শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

কাজল সেন






ন হন্যতে

এভাবে চলে যাবার কোনো মানেই হয় না। এটা নিতান্তই বোকামি এবং হঠকারিতা। জীবন তো একটাই। তাহলে সেই জীবনে মাঝপথে ইতি টেনে কী লাভ! এই কথাটা শ্রমণা বারবার বোঝাতে চেয়েছে  অতীন্দ্রিয়কে। কিন্তু অতীন্দ্রিয় সেকথা বেঁচে থাকতে যেমন কানে নেয়নি, তেমনি যখন তার নিষ্পন্দ ঝুলন্ত শরীরটা সিলিংফ্যান থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো, তখনও নয়। অথচ অতীন্দ্রিয় যে বিরাট আবেগপ্রবণ ছিল, তাও তো নয়! যথেষ্ঠ বিচার বুদ্ধি বিবেচনা ছিল তার। ছিল মানবিক এবং সংবেদনশীল। তবু কেন যে অতীন্দ্রিয় হঠাৎ এমন জীবনবিমুখ হয়ে উঠল, শ্রমণা তার কোনো কূল কিনারা খুঁজে পায় না। 

শ্রমণার জীবনের আয়োজন খুবই সামান্য। সে নিজেও অসামান্যা নয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের নিপাট গৃহবধূ। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখি পরিবার। শরীরও অসুখি নয়। যতটা চাহিদা সবটুকুই তার স্বামী পূরণ করে দেয়। সংসারে অনটনেরও কোনো চিহ্ন নেই। তবুও কী যে হয়, শ্রমণা নিজেও ঠিক অনুধাবন করতে পারে না, অতীন্দ্রিয় তাকে যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। শ্রমণা সেই আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারে না। তাকে ছুটে ছুটে যেতেই হয়। অতীন্দ্রিয়র মুখোমুখি বসে। কথা হয়। অনেক কথা। কথা না বলে চুপ করে বসে থাকে। অনেকক্ষণ। অতীন্দ্রিয় খুশি হয় শ্রমণা এলে। শ্রমণাকে সে দেখে। গভীর চোখে দেখে। কিন্তু স্পর্শ করে না। কোনো ইঙ্গিতও করে না। শ্রমণা অতীন্দ্রিয়র ধরাছোঁয়ার সীমানায় অনেকটা সময় এভাবেই কাটিয়ে একসময় ফিরে আসে নিজের সংসারে। মন জুড়ে তখন তৃপ্তির আশ্চর্য এক শান্ত আবহাওয়া।

অতীন্দ্রিয় কখনও বাধা দেয়নি শ্রমণাকে। নিষেধও করেনি। শুধু জানিয়েছে তার  সীমাবদ্ধতার কথা। বোঝাতে চেয়েছে তার অক্ষমতার বেদনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই একসঙ্গে পড়ার দিনগুলো থেকে আত্মহননের আগের দিন পর্যন্ত শ্রমণাকে একই কথা বারবার বলে এসেছে, আমার জন্য তুই ভাবিস না শ্রমণা। তুই ভালো থাকিস। খুব ভালো থাকিস। তুই ভালো থাকলেই আমিও ভালো থাকব।

না, শ্রমণাও কখনও অনুযোগ জানায়নি অতীন্দ্রিয়র কাছে যে, সে কষ্টে আছে, দুঃখে আছে। বরং সে সত্যিই ভালো আছে। অতীন্দ্রিয় নিতান্তই সাদামাটা কথায় জানিয়েছিল, শ্রমণা তার জীবনে এলে কিছুই তো সে দিতে পারবে না! পরমতম শারীরিক সুখ, সন্তান, কিছুই না। তাহলে শ্রমণা কেন বঞ্চিত হবে এই জাগতিক চাওয়া পাওয়া থেকে! শ্রমণা অতীন্দ্রিয়র কথা মেনে নিয়েছিল। জীবনের সব আয়োজনই তার পূর্ণ হয়েছিল। তবু কী যে এক অদৃশ্য সূতোর টান তাকে বারবার টেনে নিয়ে যেত অতীন্দ্রিয়র কাছে, সে যেতে বাধ্য হতো, তার কার্যকারণ অধরাই থেকে যেত শ্রমণার কাছে।

সেইসঙ্গে অতীন্দ্রিয়কে সে বোঝাতো, তুইও ভালো থাকিস অতীন্দ্রিয়। জীবনে যে যতটুকু পায়, তাকে তাই নিয়েই ভালো থাকতে হয়। জীবনকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবার কোনো যুক্তি নেই। তুই কখনও হারিয়ে যাস না অতীন্দ্রিয়। তুই হারিয়ে গেলে আমিও যে হারিয়ে যাব অতীন্দ্রিয়!

বেশিক্ষণ মৃতদেহের পাশে বসে থাকতে পারেনি শ্রমণা। পালিয়ে এসেছিল। পালাতে চেষ্টা করছিল নিজের কাছ থেকেও। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন