মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

শুভশ্রী সাহা



পিকনিক--

ইউক্যালিপ্টাস গেট, বটলব্রাশ হাসি,  আর  জ্যাকরান্ডার আভা  নিয়ে আদুরে বাগান বাড়ি টা আজ  পিকনিক রোদে মাখামাখি।। পুট্টুস ঝোপের পাশে বসেছে মস্ত উনুন। হাজারীবাগের লাল ধুলো আর পর্ণমোচী পাতা পেরিয়ে চার চাকা অভিজাত আম্বাসাডার ভারী পায়ে ঢুকে এলো  বাংলোর হাতায়।

-- কিহে,  আমার সুন্দরী শ্যালিকাটি কই ! জরি পাড় লুটোনো ধুতি আর তসরের খসখস ভাঁজের খৈয়াম পাঞ্জাবি! লপেটা ভাজের চোখ!  গুণগুনে আখতারি গজল
অমল কান্তি চোখ তুলে দেখলো  মাইকা কিং  সমরেন্দ্র নাথ সিংহ কে। অমলের পরমা সুন্দরী স্ত্রী  মঞ্জুলিকার জামাই বাবু।
-- আসলে আমি তো এদিক টায় ব্যস্ত বলে আর--
--বেনারসী পানের তবতবে জরির  খিলি মুখে পুরলো সিংহি মশাই,
--ওহে, শুধু ভাব জগতে বিচরণ করলেই হবে! বউ এর খবর সবরও রাকো! মঞ্জুলিকে না সামলাতে পারলে তো   আমাকেই দায় নিতে হয়!   হে হে হে! কচি শালী বলে কতা!  কি বলো!

-- অমল কান্তি চোখ নামিয়ে নিলো! ছি! ছি! রুপ বা অর্থ  থাকলেই কি রুচি হয়! সে এখন বুঝে গেছে মঞ্জুলিকা তার পাত্রের পানীয় নয়।  গেটের দিকে ফিরলো সে , অভ্যাগত রা আসা শুরু করেছেন একে একে! আজ রাঁচী আর হাজারীবাগের তাবত লোকজন অভ্র খনির গুলির একছত্র মালিক সমরেন্দ্র সিংহের অতিথি!

--শোনো ভাই, কাল যে শিকার করে বগারি গুনো মারলুম, সেগুনো কি কচ্চ শুনি! দাও, একটু স্কচ ফচ হোক! বুইলে ভায়রা,আজ রাতে গান শোনাতে যে আসবে না! আহা!  যমুনা রাই শেখাবত! কি চ্যায়রা মাইরি! নাজুক! অশ্লীল ভাবে চোখ মারল মাইকা কিং!
 আরেরর! কেয়া বাত! মহেন্দর সিং জী! আপ আ গয়ে, মেরা লাইফ ই বন গয়ে জনাব!!  এগিয়ে গেলো সমরেন্দ্র  হাজারীবাগের এস পির দিকে!

---- আহ! বগারি  পাখির বুক টা কি নরম! যখন মঞ্জুলিকা নবোঢা ছিল এমন ই ছিল তার কবুতরী বুক! সে সব তো কবেকার জ্যোৎস্না ময়  দিন--,শ্বাস ফেলল অমলকান্তি!

বারান্দা পেরিয়ে  সে রান্নার জায়গায় এলো। কেজি কেজি মাংস, শোন নদীর মাছ,  ফুলকপি, রাঁচির ক্ষীরের মিষ্টি, খান্দেলাল  চিৎকার করে বকছে,
-----  -----আরে ক্যা রে শালে লোগ! সোমর সিন বাবুয়া কা পিকনিক! থোড়িসি তো আলগ হোনা চাহিয়ে কি নহি রে!

আজ দিনটাই অন্য রকম!  ভোরের ভৈরবীর মত সাধন মার্গের। শীতের শুকনো খসখসে ভাব পেরিয়ে পিলুর মতো দরদিয়া কোমল নিষাদের বিস্তার। ঘুমিয়ে থাকা শৈশবের গায়ে এস্রাজের ছড়ের টান পড়ছে তার! মা বাবা কাকারা ফুল পিসি,  নায়েব কাকু,    বড় পাহারিয়া ঝোরার নিচের সেই সাদা কালো পিকনিক, পিসতুতো বোন  দীপাঞ্জলিকে  নিষিদ্ধ চুমু! 
 কি দরকার ছিল দীপাকে তার বোন হয়ে জন্মানোর!   পিসি বুঝতে পেরেছিলেন আর পিসেমশাই দিয়েছিলেন শাস্তি। বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দীপাকে দূর বহু দূর! সামান্য এক মুহূর্তের দুর্বলতার জন্য দীপা ভেসে গেছিল!  আর অমলকান্তি জীবনভর  থিতু হতেও পারেনি কোথাও। পিকনিকের এই  বিষাদের  সিপিয়া এফেক্ট সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে!
 অমলকান্তি যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল তার স্পর্শে।

আজ ও সেই আলোই! যে যাই বলুক,আবার এমন দিনেই যে রিক্ত নি:স্ব হতে হতে পূর্ণতা আসে! অমলকান্তিরা হাত পাতে দীপাঞ্জলিদের কাছে!  ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছা  করে সবাই কে। এমন কি মঞ্জুলিকাকেও!!

হাওয়াতে ভাসছে  ঘি আর গরম মশলার বাস! চার্চের দিক থেকে আসছে ক্যারলের ওয়েলকাম সং

সময় পালটে যায় নিয়মেই। তবু প্রত্যেক শীতেই  ফেরে বনভোজন, বোরোলিন দিন বুকে নিয়ে।


ছবি জয়ন্ত চক্রবর্তী 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন