ফেরিওয়ালা
কলিমুদ্দিন শেখ গ্রামের মেলায় ঘুরে ঘুরে মুখোশ বিক্রি করে। অবশ্য শুধু মুখোশ বেচে পেট চলেনা, তাই তার সাথে লাট্টু, বাঁশি, পটপটে প্লাস্টিকের পুতুল, বল এমন নানা ছেলে ভুলানো জিনিস তার বাঁশের লাঠিতে ঝোলে। তবে মুখোশটা কলিমের যাকে বলে খুব ইস্পিশাল। সে কাগজের মুখোশ কিনে তাতে রং করে, দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে চকচকে পালিশ করে বেচে। বাঘ, ভূত, জোকার, কঙ্কাল কি নেই তার সম্ভারে। কলিম আসলে মনে প্রাণে শিল্পী, কাগজের মুখোশ তার ক্যানভাস। বাপ দাদার ধারা সে বয়ে চলেছে পরম যত্নে। যত যত্ন করে বানাক না কেন বিক্রি বাটা যে খুব একটা হয় তা কিন্তু নয়। গ্রামের মানুষ বেশিভাগই গরীবগুর্বো... পাঁপড়, ঘুগনি, নাগরদোলার পর মুখোশ কেনার পয়সা তাদের বিশেষ থাকে না। বাচ্চাগুলো হাঁ করে মুখোশ দেখতে দেখতে চলে যায়।একটু খারাপই লাগে কলিমের।
নতুন নতুন চমকদার মুখোশ বানানো কলিমুদ্দিনের নেশাও বটে। সে অনেক ভেবেচিন্তে একটা অন্য গ্রহের প্রাণীর মুখোশ বানালো চড়ক পুজোর ঠিক আগে। সবুজ মুখ, ট্যারচা লাল চোখ , মাথায় একটা শিং মুখে হাসি নেই তবু মুখটা হাসি হাসি... নাম তার পটাশ। চড়কের মেলায় অনেকগুলো বিক্রি হলো মুখোশটা। গাজনের মেলা, রথের মেলা, ইতু ভাদু সব মেলাতেই ভালো বিক্রি হলো পটাশ।
এই সব গ্রামের মেলায় শহরের বাবু বিবিরা একেবারে আসে না তা কিন্তু নয়। তারা আসে... পুতুল, বেতের ঝুড়ি, গামছা সবকিছু দেখেই 'কুট কুট' বলে, পোঁটা ঝরা বাচ্চা থেকে নাগরদোলা সবকিছুর ছবি তোলে তারপর জিলিপি বা পাঁপড় হাতে নিজেদের ছবি তুলে বোতলের জল খেয়ে গাড়ি করে ফিরে যায়। কলিমের মুখোশ এরা কখনো কেনেনা, শহরের দামী দামী রবারের মুখোশের খদ্দের এরা।
রাসের মেলায় একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটলো। কলিম মুখে পটাশের মুখোশ পরে তার হরেক খেলনা বিক্রি করছিলো একটা বাবুদের বাচ্চা ছেলে হঠাৎ তার মুখের দিকে দেখিয়ে বললো
" দেখো বাবা মাস্কটা একদম আমার ইরুগ্রিনের মতো দেখতে না?"
বাবা বুঝতে না পারায় ছেলেটা অধৈর্য হয়ে আবার বললো
" লাস্ট সানডে টয়ল্যান্ড থেকে যে মাস্কটা কিনলাম"
তার বাবা একঝলক দেখে একটু বিদ্রুপের সাথে বললেন
" ওই দামী কোম্পানির মুখোশ কোথাও দেখে থাকবে…ডুপ্লিকেটে দেশটা ছেয়ে গেল!"
কলিমুদ্দিনের মনে পড়ে চড়কের মেলায় একটা বাবু খুব যত্ন করে পটাশের ছবি তুলছিলো বটে। তবে একটা পটাশও লোকটা কেনেনি। খামোখা কলিমের হাতে দশটা টাকা ধরিয়ে চলে গিয়েছিলো। নিশ্চয়ই সেই লোকটাই….
এতো তার শিল্পী সত্তার অপমান, সে কিনা হলো চোর চোট্টা? রাগে কলিমের মুখটা মুহূর্তে লাল …. ক্ষোভে চোখ ফেটে জলের স্রোত নেমে এলো।
আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে কেউ অবশ্য জানতে পারলো না গরিব শিল্পীর সস্তার চোখের জলের ইতিহাস, কলিমুদ্দিনের সব অসহায়ত্ব ঢেকে দিলো তারই সৃষ্টি মুখে পরে থাকা একটা সস্তার মুখোশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন