সোমবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২২

শৌনক দত্ত

              





পঞ্চাশ দশকে পূর্ববঙ্গের কবিতা ও একজন অনালোচিত কবি




ধর্মীয় হঠকারিতার ফসল হিসেবে দেশবিভাগ (১৯৪৭) যখন মেনে নিতে হয় সবাইকেই, তখন হাজার বছরের অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষা-সাহিত্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায় স্থায়ী সীমানা-দেয়াল। ফলে পূর্ববঙ্গের কলকাতাবাসী কবি-লেখক-শিল্পীদের নাগরিকত্বের বদল ঘটে। তাঁরা চলে আসেন খন্ডিত ভূখন্ডে। আটচল্লিশে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন এই ভূখন্ডের কবি-শিল্পীদের স্বতন্ত্র স্বকীয়তা দান করে। এই স্বকীয়তাতেই ধরা পড়ে নতুন সংকটের চিত্র, নতুন স্বপ্নের বার্তা, নতুন শত্রুর পরিচয়, নতুন সম্ভাবনার মন্ত্র। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলনে ভাস্বর এই সব বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ কবিতাই স্বাধীন বাংলাদেশ ভূখন্ডেরও আগে বাংলাদেশের মানুষ ও সংস্কৃতির বাতাবরণে মৌলিকত্ব নিয়ে হাজির হয়। ফলে বাংলাদেশের কবি ও কবিতা (সাহিত্যের অন্যান্য শাখার ক্ষেত্রেও) বলতে বিবেচনায় নিতে হয় সাতচল্লিশের দেশভাগের কাল-পরিসর থেকে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব বাংলার নতুন কবিরা তাঁদের সৃষ্টির জন্য নতুন ভাষা ও নতনু দিশার সন্ধান শুরু করেন। কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার বিকল্প হিসেবে এই অঞ্চলে গড়ে ওঠে ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার নতুন এক পরিমন্ডল। এখান থেকে চর্চিত-সৃজিত সামগ্রিক সাহিত্যকর্মই পরে বাংলাদেশের সাহিত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই সময়ের কবিতায় একটি স্বাধীন দেশের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানো, নিজেদের কণ্ঠস্বরে নতুনত্বের প্রকাশ এবং নিজ দেশের মানুষের আবেগ চিত্রিত করা কবিদের দায়িত্ব হয়ে ওঠে। তাই নতুন এই পরিমন্ডলকে ঘিরে এই অঞ্চলের কবিরা পরিচিতি পান বাংলাদেশের কবি হিসেবে। তাঁদের রচিত কবিতাই বাংলাদেশের কবিতা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বাংলাদেশের কবিরা সাতচল্লিশের পর বা উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে যে কবিতাভাবনা ও কাব্যপ্রয়াস তুলে ধরা শুরু করেন পাঠকের সামনে, তার সবই ছিল নতুন ভাষা এবং নতুন ধ্যান পঞ্চাশের বাংলা কবিতায় তেমনভাবে আজীজুল হকের নাম আলোচিত নয়। মফস্বল শহরে বসে কবিতা চর্চা করে গেলেও তাঁর কবিতা বাংলা কবিতায় অন্যস্বর ও আঁখড়ের কথা বলে। 

বাংলাদেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্খাই কবিতায় গণচেতনায় রূপান্তরিত হয়। এই গণচেতনা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও পরিপূরক হয়ে ওঠে। এই সময় বাংলাদেশের কবিতার মহাসড়কে আবিভূর্ত হন বেশ কয়েকজন তরুণ কবি, যাঁরা পরেও দীর্ঘ সময় ধরে কোনো না কোনোভাবে নিজেদের কবিতায় গণচেতনার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯), আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (১৯৩৪-২০০১), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬), ফজল শাহাবুদ্দিন (১৯৩৬-২০১৪), আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) প্রমুখ। তাঁদের আবির্ভাব ঘটে মূলত ভাষা-আন্দোলন এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে। তবে এই কবিরাই পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যেমন, তেমনি সত্তর-আশিনব্বইয়ের দশক তথা জীবনের শেষ পর্যন্ত অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কবিতার পাশাপাশি গণচেতনামূলক কবিতার চর্চা করে গেছেন। অবশ্য আল মাহমুদ ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রথম দিককার কাব্য-কবিতা বাদ দিলে তাঁকে আর বাংলাদেশের কবিতার মূলধারায় খুব একটা পাওয়া যায় না। তাঁর ব্যক্তিচেতনায় সংঘটিত বড় পরিবর্তনই সম্ভবত তাঁকে মূল পথ থেকে ভিন্ন পথগামী করেছে। যা-ই হোক, উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিই যে গণচেতনামূলক কবিতা সৃষ্টির একমাত্র ভিত্তি, তা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যাবে না। কারণ, রাজনৈতিক সংকটের বাইরেও সাধারণ মানুষের জীবনে নানা রকম সংকট ও বঞ্চনা লুকিয়ে থাকে, যা সূক্ষ্মভাবে প্রতিনিয়ত সমাজচৈতন্যে প্রভাব ফেলে।

সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যদি কোনো কবি সেসব বিষয়কে তাঁর কবিতায় আশ্রয় দিতে চান, তবে তাতেও গণচেতনারই রূপায়ণ ঘটে। তাই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতিতে সময়ে-সময়ে, দশকে-দশকে বাংলাদেশের কবিতায় আবির্ভূত হতে থাকেন প্রতিশ্রুতিশীল কবিরা। কবিতায় তাঁদের ভাষার ব্যবহার, বিষয়ের ঐক্য, শব্দের নতুনতর বিন্যাস যেন সবকিছুর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে থাকে।পঞ্চাশের তরুণদের মতো অন্যান্য দশকেও স্বকীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন নতুন কবিরা। এই ধারা চলতে থাকে।একাত্তর হয়ে উত্তাল নব্বই পর্যন্ত। বাংলাদেশের কবিতা প্রধানত গণচেতনায় ঋদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে পঞ্চাশ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। পঞ্চাশের প্রধান কবিদের গণচেতনামূলক কবিতায় স্বকীয় শব্দের প্রায়োগিকতা অন্বেষণ করলে দেখা যায়। এই সময়ের কবিরা একই পরিস্থিতিতে কবিতা লিখেছেন, আবার তাতে মৌলিকতার স্বাক্ষরও রেখেছেন নিজস্ব প্রতিভাগুণে। শব্দের স্বকীয় ব্যবহারে তা হয়ে উঠেছে নিজস্ব কণ্ঠের পরিচায়ক। প্রতিটি কবির নির্বাচিত শব্দের ব্যবহারই তাঁকে স্বমহিমায় স্বীকৃতি প্রদান করেছে। 



নীলাভ কাচের প্লেটে হৃৎপিণ্ড রক্তাক্ত উজ্জ্বল

ছিঁড়ে এনে রাখলে টেবিলে

সূর্যোদয় হলো

সমুদ্রের জলে।

আজকের প্রগাঢ় সকালে

কী দেবো তোমাকে? কী দেবো, কী দেবো!

রক্তমুখী নীলা।

এর চেয়ে অন্যতর কী বা দিতে পারি।

উত্তোলিত প্রাসাদের নিচে

অবধ্বস্ত সে নগরী একদিন আবিষ্কৃত হবে।

রমণীর ধবল করোটি, ডানচক্ষু দৃষ্টির কবর,

অন্যতর চোখের কোটরে সুদুর্লভ মণি

রক্তমুখী নীলা,

যেন তার তীরবিদ্ধ গাঢ় নীল চোখ

এক ফোঁটা রক্ত জ্বেলে অন্ধকারে চেয়ে থাকে

কারো দিকে।

কার দিকে হে বিশ শতক?


(রক্তমুখী নীলা)



উপরের কবিতাটি লিখেছেন কবি আজীজুল হক (জন্ম ১৯৩০, মৃত্যু ২০০১)। যিনি প্রতিভার স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, বিশ শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকের এক প্রতিশ্রুতিশীল কাব্যশিল্পী। সমকালীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিষয়ে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব-দ্রোহ ও রক্তপাতের প্রেক্ষাপটে অনিবার্য মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তিনি শিল্পীত করেছেন তাঁর কবিতায়। আপন অস্তিত্বকে বোধ করে তা রক্ষার প্রগাঢ় আর্তনাদে মুখর থাকতে দেখা যায় তাঁকে। কখনো এ প্রসঙ্গেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তিনি। কবি আজীজুল হক ছিলেন আপন ইতিহাস-ঐতিহ্যে আস্থাশীল, মানবতায় পূর্ণ, প্রগতিধর্মে দীক্ষিত ও জীবনমুখীনতায় উচ্চকণ্ঠ। 


৫২তে ভাষার সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও পাকিস্তান বিরোধ অস্থির অভিঘাতী তরঙ্গ এদের মধ্যকার আবার কোনো কোনো কবিকে স্বাধিকারের চেতনা জাগরণের রসদও জুগিয়েছিল । এই রাজনৈতিক অভিঘাতী ৬০এর দশকে এ বাংলার নিজস্ব কাব্য সাহিত্যাঙ্গনকে আরো আধুনিকতা সংলগ্ন করে গড়ে তুলতে সহায়তা করে । আবার আধুনিকতা যদিও চেতনা ও মননশীলতার মধ্য দিয়ে মানবতাবাদকে শাণিত করে তোলে; তবুও সময় ও নগর বাস্তবতার সাথে এর রয়েছে পৌণঃপুনিক সম্পর্ক। এই বাংলার কবিতা তাই নগর ও চারপাশের বাস্তবতাকে অন্তরে বাহিরে ও চেতনায় তুলে নেবার মোক্ষম পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল ।

১৯৬০ সালে প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে কাব্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার সাথে ঢাকা নগরীর পৌনঃপুনিক সম্পর্কের সাঁকো নির্মাণের পাশাপাশি এ বাংলার কাব্য সাহিত্যের সত্যিকার আধুনিকতার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন কবি শামসুর রাহমান । অপরদিকে, তিরিশি কাব্যজগত ধারাবাহিকতার উত্তর প্রজন্মের কবি শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থটি ওপার বাংলা কাব্যসাহিত্যে প্রায় পরিণত ও আধুনিকতা–উত্তর সম্পর্কসূত্র পুনঃনির্মাণ করেন । নিরঙ্কুশ আধুনিকতার বহিস্রোত ক্ষুব্ধ শামসুর রাহমানের কবিতা এ বাংলার নাগরিক মনস্বীতায় নতুনতর প্রসাদ সৃষ্টির পাশাপাশি, স্বাতন্ত্রে বৈচিত্র্য ভিন্নতায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এরপর ১৯৬৩ সালে -“রৌদ্র করোটি”তে কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে ৪৭পরবর্তী ওপার বাংলার সমস্ত ঐতিহ্যমণ্ডিত, ধর্মীয়, জাতীয়তাবাদী ও প্রভাববাদী কাব্যবলয়কে পাশ কাটিয়ে বাংলা কবিতাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধশালী স্তরে তুলে আনেন । অন্যভাবে বলা যায়, রৌদ্র করোটিতে নামকরণের ভেতরেই নিহিত আছে হয়তো আধুনিক বাংলা কবিতা করোটির ভেতর বাহিরে প্রতিভা, মেধা ও ব্যক্তি–স্বাতন্ত্রের ঝলকানির অবিস্মরণীয় এক সৃজন উপাখ্যান। অতঃপর, ১৯৬৭তে কবি শামসুর রাহমানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বিধ্বস্ত নিলীমা প্রকাশের পর আধুনিক বাংলা কবিতা ধারার এক পরিণত বিকিরণ প্রভা সমকালের বিচিত্র ল্যাম্পপোষ্ট তির্যকভাবে প্রতিফলিত হতে শুরু করে । বিশেষত কবিতার কাব্যসত্তাকে উচ্চকিত রেখেই বর্ণনাময়ী বক্তব্যে, স্বকীয় ভাব ও প্রতিভাবের ঋদ্ধ সমীকরণে তিনি বাংলা কবিতায় ডিসকোর্সের শাণিত ধারার প্রতি–নন্দনত্ব উপস্থাপন করেন । যা ছিল বাংলা কবিতার সর্বাঙ্গীন অবয়ব ও মনোজগতের প্রায় পরিপূর্ণ বিস্তৃতির মানসকল্প বিন্যাস । এভাবে শামসুর রাহমানের কাব্যজগৎ জুড়ে জেগে ওঠে নগর স্বদেশের বিপুলা এক মানচিত্র । 

এসব কিছুই মাথায় রেখেও বলতে পারি আজীজুল হকের -ঝিনুক মুহূর্ত সূর্যকে (১৯৬১),বিনষ্টের চিৎকার (১৯৭৬), ঘুমও সোনালী ঈগল (১৯৮৯)। তিনটি কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতাকে নতুন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেছে, আমরা জেনেছি কবি হওয়ার জন‍্য প্রচুর বই পকাশ করা জরুরি নয়, জরুরি হচ্ছে চিন্তা ও চেতনার উন্নয়ন, উন্নত লেখা। তার প্রমাণ তিনি। এছাড়াও জানা যায় বন্ধু ও প্রকাশকরা শ্রেষ্ঠ কবিতা বা নির্বাচিত কবিতা প্রকাশের কথা বললে তিনি কখনও সম্মত হননি। নির্বাচিত বা শ্রেষ্ঠকে স্বীকার করতেন না। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ‍্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় তিনটি বই থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে আজীজুল হকের কবিতা। একটি মাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থ অস্তিত্বচেতনা ও আমাদের কবিতা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে।

রাজধানীর মোহময় হাতছানিকে উপেক্ষা করে সারাজীবন যশোর শহরে অধ‍্যাপনা আর সাহিত‍্যসেবায় জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। যশোরের তরুণ কবিদের অনিবার্য অভিভাবক হয়ে সাহিত‍্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। আমরা এই কৃতি কবিকে যথার্থ মূল‍্যায়ন করতে পারিনি বা করিনি।

আজীজুল হকের কবিতায় একদিকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যসচেতন শিল্পদৃষ্টি প্রতিভাত অন্যদিকে, অস্তিত্ববোধ ও ভাবনাপ্রসূত কবিতার বিষয় ও উপকরণ-অনুষঙ্গ অভিনব মর্যাদায় সিদ্ধ হয়ে ওঠে। দুঃস্বপ্ন, মৃত্যু, অন্ধকার, রক্তপাত প্রভৃতি উপমা-প্রতীক সাম্রাজ্যবাদ ও অস্থির সময়কে যেমন নির্দেশ করে, তেমনি দীর্ঘদিনের পরাধীন বিপন্ন জাতিসত্তাকে সংহতি দানের চেষ্টায় তাঁকে সংগ্রামী হতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি কবিতায় নিয়ে আসেন দ্যুতিময় সব মুহূর্ত-প্রতীক। কখনো তীব্র কৌতুক ও ব্যাঙ্গবাণে তাঁকে সমকালীন পরিস্থিতিকে তীক্ষ্ণ করে তুলতেও দেখা যায়-


এক. 

আদিম সমুদ্র থেকে অন্তিমের স্থলভাগ জুড়ে

বিশাল পাহাড় এক অণুতম সূর্যকে ছুঁয়ে

পড়ে আছে, যেন

মহাকাল শিলীভূত, মসৃন পিচ্ছিল।

একদিন মানব সমাজ

ওই খানে যাবে, এখন যন্ত্রণা শুধু আজ, এখন কেবল

শব থেকে শবের সিঁড়িতে একটি আকাঙ্ক্ষা হেঁটে যায়

জীবনের নামে, এখন সে জীবনের নাম

স্বপ্ন আর রক্ত আর ঘাম। 

(যন্ত্রণা; ঝি.মু.সূ)


দুই. 

অতীতে প্রোথিত দেখি অর্ধাঙ্গ আমার

এবং দুচোখ

শামুকের ঠোঁটে বিদ্ধ নীলকান্ত মনি

যেন এক নিহত সময়

দুর্ঘটনার পিঠে ঠেস দিয়ে পড়ে থাকে

হাজার বছর। 

(যন্ত্রণার মৃত্যুতে; ইচ্ছার নায়ক, ঝি.মু.সূ)


তিন. 

নীলাভ কাঁচের প্লেটে হৃৎপিণ্ড রক্তাক্ত উজ্জ্বল

ছিঁড়ে এনে রাখলে টেবিলে

সূর্যোদয় হলো

সমুদ্রের জলে।

আজকের গ্রগাঢ় সকালে

কী দেবো তোমাকে? কী দেবো, কী দেবো!

রক্তমুখী নীলা। 

(রক্তমুখী নীলা; ঝি.মু.সূ)


চার. 

অবশ্যই আমি সেই ব্যবহৃতা রমণীর সজ্ঞান প্রেমিক।

জীবনকে সুনিপুণ আলিঙ্গনে বেঁধে

চিরকাল বেঁচে থাকে নির্বিঘ্নে যেমন

মৃত্যুটা; তারো চেয়ে অধিক নিকটে আমি তার। 

(বিনষ্টের চিৎকার; বি.চি.)


পাঁচ. 

একালের কবিতা ফুলকে বাদ নিয়েছে।

আকাশে মেঘ, কালো মেঘ

সূর্য নেই।

যে ফুলের নাম সূর্যমুখী সে নামেই সে ফুটলো।

আগুন রঙ পাঁপড়ি কী ধূসর!

আগুন থেকে ছাই। 

(মেঘমুখী সূর্যমুখী; ঘু.ও সো. ঈ.)


ছয়. 

রাজার আশ্বাস-দুর্গসঙ্ঘের আড়াল আর

মহান নগর

পলাতক বন্ধুদের নির্বিঘ্ন আশ্রয়। 

(প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবিম্ব; ঘু.ও সো. ঈ.)


সাত. 

দারুন দু:স্বপ্ন ছাড়া গাঢ় কোন মধ্যরাত নেই

নীল নীল মৃত্যু ছাড়া স্বপ্নহীন দীর্ঘ ঘুম নেই

অনিদ্রার জ্বালা ছাড়া নিদ্রাস্নাত জাগরণ নেই। 

(ঘুম ও সোনালি ঈগল; ঘু.ও সো. ঈ.)

মিথ বা পৌরাণিক উপাদানের ব্যবহার আজীজুল হকের কবিতাকে সার্বজনীনতা দান করে। দ্বন্দ্বময় অস্তিত্ব-সচেতন কবিমানস থেকে ভারতীয়, গ্রিক প্রভৃতি পুরাণের উপাদানসমূহ তিনি সমকালীন জীবন-প্রসঙ্গে রূপায়ণ করেছেন-যা মানুষের চিরন্তন ভাবনার মাধ্যম ও রূপকল্প হিসাবে কাজ করেছে। বৃহত্তর জীবনকে কবি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাণ ব্যবহারসূত্রে সম্ভাবনাময় করে তুলেছেন। তাঁর কবিতা থেকে-

এক. 

সূর্যই আমাদের প্রথম নায়ক

চিরকাল আমাদের নায়কই সে আছে। 

(মেঘমুখী সুর্যমুখী; বি.চি.)


দুই. 

খুঁজে দেখ, সেইসব বিদ্ধস্ত ও প্রোথিত নগর

হিংস্র দাঁতের ফাঁকে আর্যদের হাসি,

দ্রাবিড়ের বিচূর্ণ করোটি। 

(হাড়; ঝি.মু.সূ)


তিন. 

মনে করো, ইভের সান্নিধ্য ছেড়ে আমি এক আদিম পুরুষ

সুপ্রাচীন ব্যাবিলনে নিগূঢ় চুম্বন রেখে বিবাহিত রূপসীর ঠোঁটে

নিখোঁজ হয়েছি। 

(প্রাক উত্তর পর্বের সঙ্গীত; ঝি.মু.সূ)


চার. 

অপহৃতা রমণীর মতো এক স্মৃতিগন্ধা অনার্য রূপসী

ঝিনুক-রহস্য চোখ তুলে

সেই প্রশ্ন সম্প্রতি ও করেছে আমাকে

বঙ্গোপসাগরের উপকূলে। 

(রূপকথা; বুদ্ধ ও ড্রাগন, ঝি.মু.সূ)

সময় নিরন্তর হাঁটছে তার পায়ে ধুলো ওড়ে না। আক্ষেপে জুড়ে থাকে শুধু আজীজুল হককে আবিষ্কারের বিষয়টি। তাঁর কবিতা, তাঁর দর্শন যুগে যুগে আবিষ্কৃত হওয়ার মতো। কারণ তার কবিতার শরীরে আধুনিকতার আদলে আধুনিক জীবনেরই ধ্রুপদ বিন্যাস করা হয়েছে-যা খুললে উন্মোচিত হবে এক বিরাট ভুবন। আর তাঁর দর্শনও অভিনব। মানুষ সবকিছুই অস্তিত্বের প্রয়োজনে করে, এমনকি যে কবিতা লেখে তাও। এই হচ্ছে আজীজুল হকের দর্শন। এই দর্শনকে ঘাঁটলে কাব্যপ্রয়াসীরা পেতে পারেন অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর। কবিতা সময়ের সাথে বদলে যায়। নতুন কবিরা নতুনভাবে নির্মাণ করতে চান কবিতার শরীর। সেই সূত্রে কবিতা আধুনিকোত্তর যুগে প্রবেশ করেছে। কিন্তু নানা কারণে পঞ্চাশের কবিরা ইতিহাসে বিশেষভাবে থাকবেন। থাকবেন আজীজুল হকও। এই বিষয়টি এখনই বিরাটভাবে দৃশ্যমান না হলেও ভবিষ্যতে হবে। কারণ মহৎ কবিতা এক সময় না একসময় কথা বলে।

সংখ্যার দিক থেকে কবি আজীজুল হক লিখেছেন অল্প কিন্তু তাঁর সমগ্র রচনা শিল্পবিচারসূত্রে অনন্য এবং একথা বলা প্রয়োজন, তাঁর কাব্যকর্ম বাংলা কাব্যভূমির সমৃদ্ধি প্রসঙ্গে সসম্মানে বিবেচিত ও গৃহীত হতে বাধ্য। 


  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন