মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

তিমিরণ দত্তগুপ্ত




***ছাতা****
বাবা এই ঘর,সেই ঘর খুঁজেই চলেছেন।কিছুতেই পাচ্ছেন না।মুখে অস্থিরতা,একটা যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট।বারবার হাত উল্টে ঘড়ি দেখছেন।অফিস যাওয়ার সময় গড়িয়ে চলেছে।অথচ,জিনিষটাই পাওয়া যাচ্ছে না।আলমারির মাথা,জুতো রাখার তাক….কোথাও নেই।মা,আমি,দিদি আর পিসি হাঁ করে তাকিয়ে আছি।কারুর মুখে কোন কথা ফুটছে না।মা একবার মৃদুস্বরে বলেই ফেললেন,“থাক না এখন।বাইরে তো তেমন রোদ নেই।আজ না হয় না নিয়ে গেলে।কোথাও একটা আছে,আমি খুঁজে রাখবোখন”।

বাবা হাঁটু মুড়ে খাটের নিচে দেখছিলেন।ওইভাবেই ঘুরে মা’র দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,“না নিয়ে যাবো?অসম্ভব,এতদিনের অভ্যেস পাল্টাবো কীভাবে”?

ধমক খেয়ে মা পিসির দিকে আড়চোখে তাকালেন,“দিদি আপনিই বলুন না”।

পিসি বার দু’য়েক বাবার দিকে তাকালেন।কিছু বলতে ভয় পেলেন বোধহয়।আন্দাজ করেই বাবা বললেন,“দিদি তুমি দয়া করে আর কথা বাড়িও না।জানই তো সব।ছাতা শুধু রোদ,জল আটকানোর জন্য নয়।একটা আশ্রয় বুঝলে।হাতে ছাতা না থাকলে কনফিডেন্স লেভেলটাই নষ্ট হয়ে যায়”।

বাবার একটা আদ্যিকালের কালো রঙের ঢাউশ ছাতা ছিল।আমার ধারণা ওটা কয়েক পুরুষের।দু’এক জায়গায় তাপ্পি মারা।অফিস,বাজার,এমন কি দিনের বেলায় অনুষ্ঠান বাড়িতেও বাবার সাথী।বেশ কয়েকবার দেখেছি ছাতাটা মাটিতে ভর দিয়ে বাবা বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন আত্মবিশ্বাসী মুখে।

আমি কোনকালেই ছাতা ব্যবহার করিনা।ছাতা নিয়ে বেরোলে হারানোর সম্ভবনা একশো ভাগ নিশ্চিত।এই নিয়ে বাবার অভিযোগের শেষ ছিল না।তবুও বলতেন,“খোকা বাইরে কড়া রোদ।ছাতা নিয়ে যাও।খোকা,

বৃষ্টি পড়ছে।জল মাথায় পড়লেই আর দেখতে হবে না”।

যথারীতি আমি শুনতাম না।আর,আমার ছাতা হারানোর বহর দেখে ধীরে ধীরে বকাবকিও বন্ধ হয়ে গেল।

গতকাল ছিল রবিবার।বাবা বাজার থেকে ফিরলেন এক হাতে ব্যাগ,অন্যহাতে ছাতা ঝুলিয়ে।ঘরের বাইরে একচিলতে জমিতে অন্য কয়েকটা গাছের সাথে অযত্নে বেড়ে ওঠা একটা কদম ফুলের গাছ।ছুটির দিন বাবা ওখানেই একটা নিচু ডালে ছাতা ঝুলিয়ে রাখতেন।স্নানের সময় ওটা পরিষ্কার হতো।মাথার উপর মেঘলা আকাশ।থেকে থেকে একটা দমকা হাওয়া দিচ্ছে।গাছের ডালে মলিন কালো ছাতাটা দেখে মনে হল,অনেক রোদ-বৃষ্টির গল্প নিয়ে এখন ঘুমোবে।

আমি ক্লাবে আড্ডা দিতে যাচ্ছিলাম।হাত বাড়িয়ে বাজারের ব্যাগ নিতে যেতেই বাবা আঙুল দিয়ে ছাতাটা দেখিয়ে বললেন,“তুমি বরং ওটা নিয়ে যাও।বৃষ্টি আসতে পারে”।

আমি ব্যাজার মুখে ছাতাটা বগলে চেপে বেরোতে বেরোতে শুনলাম বাবা সহাস্যে বলছেন,“কোথাও ফেলে এসো না যেন”।

আমার স্বভাব যাবে কোথায়!সন্ধেবেলা ক্লাবঘর,বন্ধুর বাড়ি ঘুরেও সেই আদ্যিকালের ছাতা পাওয়া গেল না।বাবার ভুলো মন।কখন আমাকে দিয়েছেন সে কথাও মনে নেই।

বাবা ব্যাজার মুখ করে খালি হাতে অফিসে বেরোনোর পর দিদি আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,“এটা নির্ঘাত তোর কাজ।”

সন্ধেবেলা বাবা থমথমে মুখে ঘর ঢুকলেন।চা নিয়ে এসে মা জিজ্ঞেস করলেন,“কী হয়েছে?”

“এই প্রথম অ্যাটেন্ডেন্সে লাল দাগ খেলাম”,বাবা সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন।

বাবার চোখে সবসময় একটা হাসি দেখতাম।আত্মবিশ্বাসী হাসি।দরজার আড়াল থেকে আজ সেই হাসিটা খুঁজে পেলাম না।ভীষণ এক অন্যমনস্কতা এবং বিষণ্ণতা মাখানো মুখ।বেশিক্ষণ সেদিকে তাকানো যায় না।একটা ছাতা হারালে মানুষ এত সর্বশান্ত হয় জানতাম না।মা দরজার দিকে ফিরে আমায় ডাকলেন,“আয় না।”

আমি দোকান থেকে বাবার জন্য একটা নতুন ছাতা এনেছিলাম।রঙ্গীন,বাহারি ফোল্ডিং ছাতা।ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে এগিয়ে দিতে নির্লিপ্তভাবে দেখলেন।তারপর আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,“তোমার দিদিকে দিও।ওর কাজে লাগবে।”

মা মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,“তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি।ছেলেটা নিজে পছন্দ করে কিনে এনেছে।ব্যবহার করলেই হয়।”

বাবা দীর্ঘ করে নিঃশ্বাস ফেললেন।সামনের জানালা দিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন।তারপর একটা করুণ হাসি ঠোঁটের গোড়ায় ঝুলিয়ে বললেন,“এতদিন সংসার করলে।আর এইটুকু বুঝলে না?”

পরেরদিন অনেক খুঁজে কলেজস্ট্রীট থেকে ওইরকম একটা ঢাউশ,কালো,বাকানো কাঠের হাতলের ছাতা পেলাম।বাবা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।বারকয়েক খুললেন,বন্ধ করলেন।আমরা দমবন্ধ করে বাবার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছি।ছাতাটা বন্ধ করে আমার হাতে দিয়ে একটু হাসলেন,“টেবিলে রেখে দাও।কাল নিয়ে যাবো।”

পরের দিন খেয়েদেয়ে ছাতা হাতে নিয়ে অফিসে বেরোলেন।মা,দিদি হাসি হাসি মুখ করে দেখছে।পিসি হাতজোড় করে প্রণাম করে বললেন,“ঠাকুর,ঠাকুর।”

আমিও বাবার চলে যাওয়া দেখলাম।সেই ছাতা দোলাতে দোলাতে চকচকে জুতো পায়ে মশমশ করে আত্মবিশ্বাসী হাঁটা নয়।বগলে ছাতা নিয়ে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে গলির মুখে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

বাবার দুর্ঘটনার খবর পেলাম সন্ধের মুখে।রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কা খেয়েছেন।ভিড় সরিয়ে সামনে গিয়ে দেখলাম উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।থ্যাঁতলানো মাথা,হাঁ মুখের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে।ডান হাতের মুঠোয় তখনও সদ্য কেনা ছাতার হাতল।

দিন কয়েক পরে শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করে ফিরছি।বেশ রাত হয়েছে।হবিষাণ্ণ খেয়ে খেয়ে শরীর দূর্বল।সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ।কখনও সখনও এক-আধ পশলা বৃষ্টিও হয়েছে।বড় রাস্তার মুখ থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে মিনিট পনেরো লাগে।রাস্তার বাতির ম্লান আলোয় ভাল করে কিছু দেখা যায় না।হঠাৎ করেই তুমুল বৃষ্টি নামলো।কাছাকাছি কোন রিক্সাও দেখতে পেলাম না।দৌড়ে সামনের বন্ধ দোকানের শেডের তলায় পৌঁছনোর আগেই ভিজে একসা।পরনের কোরা কাপড় ভিজে জবজবে,মাথা দিয়ে জল গড়াচ্ছে।ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতেই ঘাড়ের কাছে একটা তপ্ত নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পেলাম।চমকে মুখ ঘোরাতেই দেখি কাঁচা-পাকা দাড়ি মুখে এক বৃদ্ধ।লম্বা,ঢাউশ এক ছাতা মাথার উপর মেলে বললেন,“এমন বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া কেউ বেরোয়।”

আমি কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।এখানে আশ্রয় নেওয়ার সময় কাউকে দেখিনি।বললাম,“বৃষ্টি হবে বুঝতে পারিনি।”

হালকা অন্ধকারেও বুঝলাম ভদ্রলোক হাসলেন।বললেন,“কোন কিছুই কী আগে ঠিক করা থাকে।তবু প্রস্তুত থাকা ভাল।কখন কী হয়ে যায় কে জানে।ছাতা একটা আশ্রয়,হাতে থাকলেও বল ভরসা।চলো,তোমাকে এগিয়ে দেই।”

আমি বাধা দিয়ে বললাম,“না,না।তার দরকার নেই।বৃষ্টি থামলেই চলে যাবো।”

বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার হাত ধরে টান দিলেন,“এই বৃষ্টি থামবার নয়।তোমার অশৌচ চলছে।বৃষ্টির জল মাথায় পড়লেই হলো।এখন একটু সাবধানে থাকতে হয়।”

বাড়ির সামনে আসতেই বৃষ্টি থেমে গেল।কদম গাছের তলায় একটা কাঠের বেঞ্চি।গাছের কয়েকটি পাতা পড়ে আছে।বাবা ওখানে বসে চা খেতেন।মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদ উঠেছে।চাঁদের আলো ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে মলিন হল সামান্য।কদম গাছের ছায়া যেন সামান্য হেলে বেঞ্চির উপর এসে পড়েছে।একটা কাঠবেড়ালি কদম গাছের ডাল বেয়ে উঠতে উঠতে একবার থমকে দাঁড়ালো।বৃদ্ধ ভদ্রলোক সেইদিকে তাকিয়ে ছাতা বন্ধ করে ভেজা কাঠের বেঞ্চিতে বসে অস্ফুটে বললেন,“বড় মায়া হে।ছেড়ে যেতে মন চায় না ।”

বললাম,“কিছু বললেন?”

“একটু জল খাওয়াতে পারো খোকা?”

‘খোকা’ ডাক শুনে একটু অবাক হলাম।বললাম,“ভিতরে আসুন না।”

ভদ্রলোক হাত তুলে মানা করলেন,“আগে মায়ের সাথে দেখা করে এসো।সদ্য বিধবা মা,তোমার পথ চেয়ে বসে আছেন।তুমিই তো এখন আশ্রয়।জল খেয়েই চলে যাবো,অনেকটা দূর যেতে হবে।”

ঘরে ঢুকে মাথা মুছে জল আনতে সামান্য দেরী হলো।বাইরে বেরিয়ে দেখলাম কেউ কোথাও নেই।কিছুক্ষণ আগেও বৃদ্ধ ভদ্রলোক এখানে এই কাঠের বেঞ্চিতে বসেছিলেন।ভেজা মাটিতে এখনও স্পষ্ট পায়ের ছাপ।অথচ,মানুষটিই নেই।আমার আসতে দেরী হওয়ায় বোধহয় অভিমান করে চলে গেলেন।ফিরে আসছিলাম।হঠাৎ চোখ গেলো কদম গাছের নিচু ডালের দিকে।দেখি একটা কালো,মলিন,ভেজা ঢাউশ ছাতা সেখানে ঝুলছে।ছাতাটা হাতে নিয়ে ঘরে এলাম।যদি ভদ্রলোক ফিরে আসেন কখনো।

আমার ছেলে ছাতা পছন্দ করে না।ওর সুন্দর রেইন কোট আছে।আমি এখন একটা লম্বা,কালো ছাতা নিয়ে বাজারে যাই,অফিসে যাই।বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগে।মনে হয়,বাবার হাত ধরে হাঁটছি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন