মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

মিনতি ঘোষ



#বই

বই হচ্ছে একটা গোটা পৃথিবী । উত্তর গোলার্ধ - দক্ষিণ গোলার্ধ । গ্ৰিনিচ … সময়...রাত দিনের হিসাব । বই মানে ভারখায়নক্সের তুষার রাজ‍্য, আফ্রিকার সিংহ, আমাজনের অন্ধকার নিবিড় বনানী, অস্ট্রেলিয়ার ক‍্যাঙারু, গঙ্গা যমুনা রাইন, নাইলের কলতান, সমুদ্র গর্জন, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, মৌসিনরামের অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাত । অজানা জগতের রহস‍্যের হাতছানি এই বই ।   বই মানে মানুষ আর মানুষ...শ্বেত, কৃষ্ণ, পিঙ্গল, পীত । বই অব‍্যক্ত আনন্দের, লুকানো কান্নার এক নিরাপদ আশ্রয় ।
বই আমাদের শয়নে, স্বপনে, জাগরণে - কখোনো চোখের পাতায়, কখোনো বা হৃদয়ের গিরি কন্দরে নাছোড় হয়ে বসে থাকে - আমাদের হাসায়, কাঁদায়, আমাদের সান্ত্বনা দেয়, নিরাশার অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা আমাদের হাত ধরে তুলে ধরে - বলে ‘দ‍্যাখ্ দ‍্যাখ্ জীবন , এই মেলে ধরেছি জীবন প্রবাহ … শান্তি, সন্তুষ্টি, ভালোবাসার নদীতে অবগাহন কর !’

বই  প্রবাহিত সময়ের, ক্রমবিকাশমান সভ‍্যতার লিপিবদ্ধ দলিল । ক্লে ট‍্যাবলেট বা  মাটির ফলকের লেখা আদি যুগের গ্রন্থ, প্যাপিরাসের বা ভূর্জপত্রে বা তালপাতায় হাতে লেখা বইয়ের যুগ এবং যান্ত্রিক ছাপাখানায় তৈরি বইয়ের পর্যায় পেরিয়ে আজকের দুনিয়া প্রবেশ করেছে ডিজিটাল যুগের ই-বইয়ের জগতে। আস্ত একটি লাইব্রেরি এখন হাতের মুঠোয়-ধরা মোবাইল ফোনে । যে কোনো জায়গা থেকে ইন্টারনেটের সুবাদে পৃথিবীর প্রধান প্রধান গ্রন্থাগারগুলোর বইপত্র পাঠ করাও এখন আর অসম্ভব নয়  ।  আর এই গ্ৰন্থাগারের ইতিহাস থেকে উঠে আসে আদি বইয়ের ইতিহাস, ভূগোল । সুপ্রাচীন অ্যাসিরিয় সভ্যতায় গ্রন্থাগারের গোড়াপত্তন হয়েছিল। খ্রীষ্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্য-এশিয়া মাইনর কেন্দ্রিক অ্যাসিরিয়ান সভ্যতার অন্যতম রাজা আসুরবানিপাল (Assurbanipal) তাঁর নিজস্ব গ্ৰন্থাগারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন । গ্রন্থাগারটি প্রায় ৩০ হাজার মৃন্ময়-চাকতি-বইয়ে  সমৃদ্ধ ছিল। এগুলো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১৫ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি এবং এক থেকে দেড় ইঞ্চি পুরু ছিল  ।  গ্রন্থাগারে ইতিহাস, শাসনতন্ত্র, বৈদেশিক তথ্য, ভূগোল, আইন, ব্যবসা ও রাজস্ব, বিজ্ঞান, পৌরাণিক কাহিনি, ধর্মীয়, সাহিত্য ও রেফারেন্সসহ বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য সামগ্রী এই রকম ক্লে ট‍্যাবলেটে রক্ষিত ছিল । বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আসুরবানিপালের প্রতিকৃতিসহ এই রকম প্রায় ২০ হাজার চাকতি-বই আলাদাভাবে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত আছে।

লিপি-কৌশল আয়ত্বে আসার আগেই মানুষ দড়িতে গিঁট বেঁধে বা কোনও কঠিন পদার্থের ওপর দাগ কেটে সঙ্কেত পাঠাতো। এর পরবর্তী স্তর চিত্রলিপি। মেক্সিকোর অ্যাজটেকরা, চিনের প্রাচীন অধিবাসীরা, মিশরের পিরামিডের দেওয়ালে কিংবা মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার অধিবাসীরা, সকলেই চিত্রলিপি ব্যবহার করতো। এ সময় কাঠের খণ্ডের ওপর অক্ষর খোদাই করার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, যাকে জাইলোগ্রাফি (xylography) বলা হতো। পরে যাজকরা বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে কাগজের ওপর কাঠ-খোদাই ছাপ তুলে বিতরণ করতেন। এ ধরনের কাগজখণ্ডকে একত্রিত অবস্থায় বাঁধাই করে ‘ব্লক বই’-এর সৃষ্টি হলো।  আবার ছাপা বইয়ের পিতা যাঁকে বলা যায়, সেই জোহান্স গুটেনবার্গ কিন্তু নিতান্ত সখে এবং তাস খেলার নেশায় এইরকম কাঠের ব্লক তৈরি করে তাতে রঙ্ মাখিয়ে মোটা সাদা কাগজে ছাপ তুলে তাস তৈরি করতে করতে ঐ ভাবে এক মহাপুরুষের ছবির ছাপও তৈরি করেন । তার নিচে ছোট ছোট ব্লকে মহাপুরুষ সম্বন্ধে কিছু কথাও লিখে দেন । মানুষ ভীড় করে কিনতে থাকে এসব ছবি । কাঠের ব্লক তৈরি থাকার জন‍্য সহজেই বহুবার এই রকম মহাপুরুষের ছবি ছাপিয়ে অতি সহজেই বিক্রি হতে থাকে ।  একদিন এক পাদ্রী এই ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে  হাতে লিখে কয়েকজন মহাপুরুষের জীবনী দিয়ে যান উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এইভাবে ছাপার জন‍্য  । কয়েক মাসের কঠিন পরিশ্রমে ব্লক না করে আলাদা আলাদা অক্ষর তৈরি করে চৌষট্টি পাতায় তার ছাপ তুলে জীবনী গ্ৰন্থটি গুটেনবার্গ তুলে দেন সেই পাদ্রীর হাতে  । পৃথিবীতে এটিকেই বলা যায় প্রথম ছাপা বই ।  এই অক্ষরগুলি পাতলা কাঠের এবং বারংবার ব‍্যবহারে ভোঁতা ও ভঙ্গুর হয়ে যেতে থাকে । এরপর গুটেনবার্গ এবং তাঁর স্ত্রী এনা ও আরো কয়েকজন মিলে ধাতব অক্ষর তৈরি করেন । ১৪৫০ সালে প্রকাশিত হয় গুটেনবার্গ কৃত,  ধাতব অক্ষরে ছাপা বাইবেল এবং এটিকেই প্রথম ছাপা অক্ষরে বইয়ের মান‍্যতা দেওয়া হয় ।

চর্যাপদ বাংলায় লেখা প্রাচীনতম বই মনে করা হয় । তবে তা কবে লেখা হয় তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ‍্যে মতভেদ আছে । সবার মত মিলিয়ে অনুমান করা হয়, চর্যাপদ রচিত হয়েছিল ৮৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এই বইটি কিন্তু হারিয়েই গিয়েছিল। ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের একটি খণ্ডিত পুঁথি খুঁজে বের করেন। তাও আবার নেপালের রাজদরবারের লাইব্রেরি থেকে ।

যতদূর জানা যায়, পৃথিবীর প্রথম বাংলা হরফে মুদ্রিত বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৬৮২ সালে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। তবে বইটি পুরো পাওয়া যায়নি, বইটির কিছু ছেঁড়া পাতা পাওয়া গিয়েছিল। এটিকেই বলা যায় সবচেয়ে পুরনো বাংলা মুদ্রণের নমুনা।   বাংলা ভাষায় লেখা সবচেয়ে পুরনো এবং সম্পূর্ণ যে মুদ্রিত বইটি পাওয়া গেছে, তার নাম-- ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’। লিখেছিলেন মনোএল দ্য আসসুম্পসাঁও। তবে বইটি বাংলা বর্ণে নয়, মুদ্রিত হয়েছিল রোমান হরফে। বইটি লেখা হয়েছিল ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে তা  ছেপে বের হয় ১৭৪৩ সালে। এদেশে ব‍্যবসা বাণিজ‍্যের প্রসারে ঐ ১৭৪৩ সালেই পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে বাংলা ভাষায় কথোপকথন চালোনোর জন‍্য কিছু বাংলা শব্দ এবং শব্দবন্ধ নিয়ে বাংলা থেকে পর্তুগিজ এবং পর্তুগিজ থেকে বাংলা অনুবাদের বই ছাপিয়ে প্রকাশ  করা হয় - যদিও তা ছিল রোমান হরফে । এর চব্বিশ বছর পর লন্ডনে, সে দেশেই তৈরি বাংলা হরফে, একই সঙ্গে ছাপা হয় দুটি বই ‘প্রার্থনামালা’  ও  ‘প্রশ্নমালা’ । বাংলায় স‍্যর চার্লস উইলকিনস্ ১৭৭৮ সালে বাংলা হরফের কারিগর পঞ্চানন কর্মকারের সহায়তায়,  খ্রিস্টান মিশনারিদের অর্থানুকুল্যে হুগলি থেকে প্রথম বই প্রকাশ করেন হলহেডের ‘এ গ্ৰামার অফ দ‍্য বেঙ্গলি ল‍্যাঙ্গুয়েজ’ ।

অনেক পথ চলার পর আজ আমরা কাগজ কলম থেকে সরে  যন্ত্রদেবের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি । তবু মনের ভিতর এক অদ্ভুত মাদকতা ছেয়ে যায় নতুন বইয়ের পাতার ঘ্রাণ নিলে !  এখোনো ডাটা এন্ট্রির পাশ ওয়ার্ডরা প্রবেশাধিকার পায়নি এমন কোন পুরোনো  লাইব্রেরি ঘরে এসে দাঁড়ালে, সেখানকার পুরনো বইয়ের স‍্যাঁতসেঁতে গন্ধও বুক ভরে টেনে নিই - ‘সে যে চোখের দেখা প্রাণের কথা … সেই কি ভোলা যায় !’

স্কুলে ভর্তির অনেক আগে থেকেই গল্পের বই আমার বগলদাবায় সব সময় । তখন সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বড় বড় রঙচঙে প্রাণবন্ত ছবিতে ভরা বাচ্চাদের গল্পের বই বেরোতো - ‘একটি গমের শীষ’ বইটার নাম মনে আছে । ঐ বই বাজারে এলেই বাবা এনে দিতেন । কোন বাড়িতে বেড়াতে গেলে সে বাড়ির ছেলেমেয়ের বই রাখার জায়গায় হানা দিতাম । খুঁজে পেতে বাংলা পাঠ‍্যবইটি বের করে তাতে মুহূর্তে ডুব ! সবাই বলতো “কি ভালো মেয়ে - সব সময় পড়া আর পড়া”  ইস্…..তারা যদি পরবর্তী সময়ে আমার স্কুলের রিপোর্ট কার্ড দেখতো !! ক্লাস টুতে স্কুলে ভর্তি হই । তখন সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে “ক্ষীরের পুতুল” - কত্তোবার যে পড়েছি । একদিন একদম পিছনের বেঞ্চিতে বসে মন দিয়ে সে বই পড়ছি, খেয়ালই নেই কখন ঝর্ণা দিদিমণি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন । কেড়ে নিলেন বইটি - অনেক বার, অনেক কান্নাকাটির পরও সে বই আর ফেরত দেননি । আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা সে বইয়ের কথা - পরে তো মেয়েকেও কিনে দিয়েছি , তবু .. ! বাবা মার বইয়ের জগতে প্রথম হানা ‘মহাভারত’ দিয়ে । সে আমার একদম শৈশব কাল । বইয়ের বিষয় নয়, আমার কাছে ছবিই তখন বিচার্য । শ্রীকৃষ্ণের মৃত‍্যু দৃশ‍্য কিছুতেই সহ‍্য করতে পারিনি, তাই ব‍্যাধকে পেন্সিল দিয়ে কাটাকুটি করে দিয়েছিলাম । আমার সেই পেন্সিলের কাটাকুটি দাগ নিয়ে আজও বর্তমান  আমাদের পাঁচ প্রজন্মের পারিবারিক সম্পদ কাশীরাম দাসের মহাভারত !  আর ছিল গৌর কাকার সিনেমার গানের পাতলা চটি বই । আমাদের ছেলেবেলায় রূপায়ন সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে ছোটখাটো চেহারার, একচোখ অন্ধ একজন বৃদ্ধ যে সিনেমা চলছে তার গানের বই বিক্রি করতো - “বাংলা হিন্দি ...বাংলা হিন্দি …”  তা শাপমোচনই হোক কি নাগিন হোক ! গৌরকাকা প্রথম দিনই সে বই কিনে ওর ঘরে টানানো অনেক লম্বা তারে কাপড় শুকোতে দেওয়ার মতো করে ঝুলিয়ে দিতো । পরপর অনেক বইয়ের ডালি সেখানে ।  গানের আগে যে সিনেমাটি চলছে তার কাহিনীর সংক্ষিপ্তসার থাকতো ঐ বইয়ে । আমি প্রতি শনিবার নিয়ম করে গৌরকাকার ঘরে তার একটি মাত্র ‘হোয়াট-নট’ নড়বড়ে কাঠের টেবিলে বসে গিলতাম সে গল্পগাথা । মা বাবা কোনদিন জানতেই পারেনি । অনেক ছোটবেলা থেকেই বাবা মার লাইব্রেরির বইয়েও ছিল আমার গোপন অভিযান । দুর্গেশনন্দিনী, শ্রীকান্ত, গোরা, নীহার রঞ্জনের কিরিটি রায়ের গোয়েন্দা গল্প আমার সিক্স, সেভেনেই শেষ । নিজেরও তো অনেক গল্পের বই - তাছাড়া শুকতারা, শিশুসাথী, মৌচাক তো আছেই...তবু নিষিদ্ধ ফলেই টান বেশি … প্রাকৃতিক নিয়ম ! একটা ব‍্যাপার প্রথম থেকেই আমায় ভীষণ আকর্ষণ করতো - বর্ণনা । সে প্রাকৃতিক দৃশ‍্যই হোক বা মানুষ, ঘরবাড়ি - এমনকি খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত । এখোনো করে । শীর্ষেন্দুর উপন‍্যাস পড়তে পড়তে ভাজা মুগডালে জিরে, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কার ফোড়নের গন্ধ ঝট্ করে নাকে এসে লাগে ।

এখোনো এই বইয়ে … বই পড়ায় আকণ্ঠ ডুবে থাকতে পারলে আর কিচ্ছু চাইনা । এখনো উপহার হিসাবে প্রিয়জনের কাছে বইয়ের দাবিই জানাই । আমিও প্রতিভা বসুর মতো মনে প্রাণে বিশ্বাস করি  “বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনদিন ঝগড়া হয় না, কোনদিন মনোমালিন্য হয় না।”

1 টি মন্তব্য:

  1. দিদি, তোমার এই বইয়ের প্রতি প্রেম, শ্রদ্ধা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আগেও পড়েছি প্রবন্ধটি এখন আবার নতুন করে পড়লাম।

    উত্তরমুছুন