রবিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০২২

অর্পিতা বোস

                   




অমলতাসের ডাইরি



____________


মানসীর হাতে ডায়েরিটা দিয়ে তিতিন  বলে,

-- পারলে ক্ষমা করো মামনি।

 অবাক চোখে মানসী তাকায়। তিতিন ডায়েরি খুলে সামনে রাখে মানসীর।  শুকিয়ে যাওয়া অমলতাসের বিবর্ণ পাতার  বুকমার্ক। বাঁদিকের পাতায় মানসীর শেষ  লেখা আর ডানদিকের পাতাটা থেকে তিতিনের হাতের লেখা!

তিতিন ধরা গলায় বলে,

-- মামনি অন্যের ডায়েরি পড়তে নেই জানি। কিন্তু বাবা দিয়েছিল পড়তে। বাবাও পড়েছিল , আর পড়েই বোধহয় তোমাকে আরও শ্রদ্ধা আর আমার প্রতি...

 কথাটা আর শেষ করতে পারেনা তিতিন। চোখ মুছে একটু সময় নেয় যেন পরের কথাগুলো গুছিয়ে বলার জন্য।

  নীরব মানসীর চোখে শুধু শূন্যতা খেলা করে। আবার  তিতিন বলতে শুরু করে,


 -- মামনি তোমাকে তখন আমার মনে হতো রূপকথার গল্পের ডাইনি। তাই অমন করেছি। তোমাকে অ‍্যাসাইলামে পাঠিয়েও  রাগ কমেনি আমার। তুমি চলে যাওয়ার পরে ঠাম্মাম বাবাকে লুকিয়ে তোমার জামাকাপড় বের করে দিত। আর সব ধ্বংস করার নেশায় মেতেছিলাম আমি । তোমার সব শাড়ি কেটে কুচিকুচি করতাম। আমার খুব আনন্দ হতো। যেন তোমাকেই এভাবে শেষ করছি।মারছি । নিজের সব রাগটাই যেন তোমার জামাকাপড়গুলোতে  মেটাতাম আমরা। তারপর শুরু হলো তোমার গাছদের ধ্বংস করার পালা। আমি পারতাম না। ঠাম্মাম গরম জল ঢেলে দিত। গাছগুলো মরে যেত। কিন্তু একটা গাছ কিছুতেই মরছিলনা। তখন ভারী টবটা  

ঠাম্মাম তুলে ফেলে দিতে গেল। আর হঠাৎই ব‍্যালেন্স হারিয়ে ঠাম্মামও ছাদ থেকে পড়ে গেল। চোখের সামনে  ঠাম্মামকে পড়ে যেতে দেখে কেমন হয়ে গেছিলাম জানো। তোমার কথা মনে এসেছিল প্রথম। কিন্তু  তুমি তখন অনেক দূরে।

একটু থেমে আবার বলতে থাকে তিতিন,


   --  ঠাম্মামের মৃত্যুটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে মামনি। মাকে কখনও দেখিইনি। ঠাম্মামই আমার সব ছিল।  যা বলত সবটাই ঠিক বলে জানতাম। তোমাকে বাবা বিয়ে করে আনল। ঠাম্মামের ইচ্ছে ছিল না।  তোমাকে নিজেও অপছন্দ করত আর আমাকেও শেখাতো যে তুমি খারাপ। তুমি  বাবাকে আমার থেকে নিয়ে চলে যাবে। তোমরা অন্য বাড়িতে থাকবে। আর তোমার পেটে একটা ভাই আছে। বাবা আমাকে না ঐ ভাইকেই বেশি ভালোবাসবে।

তখন  বুঝতাম না মামনি। ছোট আমি। নরম মাটির মতো মন ছিল। যা বলেছে ঠাম্মাম তাই বিশ্বাস  করেছি।


মানসী চুপ করে শুনছিল তিতিনের কথা। শুনছিল না আসলে ফিরে গিয়েছিল  সেই  কলেজজীবনের শেষ দিনে....

 পরীক্ষার ফলের লিস্টে দ্বিতীয় স্থানে  নিজের নামটা দেখেই খবরটা দিতে   অমলদার বাড়িতেই প্রথম ছুটেছিল তরুণী  মানসী। কিন্তু বাড়ির গলির সামনে  গিয়ে  পাদুটো আটকে গেল। থিকথিক করছে ভিড়। সদ‍্য পাওয়া চাকরি থেকে ফেরার পথে বাইকের সাথে মুখোমুখি ধাক্কায় অমলদার নিষ্প্রাণ দেহটা রক্তে মাখামাখি।

 নাহ্ আর এগোতে পারেনি মানসী। ঝাপসা চোখে ফিরেছিল বাড়ি। এরপর একমাত্র মানসী জানে অমলদা চলে যাওয়ার পর নিজের বদলে যাওয়া জীবনের যন্ত্রণা। অমলদাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট যতটা ছিল তারসাথে ছিল অন্য এক অনুভব। সময়ের সাথে সাথে শরীরের মাঝে অমলদার স্মৃতিকে অনুভব করতে থাকল। সেই বর্ষার সন্ধ্যায় অমলদার সাথের ঘনিষ্ঠতার ফসল।  অনেক চেষ্টাতেও লুকিয়ে রাখতে পারেনা মায়ের চোখকে। 

প্রচন্ড মার খেয়েও অমলদার নাম উচ্চারণ করেনি মানসী। মা চেয়েছিলেন নষ্ট করতে। কিন্তু  ডাক্তার জানাল অনেক দেরি হয়ে গেছে। লোকের চোখকে ফাঁকি দিতে  দিশেহারা তখন মা। তারপর কোথা থেকে  সম্বন্ধ আনল মায়ের বিশ্বস্ত বান্ধবী।  শুভব্রত অর্থাৎ তিতিনের বাবার সাথে। বিয়ে তো না শুভব্রতর সাথে অলিখিত  চুক্তি পত্রে সই হলো যেন।

অমলদার সন্তানকে বৈধ স্বীকৃতি দেবেন          

শুভব্রত। আর বিনিময়ে তিতিনের মা হয়ে  উঠতে হবে মানসীকে। অবশ্য রাজি হওয়া ছাড়া আর কিই বা করতে পারত!অনাড়ম্বর ভাবে বিয়ে  হলো।

কিন্তু এবাড়িতে এসে দেখে এক  ভয়ানক  পরিস্থিতি। তিতিন আর তিতিনের ঠাম্মাম  কিছুতেই সহ‍্য করতে পারত না মানসীকে। শুভব্রতর সামনে বুঝতে দিত না। শুভব্রত বেরিয়ে যেতেই বদলে যেত বাড়ির পরিবেশ। তিতিনকে ধারেকাছে আসতে দিতেন না শাশুড়িমা। মিষ্টি  কিশোরী   তিতিনকে মানসী কাছে ডাকতে গেলেই তিতিন ছুটে পালাতো। সাথে মুখে সবসময়  বলতে থাকত,

-- তুমি আমার  সৎমা। তুমি বাজে মা।তুমি ডাইনি।


 অসহায় মানসী একা ঘরে কাঁদত। তিতিনকে বারবার নিজের করে নিতে  চাইছিল। আর তিতিন ততটাই দূরে সরিয়ে   রাখছিল ঘৃণার সাথে। শুভব্রতকেও কিছু  বলতে পারতনা। শুধু কষ্টগুলো অক্ষরবন্দী করত অমলদার দেওয়া ডায়েরিতে। সেবছর জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল অমলদা। তিতিনদের বাড়ির সামনে থাকা  অমলতাস গাছের একটা পাতাকেই  মার্কার  হিসেবে ব‍্যবহার করত। 


 -- মামনি..

তিতিনের ডাকে বাস্তবে ফেরে  মানসী। তিতিন বলে,


-- মামনি, ঠাম্মামের মৃত্যুর পর সব বদলে গেল জানো। একা একা এই বাড়িতে  ঠাম্মামের অভাব পূরণ করার জন্য  তোমার ঘরে আসতাম।মনে হতো যদি তুমি  কাছে ডাকতে  তখন  তবে ছুটে চলে যেতাম  তোমার কাছেই। কিন্তু  তুমি তো তখন  কোথায়  হারিয়ে গেছিলে। বাবা আর আমি  অনেক খুঁজেছিলাম তোমাকে কিন্তু খুঁজে পাইনি।


মানসী আপনমনে ভাবে, সত্যিই  হারিয়ে গিয়েছিল। অ‍্যাসাইলামের ডাক্তার  দিদিমনির সাহায্যেই হারিয়ে গিয়েছিল  অনেক  দূরে।হ‍্যাঁ, ডাক্তার দিদিমনির  চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠা মানসী বলেছিল জীবনের প্রতিটা কথা। আর সাহায্য চেয়েছিল ডাক্তার দিদিমনির কাছে নতুন করে বাঁচার। সাহায‍্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দিদিমনির প্রশিক্ষণে শুরু হয়েছিল নতুন জীবন। সমাজের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে  শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে যুক্ত  হলো। তারপর এই অনাথাশ্রমের দেখভালের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন ডাক্তার দিদিমনি। এখানেই ভালো থাকার চেষ্টায় আছে। সব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ভুলতে পারেনি সন্তান হারানোর শোক। অমলদার স্মৃতিচিহ্ন চিরদিনের মতো মুছে দেওয়ার অপরাধী আজ মানসীর সামনে। চোখ দুটো জ্বালা করছে। বুকের মধ‍্যে লুকিয়ে রাখা নরম ক্ষতটা  আজ আবার  কষ্ট দিচ্ছে।


-- মামনি....


     তিতিনের মুখে " মামনি" সম্বোধনটা যেন  সেই নরম ক্ষততে কাঁটার আঘাত দিচ্ছে।তবে সেদিন বোঝেনি ছোট্ট তিতিনের কাজের পেছনে আরেকজন ছিল।সেদিন এই তিতিন আর ওর ঠাম্মামের  ষড়যন্ত্রেই মানসীর এই সন্তানশোক।


--  মামনি তুমি এমন চুপ করে থেকোনা  প্লিজ। কিছু  বলো...


অনেককিছুই বলতে পারে মানসী কিন্তু কিছুই বলতে পারছেনা। উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ায়। 

 --  মামনি,  আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি মামনি। শুধু তোমার কাছে সব দোষ স্বীকার করব বলে। তোমার ডায়েরি পড়ে বুঝেছি আমি কত ভুল করেছি। মামনি যা করেছি তার কোনো ক্ষমা হয় না তবু যদি পারো ক্ষমা করো।


নিজেকে সামলে কান্নাভেজা গলায় তিতিন বলে,

--  মামনি, ডায়েরিটা রেখে গেলাম তোমার কাছে।  আমার অপরাধের স্বীকারোক্তি  হিসেবে। বাকিটা তোমার হাতেই ছেড়ে দিলাম। আমি আসছি মামনি। 


 মানসী ঝাপসা চোখে দেখে তিতিন অনাথাশ্রমের গেট পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে  গেল একটু একটু করে।বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। কত ছোট ছিল মেয়েটা। অনেক বড় হয়ে গেছে।


ডায়েরিটা তুলে নেয়। অমলতাসের শুকনো পাতার গায়ে হাত বুলিয়ে যেন অমলদার  স্পর্শ  অনুভব করে। বুকমার্ক। জীবনের  একটা অধ‍্যায়ের নিশান।  ডানদিকের পাতায় তিতিনের হাতের  লেখা। মানসী পড়তে  শুরু  করে....



ভোরের আলো ছুঁয়ে যায় মানসীর খাট।  ডায়েরিটা পড়তে পড়তে কখন রাত শেষ হয়েছে খেয়াল নেই। পাতায় পাতায়  অপরাধবোধের অনুতাপ। আর মানসীকে খুঁজে  না পাওয়ার হাহাকার। কোথাও লেখা,

"একবার ফিরে এসো মামনি, তুমি  যা বলবে তাই করব"

 আবার কোথাও  লেখা,

"  কখনওই কি আর তোমাকে  খুঁজে  পাব না মামনি!"

 

 অমলতাসের পাতা দিয়ে নিশান করেছিল  যে পাতাটা মানসী। পাতাটা আবার খোলে। তিতিনের লিখিত  স্বীকারোক্তি,


"  ঠাম্মাম বলেছিল যদি তোমার পেটের ভেতরে থাকা ভাইটা আর তুমি দুজনেই  মরে যাও তবে বাবা আবার  আমাকেই  শুধু  ভালোবাসবে। 

মামনি, সেদিন তাই ঠাম্মামের কথা শুনে আমিই  তোমাকে ডেকেছিলাম নীচ থেকে।ঠাম্মাম সিঁড়িতে জল আগেই ফেলেছিল।  যাতে তুমি দৌড়ে নামতে গিয়ে অসতর্ক হয়ে  পড়ে যাও। আজ স্বীকার করতে বাধা নেই। যখন তুমি পড়ে গেলে চোখের সামনে। তখন খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুমিও মরে গেছ। বাবা শুধু আমাকেই  ভালোবাসবে। কিন্তু  হঠাৎই দেখি ঠাম্মাম বাবার অফিসে ফোন করল। বাবা এলো তোমাকে নিয়ে নার্সিংহোমে গেল। আর তারপর যেদিন তুমি বাড়িতে এলে। আর আমাকে দেখেই কেমন হয়ে গেলে। কিসব বলতে বলতে আমাকে মারতে  আসলে। ভয় পেয়েছিলাম খুব। ঠাম্মাম আর বাবা তোমাকে ধরে রাখতে পারছিল না। তারপর তোমাকে নিয়ে গেল অ‍্যাসাইলামে।  মামনি তারপর সব কেমন  বদলে গেল। "

অমলতাসের বুকমার্কটা আবার  ডায়েরির সেই পাতায় রেখে ডায়েরিটা বন্ধ করে মানসী। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের ছবি। সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা মানসী সেদিন দুপুরে একটু চোখ বুজেছে। তিতিনের স্কুল ছুটি। ঠাম্মামের ঘরেই আছে। হঠাৎই তিতিনের একটা চিৎকার  শুনে ঘুমটা ভাঙে। দৌড়ে বেরিয়ে দেখে তিতিন একতলায় মাটিতে বসে কাঁদছে।  তাড়াহুড়োয় ঘুমচোখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যায়। 

জ্ঞান আসতে নিজেকে নার্সিংহোমের বেডে খুঁজে পায় মানসী। সিস্টারের থেকে  জানতে পারে অমলদার শেষ চিহ্ন চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। আর এটা যে একটা সুপরিকল্পিতভাবে সাজানো  দুর্ঘটনা সেটা বুঝতে পারে। এক প্রচণ্ড  আক্রোশ আর ঘৃণা জন্মায় তিতিনের  ওপর। সুস্থ হয়ে  বাড়ি  ফিরতেই  তিতিনকে দেখেই  আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেনা মানসী। 

    তারপর ...

 জীবনটা বদলে গেল অ‍্যাসাইলামে আর পরবর্তী সময়ে। শুধু সেদিনের জন্য  ক্ষমা করতে পারে না তিতিনকে। কিন্তু  আজ ডায়েরির লেখাগুলো নাড়া দিয়ে গেল মানসীকে। তিতিনের দিক থেকে ভাবে।  একটা ছোট বাচ্চার মনে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন শাশুড়ি মা। তিতিনের দোষ   বোধহয় সেভাবে দেখতে গেলে ছিল না।  আর এতগুলো বছর ধরে যে অপরাধবোধের গ্লানিতে ভুগছে মেয়েটা। তাতেই বোধহয় এই অপরাধের থেকে  মুক্তি  দেওয়া যায়  তিতিনকে। শুধু অমলদার  শেষ চিহ্নটা...

      

ডায়েরির থেকে অমলতাসের শুকনো পাতার বুকমার্কটা তুলে নেয় মানসী।এই ডায়েরিটাই তো অমলদার দেওয়া। অমলতাসের পাতাটা বের করে আবার   সেই পাতার মাঝে রাখে মানসী। বাঁদিকে মানসীর শেষ লেখা আর ডানদিকে  তিতিনের লেখা শুরু। দুটো মনের ভিন্ন ভাবনার যোগসূত্রের মতো আটকে থাকে অমলতাসের শুকনো পাতার বুকমার্ক...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন