ে গেছে। হয়তো চাচার ছোট  ছোট ছেলে ভাইপোরা, যাদের দেখে এসেছিলাম, বড় হয়ে এ ব্যবসায় আর নামতে চায়নি। মনে পড়লে দুঃখ হতো। কিন্তু, এ বছরেই দেখলাম কয়েকজন তরুণ কাশ্মিরী শালওয়ালা খোদ পশ্চিমবঙ্গের বুকে কাশ্মিরী হওয়ার অপরাধে মার খেয়েছে। তখন মনে হলো, ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা। এই ঘৃণার বেসাতি করা ভূমি আমার দেশ না। এ'দেশে ওদের আসার দরকার নেই। 

তবুও শীতকাল এলে আমার ইফতিকার চাচার কথা মনে পড়বেই।

শীতকালের স্মৃতিচারণ করতে বসে বইমেলার কথা না বললে পাপ হবে। কিন্তু লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে, তাই সংক্ষেপে সারবো। প্রতি বছর বইমেলা আসার আগে থেকেই পরিকল্পনা।  কবে যাবো, কী বই কিনবো। ছ'মাস আগে থেকে হাতখরচ বা টিফিন খরচ বাঁচিয়ে রাখা, আর বইমেলার আগে মা'র কাছ থেকে বায়না করে আর এদিক ওদিক থেকে চেয়ে চিন্তে ফান্ড অ্যারেঞ্জমেন্ট করা। কোন একটা রবিবার দিদিদের সাথে যাওয়া, সারাদিন বইয়ের সঙ্গে কাটিয়ে সামান্য পুঁজি দিয়ে যা কেনা যায়, সেইসব বই কিনে ধুলোপায়ে অদ্ভূত একটা আনন্দ নিয়ে ঘরে ফেরা। তখন ভাবতাম,  কোনদিন যদি এত টাকা থাকে যে এক ঘর ভর্তি বই কিনতে পারি, ত্যহলে কী মজাই না হয়! এখন যখন অনেক বই কেনার ক্ষমতা হয়েছে, হয়তো বা কিনিও, চাইলেই অনলাইনে বই কেনা যায়, পিডিএফ ডাউনলোড করে পড়া যায়, কিন্তু সেই টিফিনের পয়সা জমিয়ে শরদিন্দু অমনিবাসের ছ'টা খণ্ড একসাথে কিনে গাদাগাদি ভিড় বাসে চেপেও সম্রাটের মতো বাড়ি ফেরার সেই আনন্দের কোন তুলনা আজও পাইনা। 

এখন যখন ফিরে তাকাই, মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, এত যে আনন্দ ছিলো ছোটবেলায়, তা কেন ছিলো? বোধ হয়, মনটাই তখন অন্যরকম ছিলো। তেঁতুলের বিচি দিয়ে জোড় বিজোড় খেলেও যা আনন্দ পেয়েছি, তা আমাদের ছেলেমেয়েরা ভাবতেও পারবে না। সামান্য সরঞ্জাম আর উপকরণ ছিলো খেলার। আমার ব্যক্তিগত মত, ভিসুয়াল মিডিয়ার আগ্রাসনের ফলে এখন বাচ্চাদের সেই সামান্য জিনিষে সন্তুষ্ট হবার পাট চুকে গিয়েছে। আর আমাদের খেলার জন্য অবারিত মাঠ ঘাট পুকুর ছিলো, হ্যাঁ, এই কোলকাতাতেও, কিন্তু, এখন বাচ্চাদের না আছে খেলার জায়গা, না আছে শৈশব। আমরা ব্যর্থ হয়েছি আমাদের বাচ্চাদের ঠিক সেই ছোটবেলাটা দিতে, যা আমরা নিজেরা পেয়েছিলাম।

এখনো প্রতীক্ষা করি শীতের। কারণগুলো হয়তো পালটে গেছে একটু। শীত আসলে একটু তরিতরকারি দাম কমবে,  নলেন গুড়ের সন্দেশ পাওয়া যাবে, রাত্রে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে অতটা হাল খেটে আসা গরুর মতো মনে হবে না নিজেকে, ডেঙ্গির অযৌক্তিক চাপ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে (কর্মক্ষেত্রে)। আর, সর্বোপরি, গতানুগতিকতায় শীতল হয়ে যাওয়া বহুব্যবহৃত সম্পর্কগুলো হয়তো একই কম্বলের নীচে এসে একটু উষ্ণ হয়ে উঠবে। অন্ধকারগুলো মুছে গিয়ে শীতের রোদ্দুরে আলোকিত হয়ে উঠবে।

ব্যাস, আর কি চাই?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন