এক সাধারণ রক্তপাত ও নগণ্য অক্ষরমালা
বিশ্বাস করুন প্রতি স্বপ্নে আপনার রঙ বদলে যায়।বেশ কয়েকদিন আগে পাহাড়ের গা বেয়ে যেখানে ঝোরা এসে থমকে গেছে।ভালোবেসে পাহাড়ের প্রাচীন শ্যাওলা নীরবে স্হির হয়েছে।সেই বরফের কাছে যখন আপনি আমায় ডাকলেন সেদিন আপনি ঘোরতর নীল ছিলেন।ভেবেছিলাম নীলান্ত বলে ডাকি কিন্তু কোন শব্দ উচ্চারণ পেলনা।কেবল আপনাকে ছুঁয়ে থাকার আনন্দে নিজেকে বদলে নিলাম ঝিরঝির হাওয়ায়।আপনার অবিন্যস্ত চুলের ভেতর দিয়ে নাক ডুবিয়ে শ্বাস নিলাম।ঘুমটা ভেঙে যেতেই ভারী কষ্ট হল।খুব ইচ্ছে হল এখনি আবার ঘুমিয়ে যাই কিন্তু ঐ মিসেস ভট্টাচার্য এমন চিল চিৎকার জুড়ল যে অগ্যতা অভ্যাসে মন দিতেই হল।
-শিকখিতোর ক্যাঁথায় আগুন।ঘাঁটে তো গু মুত।এত ঘুম আসে কোথা থেকে?মায়ে খেটে মরে আর ধুমসি স্বপন দেখে।
মনে মনে হেসে মস্তিষ্ক টাকে ঘুম পাড়িয়ে পথে উঠলাম।এবার অনেকটা পথ।নিজেকে কোন রকমে চারজনের সিটে ঠুঁসে ঠেলে ভর্তি করে দিয়ে তবে শান্তি।ট্রেন ছাড়ল,দৃশ্যপট বদলে গেল।বাইরের ধানগাছ গুলো তখন হাওয়ায় উড়ছে।'আজ আমাদের ছুটি ও ভাই,আজ আমাদের ছুটিইইই,আহাহাহাহা'আমাকেও পায় কে?দিলাম ছুট।ঠিক যেন লাটাইয়ের সুতোর টানে পতপত করতে থাকা ঘুড়ি।উড়তে উড়তে শুনলাম কে যেন বলছে,'এই মহিলা ট্রেনে উঠে বসতে পেলেই হল,অমনি ঢুলতে শুরু করবে।ইস্ তাওতো বিয়ে হয়নি।তাহলে তো আর দেখতে হত না।' কোন এক নিত্য সহযাত্রী বেশ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গেয়ে উঠল,'আর বর!যা রূপ!যা বয়েস!এখন আর বর জুটবে না।কিসের দেমাগ কে জানে?কারো সাথে একটা কথা পর্যন্ত বলেনা।'আমার ঘুড়ি ততক্ষণে নেশারুর মতো ঘোঁত্তা খাচ্ছে।স্পষ্ট দেখলাম নীচের ধানক্ষেতে আপনি দুহাত ছড়িয়ে কাকতাড়ুয়া সেজেছেন।কি বিচিত্র শখ আপনার এমন রাজপুত্রের মতো কাকতাড়ুয়া হয় বুঝি?কি সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে।ঠিক ঘন সবুজের মাঝে এক টুকরো জমাট সাদা মেঘ।আপনি চোখের ইশারায় ইঙ্গিত পাঠাতেই সাঁই সাঁই করে নামতে লাগলাম।আমার চোখে মুখে আপনার ভালোবাসা,বিন্দু বিন্দু জলকণা হয়ে ফুটে রইল।আজ আপনি শুভ্রজ্যোতি।
-আরে একটু সরুন না।এ্যাহ্ এত ঘেমো শরীর একটু দূরে রাখুন।
স্বপ্ন আর বাস্তবের পার্থক্য সামাণ্য একটু। চোখ বুজলেই ভুলে যাই আমি তমসা ভট্টাচার্য।বয়স সাঁইতিরিশ।মানিকতলার 'বোস পলি ক্লিনিকে'র স্যাম্পেল কালেক্টার।স্বপ্নে আমি অস্মিত বোসের ড্রিম গার্ল হয়ে উঠি।ট্রেন থামতেই সংকোচে নেমে যাই।ভীড় আমার খুব পছন্দ আমাকে কেউ লক্ষ্য করে না।আমি যেন কোথাও কোন ভাবেই নেই।এই নেই হওয়াটাই আমার কাঙ্খিত।কেবল বাসে ওঠার সময় কন্ট্রাক্টর যখন তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে,'মানিকতলা তো!ঐদিকে যান।'আর তার পাশ দিয়ে যেতেই কনুইটা আমার বুক ঘষটে দেয়,তখন খুব খারাপ লাগে।বুঝি এ আমার অযাচিত প্রাপ্তি।এমনকি রঞ্জিত বাবু যখন গুটখা খাওয়া দাঁতের ফাঁক দিয়ে রোজ প্রায় বলেন,'স্টুলের স্যাম্পেলটা তুমিই নিও।মিস্ নন্দিনী ঠিক...মানে বুঝতেই তো পারছো।'আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি নন্দিনীকে যা মানায় না আমায় তাই মানায়।নন্দিনী কেবল রিপোর্টে নাম লেখে।
জানেন স্কুলে আমি হাতের লেখায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম।অনিতা রুদ্র আমাদের বাংলার দিদিমণি খুব প্রশংসা করেছিলেন।
-এ্যাই দেখ মুক্তোর মতো লেখা কাকে বলে।
তারপর থেকে সবার প্রেমপত্র আমি লিখতাম।কি ভীষণ সুখের কথা,আদরের কথা,অভিমানের কথা সারা জীবন লিখেছি।একবার রাহুলদাকে চিঠি লিখেছিলাম চিত্রার হয়ে।রাহুলদা চিঠিটাতে চুমু খেয়েছিল চিত্রাকে দেখিয়ে।আমিও দেখেছিলাম।সেদিন সারারাত ঐ চুমু অজস্রবার আমার শরীর জুড়ে বৃষ্টি নামিয়েছিল।আমি স্বপ্নে ডুবেছিলাম।তারপর বাবা রেলে কাটা পড়ল আমার পড়া বন্ধ হয়ে গেল।স্কুলের দিদিমণিরা বাড়ি এসেছিল।ওদের জন্যই উচ্চমাধ্যমিকটা দেওয়া হল কোনমতো।কিন্তু ইতি হল পড়াশোনার।ব্লাউজে হুক লাগানো,রণির ঠাকুমার দেখভাল যা যখন পেয়েছি করতে হয়েছে।যেদিন সমরেশজ্যেঠু আপনার এখানে আনলেন,খুব লজ্জা পেয়েছিলাম।
-স্যার যা হোক একটা পারমানেন্ট কাজ দিন।মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালো না বলে বিয়েটাও হলনা,ওর মা দশবাড়ি কাজ করে কোনরকমে চালাত কিন্তু বাতের ব্যথায় বিছানা শয্যা।এখন খেতে পাচ্ছেনা স্যার।বড়ো ভালো মেয়ে।
আপনিও কুন্ঠিত হয়েছিলেন,আমিও।আপনার দু চোখে করুণা,মুখে বেদনার হাসি।আপনাকে সেদিন জীবনানন্দের ব্যথিত বটের ফল মনে হয়েছিল।
-এভাবে বলবেন না সমরেশবাবু,সৌন্দর্য কোন কিছুর মাপকাঠি নয় অন্তত আমার কাছে।মানুষের যোগ্যতাই শেষকথা।আপনি তো জানেন আমাকে।
-তাইতো আপনার কাছেই আনলাম।
সেদিন স্বপ্নে একটা রেডিও দেখেছিলাম।ধূধূ মরুভূমির উপর দাঁড়িয়ে সেই রেডিও শুনছিলাম একা।আমার আঁচলে কুর্চি বাঁধা।রেডিও বাজছে,'মানুষের যোগ্যতাই শেষকথা...মানুষের যোগ্যতাই শেষকথা'আপনি দূরে দাঁড়িয়ে।এখনো দূরে বহুদূরে আপনি।আপনার গাড়ি এসে থামে। দুধসাদা কন্টেসা।একা নায়কের মতো নিজের আলো ছড়িয়ে হেঁটে যান।আমি তখন হাজার চেষ্টা করেও তাকাতে পারিনা,দ্রুত হাতে ইউরিন স্টুল কালেক্ট করি।আমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে চাই।একেকদিন যখন আপনি হালকা হেসে বলেন,'কি কাজ ভালো লাগছে?'বলতে পারিনা আমার হাতের লেখা নন্দিনীর থেকে ভালো,আমাকে কি ওর কাজটা দেওয়া যায়?যদিও বলতে পারিনা।কেবল মাথা নামিয়ে ঘাড় নাড়ি।সেই দিনগুলোতে স্বপ্ন দেখি,ধাপার মাঠে আমি আটকে গিয়েছি।তীব্র কূট গন্ধ আর গাঢ় কালো সেই আবর্জনাতে আমি মরে যাচ্ছি।আপনি আস্ত অমলতাস হয়ে বাড়িয়ে দিলেন হাত।প্রাণপন চেষ্টা করেও কিছুতেই ধরতে পারলাম না আপনাকে।
এরপর এক মিষ্টি শীতের শেষ বিকেলে আপনার চেম্বারে আমায় ডাকলেন।সুগন্ধী সতেজ তরুণ এক মহামানব যেন।সাধারণ খোঁজ খবর তারপর এক দমকা হাওয়া।
-আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে মিস্ তমসা।মা বাবাই ঠিক করেছেন।আসলে আমেরিকা চলে যাবার আগে বিয়েটা না দিয়ে তারা ছাড়তে রাজি নয়।রিসেপ্সান ম্যারিয়েটে।এখন মুশকিল হচ্ছে সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেও আপনাকে যে আমন্ত্রণ জানাতে কুন্ঠা হচ্ছে।আপনি কারোর সাথে মেশেন না,কোথাও যান না।অবশ্য আপনার দায় দায়িত্ব অনেক বেশি,সেটা বুঝি।তবে আপনি নিজেকে নিয়ে বড়ো সেকি বোধ করেন।এটা ঠিক না।সবাই কিন্তু এক নয়।
অনুমতি নিয়ে একটিও কথা না বলে চলে এলাম।ফিরতি ট্রেন,ভীড়,চার নম্বর সিট আর আমার চোখ জড়ানো ঘুম।বিশ্বাস করুন প্রতি রাতে আমার স্বপ্নে আপনার রঙ বদলে যায়।নীল,সাদা,লাল,হলুদ।আমি আপনার ঐ একটা কথা রেডিওতে রোজ বাজতে শুনি মানুষের যোগ্যতাই শেষকথা।আমি ভীষণ বিশ্বাস করি এই কথা।আজ সব কেমন অন্ধকারে গুটিয়ে যেতে দেখছি অথচ আপনি ডাকলে আমি ম্যারিয়েটে গিয়ে আপনার স্ত্রীকে এক আঁচল শিউলি উপহার দিয়ে আসতাম।আমি কিন্তু সবাইকে এক ভাবিনি।বোধহয় ভাবা উচিৎ ছিল,তাইনা!আচ্ছা আপনি কি আমায় বিয়েতে নিমন্ত্রণ করছিলেন?কি জানি?বুঝিনি বোধহয়।
আমি তমসা ভট্টাচার্য ঘুমাই খুব ঘুমাই।যেখানে যখন সুযোগ পাই ঘুমাই।আশেপাশে পরিচিত শব্দ,'ইস্ ম্যাগো ঘুমিয়েই বোধহয় ওর সব হয়।বাস্তবে তো কচুপোড়া।'কানে ঢোকে তবে মাথায় ঢোকাই না।আজ আমি স্বপ্নে আবার আপনাকে দেখতে পাবো কিনা ভাবতে ভাবতে কালো ঝড়ের মতো ডানা মেলে আপনি গিলে নেন আমাকে।আমার দমবন্ধ হতেই মিসেস ভট্টাচার্য চিৎকার করে ওঠে,'পঙ্গু মা খেটে মরবে আর ধাড়ি ধুমসি খালি স্বপন দেখবে,দেখ্ দেখ্ মুখপুড়ি,ঐ স্বপনেই মর্।' জানেন আমার আর চোখ খুলতে ইচ্ছাই হলনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন