মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

অর্পিতা বোস


শীতের  স্মৃতিচারণ
________________

  ___________


     এইযে পৌষের বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে আর শরীরের কাঁপন জানান দিচ্ছে বয়স বাড়ছে। আমি শীতের নরম মিঠে ওমে সেঁকে নেওয়ার চেষ্টা করছি নিজেকে। সাথে সাথে ফিরে ফিরে যাই আমার ছোটবেলার  সেই পৌষ-মাঘের শীতের বেলায়। 
তখন শীতকাল মানেই হরেক মজা। ফাইনাল পরীক্ষা শেষের ছুটি। সকালে ঘুম ভেঙ্গে কথা বলার সময় মুখ থেকে ধোঁয়া বের হওয়া নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে খুব মজা হতো।আর শীতের ছুটি মানেই অনেক অনেক গল্পের বই নিয়ে ছাদে সারাবেলা। শুধু কি গল্পের বই! নাহ্- মা-ঠাকুরমারা ছাদে বড়ি,আচার আর আমলকির নাড়ু শুকোতে দিতেন। আমরা পাহারা দেওয়ার নামে আচার আর আমলকির নাড়ু খেয়ে ফেলতাম। ঠাকুরমা জেনেবুঝেও বলতেন, কে যে আচার আর আমলকির নাড়ু খায় বুঝে পাইনা। 
 কৎবেল মেখে শুকোতে দিলে এসে দেখতেন এক চতুর্থাংশ খাওয়া হয়ে গেছে। 
 আরও আছে শীতের ছাদের গল্প। আমার আর ভাইয়ের ছিল খুব ঠান্ডা লাগার ধাত।তাই ঠাকুরমা রসুন-সর্ষের তেল গরম করে মাখাতেন আমাদের। আর শীতের স্নান করে আবার ছাদে দৌঁড়োতাম। শীত কাটাতে আর আমার কোমর ছাপানো চুল শুকোতে। আর খাওয়া সেরে আবার ছাদে এমন নরম মিঠে রোদ মেখে ফেলুদা, শুকতারা, আনন্দমেলা, কাকাবাবু-সন্তু,পান্ডব গোয়েন্দা,অথবা letter from a father to his daughter, Malgudidays, Dairy of a Young Girl, Discovery of India, The  story of my experiment with the Truth এমন সব গল্প কাহিনীর মাঝে হারিয়ে যাওয়া কমলালেবুর রসের আস্বাদন নিতে নিতে। 
আর পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলো বাবার তৈরি ছাদবাগানের গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা ফুলের ওপর রঙের খেলায় নামত। নারকেল পাতার ফাঁকে লুকোচুরি খেলার ছলে সূর্যাস্ত হতো। আমাদের তখন খেলা সেরে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে টিফিন খাওয়ার সময়। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, তাই ছাদে আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা অথবা খুব ঠাণ্ডায় ঘরের ভেতর জমিয়ে লুডো-ক্যারামের সেই সন্ধ্যারা হারিয়ে গেছে আজ।
এছাড়া শীতকাল মানেই পিকনিক,সার্কাস, চিড়িয়াখানার মজা তো ছিলই। সবাই মিলে সার্কাসের জোকারের মজা বা বাঘ-সিংহের খেলা আর ট্রাপিজের খেলার সেই শিহরণ আজও ভোলা যায়না।  চিড়িয়াখানা যাওয়া হতো দলবেঁধে সকালে সকলে মিলে। ওখানেই সারাটাদিন খাওয়া দাওয়া,খেলা, পশুপাখিদের ছোলা খেতে দেওয়ার দেদার আনন্দ সেরে বাড়ি ফিরে ঠাকুরদার নির্দেশ ছিল- ইংরেজিতে কমকরে ২০ লাইন ও বাংলায় বড়ো রচনা লেখার জন্য সারাদিন চিড়িয়াখানার ও সার্কাস দেখার অভিজ্ঞতার। একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা হতো ভাইবোনদের মধ্যে কার লেখা ভালো হবে তা নিয়ে। এরপর আসতো রেজাল্ট আউটের বুকের দুরুদুরু ভয়ে স্কুল যাওয়া। যদিও রেজাল্ট ভব ভালো-মন্দের সমালোচনার পরে অবশ্যই শুনতাম- " আরও ভালো করতে হবে পরের বার। তুমি পারবে।" 
আর তারপর ঘোষণা হতো পিকনিকের ডেটের ।
যৌথ পরিবারের  রোজই  কুড়ি-বাইশজনের পাত-পেড়ে খাওয়ার জন্য রোজই পিকনিক ভাবা যায়। কিন্তু তবুও আমাদের পিকনিক শীতকালে হতই। নাহ্, খুব দূরে সবসময় যাওয়া হতো না পিকনিকের জন্য। বরং আমাদের বিরাট ছাদেই একদিন বিছানার চাদরের চাঁদোয়া টাঙিয়ে হতো পিকনিকের দেদার মজা। পিসি -পিসতুতো ভাইবোনেরা মিলে লোকসংখ্যা তখন পঞ্চাশ ছুঁয়েই যেত। বাবা-কাকাদের রান্নার গন্ধে চারদিক ম-ম করতো। এমন পিকনিক ছাড়াও যে আরেকটা জমজমাট মজা ছিল আমাদের পুরী ভ্রমণ । হ্যাঁ ,প্রায় প্রতি বছরই   ছাব্বিশে অথবা সাতাশ  ডিসেম্বর আমরা সপরিবারে জগন্নাথ এক্সপ্রেস করে পুরী যেতাম। ইউনিয়ন ব্যাংকের  হলিডে হোমে রুমগুলো  বরাবর এইসময় চিনিকাকুর নামে  বুক করা থাকতো। পুরীতে বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখে আবার ট্রেনে উঠতাম। আর নতুন বছরের সূর্যোদয় কলকাতায় দেখতাম।
 এভাবেই নতুন বছরের শুরু হতো। আর স্কুলে নতুন ক্লাস, নতুন বইয়ের গন্ধরা মিলে যেত জয়নগরের মোয়ার স্বাদে। হ্যাঁ, স্কুল ফাউন্ডেশন ডের জন্য প্রথম দিন আমাদের জয়নগরের  মোয়া দেওয়া হতো।
এরপর আসতো পৌষ-পার্বন। নলেনগুড়ের পায়েস, পুলিপিঠের  আনন্দ উৎসবও  শীতের মজার আরেক ছবি। সারাদিন ধরে পিঠে পায়েসের গন্ধে বাড়ি ম-ম করতো। তারপর হতো স্কুলের পাশের মাঠে বারোভুতের মেলার মজা। হাতভরে কাঁচের চুড়ি, পুতুলের বিয়েতে দেওয়ার জন্য খাট- আলমারি- আলনা-ড্রেসিং টেবিল, রান্না বাটি খেলার বাসনকোসন,এই সব কেনার মজা আজ হারিয়ে গেছে।
তারপর নতুন ক্লাসে পড়াশোনা শুরু কিন্তু অপেক্ষায় থাকতাম বীণাপাণির বন্দনার দিনের। আমার মতো ফাঁকিবাজ স্টুডেন্টদের উনিই ভরসা। শুধু কি পুজোই! নাহ্! আরও ছিল অনেক অনুভূতি। কাকিমা- মাসিদের শাড়ি আর ব্লাউজের সাথে সেজেগুজে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো। যৌথ পরিবারের কড়া শাসন মুক্ত সেই সরস্বতী পুজোর সেই নস্টালজিক অনুভব কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। 
সরস্বতী পূজোর সাথে সাথে শীতের প্রভাব কমতে থাকতো। 
আর তখন মনে আর প্রকৃতিতে লাগতো বসন্তের নতুন ছোঁয়া। তবুও সেই শীতের স্মৃতির হাওয়া আজও ছুঁয়ে যায় আমায়। আমিও ফিরে ফিরে যাই আমার সেই শীতবেলার পথে...

চিত্র - সমরেন্দ্র মন্ডল 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন