মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

শৈবাল চক্রবর্তী

।। উচাটন ।।

                          শৈবাল চক্রবর্তী

(এক)

সিঁড়ির নীচে,  অন্ধকার কোনা থেকে,  ছোটো ছেলেটার প্রায় নিরুচ্চার কান্নার শব্দটুকুও এখন থেমে গেছে। সদর দরজার বাইরে তখন আগত সন্ধ্যার বিবিধ চাঞ্চল্য। বাতিস্তম্ভের ডুমো ডুমো লালচে আলোগুলো একে একে সব জ্বলে উঠেছে। বাড়ির সদরের মুখোমুখি ফুটপাথে, টাইমকলের সিংহমুখ থেকে জল তখনো তোড়ে পড়ছে। পাড়ার ছেলেরা রবারের ফুটবল পেটানো সাঙ্গ করে একে একে  হাত মুখ ধুয়ে জল খেয়ে নানা কথার ফোয়ারা ছোটাচ্ছে। সামনে পথে ঠুন ঠুন করে দু'চারটে রিকশাওলা সওয়ারি নিয়ে যাতায়াত করছে। শোনা যাচ্ছে কুলপি - মালাই গাড়ির বড় ঘন্টার ঠং ঠং শব্দ। গৃহস্থের ঘরে ঘরে বেজে উঠছে সন্ধ্যারতির শাঁখ।
দিনের অবসানে, আলো আর আঁধারের এই সন্ধিক্ষণে, সিঁড়ির নীচের সেই কোনে, নিরাবরন ছেলেটি তখন গুটিশুটি মেরে বসে, মশার কামড় উপেক্ষা করে, শুধু তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে ভর দিয়ে পথে পৌঁছে গেছে। সাময়িক কষ্ট ভুলে মন তার ভেসে গেছে বাইরের শব্দ কল্পনায়।
এমন একটা সময়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে গুপির আগমন। সঙ্গে তার নিজের একটা প্যান্টুল আর গেঞ্জি। তাই দিয়ে অবশেষে ছেলেটির লজ্জা নিবারণ। তারপর গুপির সঙ্গে তিনতলায় ওদের ঘরে গিয়ে সাময়িক সুস্থিতি আর রাতে গুপির মা খাইয়ে দাইয়ে যখন নিজে সঙ্গে করে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসলেন, সেদিনের মত দু:স্বপ্নের যবনিকা পতন।

মারাত্মক অপরাধ কিছু করেনি সে। দিনটা ছিল রবিবার। বাবা সকালে কোথাও বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গিয়েছিল -- " পূজো পূজো করে অনেক ফাঁকি হয়েছে। এবার মন দিয়ে পড়াশোনা কর। একদম চৌকাঠের বাইরে পা দেবে না "
ছেলেটা বোঝেনি।  বাইরে বেরোনো নিষেধ তাই দোতলায় ওদের ঘরের সামনে এক ফালি যাতায়াত পথ জুড়ে সে আর গুপি বিকেলে বল নিয়ে খেলছিল। সন্ধ্যার মুখোমুখি বাবা ফিরতেই সামনে পড়ে গেল। নিষেধের আক্ষরিক অর্থ না মানায় যে লাঞ্ছনা শুরু হল, তা শেষ হল তাকে পোষাকহীন অবস্থায় ঘরের বাইরে বার করে দিয়ে। মায়ের আটকানোর কোনো চেষ্টা ফলপ্রসু হল না। অগত্যা চুপিচুপি সিঁড়ির নিচের অন্ধকার কোনায় তার আশ্রয়।

দাদু অনেক আহ্লাদে তার নাম রেখেছিলেন সৌম্যসুন্দর। সকলের ডাকখোঁজের সমু। হাতিবাগানের ডালিমতলায় মামার বাড়িতে ছোটোবেলাটা বেশ কাটছিল। দাদু, দুই মামা, ছোটোমাসী সকলের মাঝে ছোটো বলতে ও  একাই তাই আদরের। মা চাকরি করত। বাবা থাকত না, মাঝে মাঝে আসত আর গম্ভীর মুখে মন দিয়ে পড়াশোনার কথা বলত। সমু তার মামা, দাদুর স্নেহে, প্রশ্রয়ে দিব্যি ছিল। কিন্তু  কোথা থেকে যে কি হল, তার বাবা এক দিন  মা ছেলেকে নিয়ে ডালিমতলা ছেড়ে এই বাড়িতে ভাড়া নিয়ে চলে এল। এই ব্যবস্থা নাকি খুব জরুরী, না হলে ছেলে মানুষ হবে না। আসার সময় দাদু নাতির চোখের জল মিলেমিশে একাকার। ছোটোমামা তখন শহরের বাইরে আর মেজমামা সে'দিন অভিমানে ইচ্ছে করে সামনে থেকে সরে রইল।

এলাকাটা উত্তর কলকাতার মানিকতলা অঞ্চলে। রাস্তাটার নাম-- ওয়ার্ডস ইন্সটিটিউশন স্ট্রীট। বাসা বাড়িটা পাড়ার মাঝামাঝি অংশে। তিন শরিকের বাড়ি। সমুরা ভাড়া থাকে ছোটো ভাই-এর ভাগে, দোতলার একটা ঘরে। আরো দুই ঘর ভাড়াটের সঙ্গে একসাথে পায়খানা, স্নানঘর ব্যবহার করতে হয়।
এবার আমূল পাল্টে গেল সমুর জগত। পালটে গেল রোজকার জীবন। এখন সক্কাল বেলা, লোকজন সবে মোটা পাইপ দিয়ে চাপাকলের গঙ্গাজলে রাস্তা ধুয়ে যেতে না যেতেই স্কুলে বেরিয়ে পড়তে হয় তাকে। সঙ্গে যায় নস্কর কাকু, বাবার ঠিক করে দেওয়া লোক। সে ছুটির পর দুপুরে নিয়েও আসে। ঘরে পৌঁছে দিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রেখে যায় তাকে। সেই রকমই ব্যবস্থা। মা তো অফিসে। বাবাও কাজে বাইরে। মা বুঝিয়েছে, এই ছোটো বয়সে বাইরে এলোমেলো ঘুরে বেড়ালে শরীর খারাপ হয়, দুষ্টু লোক ভুলিয়ে নিয়ে যেতে পারে।  তাই সমুর জন্য থাকে ওই একটা  ঘরের চারটে দেওয়াল, তার একদিকে একটা জানালা, যে'খান থেকে শুধ বাড়ির অভ্যন্তরীণ সিঁড়িপথ দেখা যায়। আর একদিকে একটা ছোটো ভিতর বাড়ির বারান্দা, যার সামনে ডাইনে বাঁয়ে শুধু বার-বাড়ির দে'য়াল আর  উপরে এক চিলতে আকাশ।
মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে দাদু দেখা করতে আসেন। সমু সিঁড়ি দিয়ে লম্বা মানুষটাকে দেখলেই ঘরের দরজার কাছে লাফিয়ে চলে যায়। অনেক কথা আছে দাদার সঙ্গে। অনেক অনেক প্রশ্ন জমে আছে।  তর যে আর সয়না। দেওয়াল ও   দরজার এপার ওপারে  দাদু আর নাতির  আলাপচারিতা দীর্ঘায়িত হয়েও হয়না বেশী লোক জানাজানির ভয়ে।
সমু ছোটো, তাই বোধহয় এই প্রাচীর  লঙ্ঘন করতে না পারার অক্ষমতাকে উজিয়ে নিজের মত করে বেঁচে থাকে কংক্রিটের খাঁচায়। স্কুলের দিনে তবু একরকম। ফিরে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু বড় ছুটি পড়লেই সমস্যা। তখন  নিজের সঙ্গী সে নিজেই। খেলা চলে ডান হাতের সাথে বাম হাতের, ডান পায়ের সাথে বাম পায়ের নিজের তোমার সাথে নিজের আমার। আর সঙ্গী আকাশবাণী -- একটা রেডিও, সঙ্গে একটা জলচৌকি, যেটাকে সে ঘরের একটা মাত্র জানালার ধাপিতে বসিয়ে রাখে।  বাড়ির সদর দিয়ে ভিতরে ঢুকেই সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে  যত লোক আসা যাওয়া, সবার সঙ্গে সমুর ওই চৌকিতে বসে যত কথা।
 শুধু সন্ধ্যা নেমে এলে অস্থির হয়ে উঠত ছেলে। মায়ের কোনোদিন ফিরতে দেরী হলে কখনো জানালায় লেপ্টে  সিঁড়ির গোড়ায় ঘোলাটে আলোয় ছায়া পড়ার অপেক্ষা, কখনো বিছানায় বসে বসে চোখ বুঁজে, দুটো হাত এক জোটে  মুঠো করে,  একশ, দু'শ, পাঁচশ গোনা। নাফুরন্ত সময় তখন উগরে দিত অশনি আতঙ্ক।
অথচ সমুর জীবন তো ঝরনার ঝোরা জলের মত  কলকল ছলছল ধারে বয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা তো হল না। সময়ও থেমে থাকেনি। দিন, মাস, বছর ঘুরে ঘুরে যায়। শুধু পলি পড়ার মত জমা হতে থাকে বাবার ওপর অন্ধ রাগ, মায়ের ওপর অবুঝ অভিমান।
তারপর,এক দিন সমুর সব আগল ভাঙ্গে। সে ঘর ছেড়ে পালায়। মায়ের আলমারি থেকে দরজার বাড়তি চাবিটা সুযোগ মত সরিয়ে গুপিকে জানালা দিয়ে চাবিটা ফেলে দেয়। সঙ্গে নেয় আলমারি থেকে সরানো কিছু টাকা। তারপর নিরুদ্দেশ যাত্রা। বাসে করে শিয়ালদা স্টেশন। বিনা টিকিটেই হাতের সামনে নৈহাটি লোকালে চেপে তার শিকল ছেঁড়ার হাতেখড়ি।
এরপর সে বহুবার ঘর ছেড়েছে। বাবাও শেষে হাল ছেড়েছে, সব বাঁধন আপনিই গেছে খসে। শুধু সমুর মায়ের জীবন যন্ত্রনা বাড়তে থেকেছে। সময় সময় শরীর বিদ্রোহ করেছে। গোঁয়াড় স্বামী, অবুঝ ছেলে। এক অনিশ্চয়তার বাতাবরনে শরীর আর মন, একে অপরকে যেন পালা করে ভাঙ্গতে থেকেছে।

(দুই)

এরপর বয়ে গেছে কালের স্রোতস্বিনী। সমু আজ আর প্রায় নেই মানে ও নামে ডাকার লোক আর বিশেষ নেই। এখন সৌম্যসুন্দর বসু অফিসে কারো স্যার, কারো সৌম্যদা। নিজের বাড়ি করে চলে গেছে গড়িয়ায়, তাও বছর কুড়ি হল। সেখানে পাড়ায় সে সকলের বোসদা।

আজ পয়লা নভেম্বর। মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। সারাদিনের পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপ মিটিয়ে  চুপ করে অন্ধকারে বারান্দায় বসে আছেন। ছেলে তার নিজের ঘরে কারো সাথে ফোনে ব্যাস্ত। স্ত্রী সুধন্যা স্বামীর পাশে বসে।                               আস্তে বললেন -- " একটু চা দেব?"
সাড়া না পেয়ে স্বামীর পায়ে ধীরে একটা হাত রাখলেন। অনুভুতিপ্রবণ মানুষটা গভীরে ডুব দিয়েছেন তাই চুপসাড়ে তাকে ছুঁয়ে বসে রইলেন।
অনেকটা সময় বয়ে গেলে সৌম্য ধরা গলায় বললেন -- " জানো সুধা, মাকে শেষে আর আমার বলা হলনা "
-- " কি? "
" কতবার ভেবেছি বলব তবু বলে উঠতে পারিনি। সেই যে'বার, বলেকয়ে চলে যাচ্ছি বাড়ি থেকে, মা আমায় কিছুতেই যেতে দেবেনা। আমার ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। আমি হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। "
-- " থাক, আমি জানিতো। অনেকবার বলেছ। তখন তোমার কিবা বয়েস "
-- " কিন্তু সুধা, আমার সে'দিনও  ভীষণ  কষ্ট হয়েছিল। আমি যাচ্ছি, মা পিছনে আসছে। আরো, আরো জোরে হেঁটে চলে গেছি। পাড়ার মোড় ঘুরে বাড়ির আড়াল থেকে দেখেছি, মা বহু দূরে হালছেড়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ কষ্ট সুধা, ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছিলাম কিন্তু আমার পা দুটো কিছুতেই ফিরল না সুধা.....কিছুতেই ফিরল না ! "
সুধার চোখ ভিজে ওঠে। মানুষটার এতটা বয়স হল, তবু শিশুর মত........ 
-- " নিজেকে ধ্বংস করে প্রতিশোধ নাকি ভেঙ্গে চলার নেশা, আজও বুঝে পাইনা।" সৌম্য বিড়বিড় করে বলতে থাকেন।  " কত দিন, কতবার ভেবেছি বলব মাগো, আমি চাইনি তোমায় কষ্ট দিতে, আমায় ক্ষমা কর অথচ দেখ, কিছুতেই আমার মুখ ফুটলো না। এই কথাটুকু এতদিনেও বলে উঠতে পারলাম না। "
সুধা নি:শব্দে ছুঁয়ে রইলেন পাশের মানুষটাকে।

বড় উচাটন মন নিয়ে রাতে শুতে গেলেন সৌম্য। ঘুম যেন আজ মহার্ঘ।  স্মৃতিরা ভিড় করে এসে তার অস্তিত্বের দখল নিতে চায়। সেইসব মেদুর আলোছায়া মায়াবী স্বপ্ন ছড়ায় গহীন চেতনে। একে একে ভীড় করে আসে আরো অনেক ভালবাসার জন। ভোর রাতে সবার শেষে মায়ের সাথে সৌম্যর দেখা হয়। মা এসে মাথার  কাছে বসে। চুলে বিলি কেটে দেয়। তার দু'চোখ টলটল করে।
-- " বাপ আমার, তোর কোনো দোষ নেই!  কিছু কথা থাকে যা বলা হয়ে ওঠেনা বাবা......কিন্তু আমি বুঝেছি, তুই না বলতে পারলেও তোর চোখ বলে দিয়েছে। " সৌম্যর মাথাটা কোলে নেন তিনি। কপালে, মুখে হাত বুলিয়ে দেন, ফিসফিসিয়ে বলেন --- " তোর ছেলেবেলাটা আমরা নষ্ট করে দিয়েছি। তোকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে চেয়েছি মাপ কর, তোর অপরাধী আমি। মা হয়ে তোকে ঝড়ঝাপটা থেকে  আগলে রাখতে পারিনি বাবা!"
সমুর মা সৌম্যর চোখের জল মুছিয়ে দেয়। সৌম্য সমুর মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেন।

এরপর, ভোরের স্নিগ্ধতা মেখে পরম সুখ ও শান্তিতে, সৌম্যসুন্দর তার মায়ের কোলে মাথা দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন