শনিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২২

পাপিয়া গাঙ্গুলি

                           


চা চাই 
 

বাসটা মিস করলো গুপি। রাতের শেষ বাস ছিল। দূরপাল্লার টাইমের বাস। অফিসে আজ মিটিং ছিল। শেষ হতে রাত হয়ে গেল। বাবুরা তো গাড়িতে উঠে হাওয়া। তাদের আর কি। কাল রবিবার ভাগ্যিস। নাহলে আবার ভোর না হতেই অফিস খুলতে দৌড়াতে  হতো। সকাল নটায় অফিস শুরু। গুপি তার আগে এসে  অফিস খুলে আলো জ্বালায়। এসি চালিয়ে সাফ সাফাই করে রাখে। এমনিতে খুব দেরী হলে গুপি রাতে  থেকে যায় অফিসে। কাল মায়ের কি একটা পুজো আছে। ফোনে অনেকবার বলে দিয়েছে। বাড়ি যেতেই হবে। ট্রেন ধরা ছাড়া উপায় নেই।দুপুরে আকাশভাঙা বৃষ্টি হয়েছে। গরমের থেকে একটু রেহাই। এখন বৃষ্টির জোর কমলেও পুরোপুরি থামেনি। জল কাদা পেড়িয়ে শিয়ালদা স্টেশন পৌঁছলো। আধঘন্টায় পরের ট্রেন। এই বৃষ্টিতে চা ছাড়া বসে থাকা বিরক্তিকর। খিদেও পেয়েছে অল্প। চা পেলে খিদেটাও মরতো কিছুটা। 
চা খুঁজতে শুরু করলো। রাতের স্টেশন আজ অনেক খালি। হয়তো বৃষ্টির জন্য।
 " চায়ে গরম চায়ে "বলে কোনো হাঁকাহাঁকিও নেই। 
গুপি হাঁটাচলা করতে করতে একটা বেঞ্চে বসলো। মনটা চা চা করছে।  চা পাচ্ছে না।  একটু বিরক্তি এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এমন মুহুর্তে একটা চায়ের কাপ তার সামনে ঝুলতে দেখলো। 
 আনমনা ছিল তাই তার পাশেই এক চাওয়ালা  কখন এসে নিশব্দে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। চা'ওয়ালা ছেলেটা নিজে থেকেই একটা কাগজের কাপে চা এগিয়ে দিয়েছে  তার দিকে। ছেলেটা কি তার মন পড়তে পারলো? সে যেমন জানতে পারে অফিসার বাবুদের চা চাওয়া মন।  কিছু না বলে হাত বাড়িয়ে চায়ের পয়সা এগিয়ে দিয়ে  কাপটা নিল  গুপি। ধোঁয়া ওঠা চা... মনটা খুশী হয়ে গেল। 
ট্রেনের হুইসেল। দ্রুত চুমুকে শেষ করলো চা। আজ ঠেলাঠেলি নেই । ঠেলাঠেলি কি প্রায় কোনো লোকই নেই। আশ্চর্য লাগলো।
একটা বসার জায়গায়ও পেল। জানলার পাশে। সেই ছোটো থেকেই জানলার পাশে সিট পেলেই তার মন ভালো হয়ে যায়। জানলার পাশে গুছিয়ে বসলো। এই কামরায় আর কেউ নেই। নিশ্চিন্ত লাগলো। নাহ্!   একজন প্যাসেন্জার  এলো পাশে । গুপী তাকিয়ে দেখলো।  মুখটা কেমন চেনা লাগলো ।  কোথায় দেখেছে। মাথা খাটাতে ইচ্ছে করছে না। তবে মাথায় ঘুন পোকার নিঃশব্দে কাজ চালাচ্ছে ভাবনাটা। ট্রেনটা খালি। সাড়াদিন খুব ধকল গেছে।  জানলার ঠান্ডা হাওয়া চোখটায় ঘুম এনে দিয়েছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানেনা।  একটা ঝাঁকানির  আওয়াজে ঘুমটা ভাঙলো। কোন স্টেশন দেখলে বোঝা যাবে কতটা ঘুমালো সে।
বাইরে তাকিয়ে দেখলো কোনো স্টেশন নয়। ঘুটঘুটে অন্ধকার শুধু। যাকে নিকষ কালো বলে। কিছু ঠাহর করা যাচ্ছেনা। 
কি আবার হলো!  ঘুম চোখে এদিক ওদিক  দেখলো।  পাশের লোকটা তার দিকে তাকিয়ে। কেমন অর্থহীন এক চাহনি। তার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে কেন? সেই চেনা চেনা মুখটা। 
হ্যাঁ ঠিক, মনে পরেছে এটা তো স্টেশনের চা'ওয়ালা ছেলেটা । চা বিক্রি করতে করতে ওর সহযাত্রী হলো কি করে!  ভাবতে ভাবতে নিজের জায়গায়  গুটিয়ে বসলো গুপী। কি এক অস্বস্তিকর অনুভূতি। শান্ত হয়ে বসতে পারছে না।  চারপাশে তাকিয়ে দেখলো।  এত ভিড় তো ছিল না!!! আশ্চর্য,  ভীড়ে  কোনো লোক দেখা যাচ্ছেনা।  সবকটা শুধু মুখ আর জোড়া জোড়া চোখ দেখা যাচ্ছে। বেড়ালের চোখের মত চোখ গুলো জ্বলছে।   তার দিকেই তাকিয়ে চোখ গুলো । প্রতিটি মানুষের মুখ একই রকম দেখতে। মানে প্রত্যেকের মুখ ঠিক  স্টেশনের চা ওয়ালা ছেলেটার মতো। ঠান্ডা নিস্প্রাণ জ্বলজ্বলে দৃষ্টি নিয়ে পুরো ভীড়টা তার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে বসা সহযাত্রীও  একই দৃষ্টিতে একটা কাগজের কাপে চা এগিয়ে দিয়েছে তার দিকে। কাপটা দেখা যাচ্ছে। কারোর হাত দেখা যাচ্ছে না।   হিমেল হাওয়া গুপীকে আরও ঠান্ডা করে দিচ্ছে। ভেতরেও একটা ঠান্ডার স্রোত।  গুপী জোর করে নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ের কাছে ফিসফিসানি " চা' টা গরম কিন্তু। " মনে হচ্ছে অনেক লোক একসাথে হিসহিসিয়ে  কথা বলছে।
গুপী সামনে হুটোপাটি করে এগোতে থাকলো। মনে হলো অনেক পায়ে তার পা আটকে যাচ্ছে ।অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। গুপী ভিড় ঠেলে এগোবার মত করে চেষ্টা করলো ।  দিশেহারা অবস্থা।  ট্রেনটাও চলছে না।  আলো গুলোও জ্বলছে না।  হঠাৎ অনেক লোকের গলা শুনতে পেল। সামনেটা খালি লাগছে। এখন একটা আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে কিছুটা। একটা জটলা।  নিজেকে সে ট্রেনের দরজায় আবিস্কার করলো। জটলাটা ট্রেনের পাশের লাইনে।  গুপী অতগুলো মানুষ দেখে স্বস্তি পেলখানিক।  একলাফে নীচে নামলো। তারপর জটলার দিকে এগোলো। ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল। একটা থ্যাতলানো মৃতদেহ। মুখটা চেনা যাচ্ছে না। শার্টটা চেনা।  পকেট থেকে আইডি  কার্ডটা বেড়িয়ে আছে। ছবিটা তার নিজের। জামাটাও শেষ পুজোয় মায়ের দেওয়া নীল শার্টটা।  গুপী চমকে উঠলো।  চারপাশের লোকগুলোকে দেখলো। সব লোকগুলো অবিকল চা' বিক্রেতা ছেলেটা। তার দিকে তাকিয়ে শীতল ক্রুর দৃষ্টিতে হাসছে।  পেছনে ট্রেনটা চলতে শুরু করলো ঘটাং ঘটাং শব্দ তুলে। প্রতিটা চা'ওয়ালা এক কাপ করে চা ঢেলে দিচ্ছে তার থ্যাতলানো মুখের ওপর। চারপাশে হাওয়ার মত উড়ে বেড়াচ্ছে একটা কথা "চা চাই, চা চাই। " 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন