শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

ওদের কথা


খুব শীত করছে আমার । অনেকক্ষণ ধরেই করছে । কিন্তু কাউকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না । আর একটু দেখি । তারপর না হয়  . . .
তার থেকে বরং একটু গল্প করি আপনাদের সঙ্গে । না, না, বরং গল্প বলি । শুনবেন ? তাহলে হয়তো কিছুটা আমি অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে পারব । শীতটাও হয়ত এতটা করবে না । আর সময়টাও কেটে যাবে ।
তাহলে শুরু করি ? একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন প্লিজ ।
গল্পটা দুজনের । আমার মনে হয় গল্পটা খুব সাদামাটা । শোনার পর আপনারাও হয়তো তাই বলবেন । তাও কেন জানি না, শোনানোর বড্ড ইচ্ছা করছে । বলছি কিন্তু তাহলে ।
গল্পটা নীলা আর রুমির । নীলা আর রুমি জন্মেছে আলাদা জায়গায়, ছোটবেলাটা কেটেছে আলাদা জায়গায় । ব্যস্‌, এটুকুতেই অধৈর্য হয়ে গেলেন তো ! ভাবছেন আলাদা হলে গল্পটা তাদের হয় কী করে ? মিল ছিল তো । দুজনে এক শহরের বাসিন্দা ।
খুব ছোট থেকে না হলেও কিশোরীবেলা মানে ক্লাস এইট থেকে একে অপরকে দেখে বড় হয়েছে । না,না, একটু ভুল হলো । নীলা কোনদিন রুমিকে দেখেনি । আরও ডিটেইলসে বলতে গেলে বলতে হয়, নীলা কোনদিন রুমিকে দেখার যোগ্য বলেই মনে করেনি । যে দিনগুলোয় চোখে চোখ পড়তে ভাললাগার রেশ ছড়িয়ে পড়ত যার মনে সে কেবল রুমি । ওই যে ক্লাস থেকে ঢোকা বেরোনোর সময়, ছুটির সময় গেটের সামনে । রুমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখত নীলাকে । কী সুন্দর নীলা । কত দারুণ করে কথা বলে । হাসিটা কী সুন্দর ! এত গভীরভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল কী করে বলুন তো ?  দুজনেই যে এক অ্যাকাডেমীতে নাচের প্রশিক্ষণ নিত ।
জানেন, আসল ব্যাপারটা কিন্তু অন্যরকম ছিল । রুমি অবশ্য পরে জেনেছিল । নীলা ওকেও লক্ষ্য করত ।  কিন্তু না দেখার ভান করাতে সে ছিল ভীষণ পটু । কি অদ্ভুত মেয়ে বলুন তো নীলা ! যাক গে, সে তো পরের কথা । আগের কথা তো আগে বলতে হয় । আমি না হয় গল্পের ল্যাজা মুড়ো সবটা জানি । আপনারা তো আর জানেন না । একেই কীরকম ম্যাড়মেড়ে গল্প । তার ওপর সাযুজ্য না রেখে বললে আপনারা শুনবেন বা কেন ?
 রুমি খুব সাধারণ মেয়ে । অন্তত রুমি তাই জানত । কিন্তু রুমির মধ্যে অনেক কিছু অসাধারণ ব্যাপারস্যাপার অনেকে লক্ষ্য করত । সেই নিয়ে বলাবলি করত । যেমন, রুমির চোখ দুটো খুব সুন্দর । ভীষণ মায়াবী । সেই চোখ সহজেই অন্যের নজর কেড়ে নেয় । রুমি অবশ্য তা কোনদিন বিশ্বাস করেনি । তাহলে নীলা তো তার দিকে ফিরে দেখত । রুমির ব্যবহার খুব ভাল । এটাও সবাই বলত । রুমি ভাবে এই মানুষগুলো তাকে ভালবাসে বলে তার নামে ভাল ভাল কথা বলছে ।
আপনারা হয়তো ভাবতে শুরু করেছেন নীলার মধ্যে কী এমন আছে যে রুমি এত নীলা বলতে অজ্ঞান ।
হ্যাঁ । নীলা সুন্দর । দেখায়, চলায়, বলায়, লেখাপড়ায়, নাচে সব বিষয়ে দক্ষ । বড়লোক বাবার একমাত্র আদরের দুলালী । 
আসল কথাটা কী জানেন ? রুমি দেখেছে তাই নীলা সুন্দর । রুমি ভেবেছে তাই নীলা সুন্দর । রুমি চেয়েছে তাই নীলা সুন্দর ।
ও, একটা বিষয় তো বলা হয়নি আপনাদের । ওরা দুজনেই সমবয়সী । স্কুল আলাদা হলেও ক্লাস এক । দেখুন স্কুল তো আলাদা হবেই । নীলার বাবা একজন নামকরা বিজনেস ম্যান । তিনি যে তাঁর মেয়ে বেস্ট স্কুলিং দেবেন এ আর এমন কী কথা । আরে না, না । আপনারা যেন ভেবে বসবেন না, যে নীলা তার বাবার টাকার জোরে বেস্ট স্কুলে পড়ছে । নীলা নিজে দারুণ ইনটেলিজেন্ট । পড়াশোনাতে ভীষণ মনোযোগী । 
 রুমির বাবা একটা বেসরকারী অফিসে ক্লার্কের চাকরী করে । কিন্তু তাই বলে রুমিকে খুব কষ্ট করে বড় হতে হয়নি । ওর বাবা মাতৃহারা মেয়েকে বুক দিয়ে আগলে বড় করার সঙ্গে সঙ্গে যতটা সম্ভব স্বাচ্ছন্দ্য দেবার চেষ্টা করেছে । রুমি অবশ্য কোনদিন কিছু নিয়েই নালিশ করেনি তার বাবার কাছে । সে কিছুটা তার নিজের জগৎ নিয়েই থাকে । মানে, এই লেখাপড়া, নাচ আর নীলাকে দেখার পর থেকে নীলা ।
রুমি যা স্বপ্নে দেখত তা একদিন বাস্তবে পরিণত হলো । নীলার সঙ্গে কথা হলো, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নাচ প্র্যাকটিশ করলো । আর যেটা হলো নীলা চোখ তুলে রুমিকে দেখলো ।
ইস্‌, দেখেছেন, গল্পটা সুন্দর করে বলা তো দূর, ভাল করেও বলতে পারছি না । অন্য কেউ হলে এটা কত সুন্দর করে বলত । যাই হোক, সুন্দর করে না বলতে পারলেও একটু গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি ।
ওদের এই প্রথম আলাপ হলো অ্যাকাডেমীর অ্যানুয়্যাল ফাংশনে । যেখানে ওরা দুজনেই নাচ শিখছে অনেকগুলো বছর ধরে । কিন্তু আলাদা আলাদা ব্যাচে ।
তখন দুজনেই ক্লাস টেন । শাপমোচন নৃত্যনাট্যে দুই মুখ্য চরিত্রে দুজনে । নীলা কমলিকা, আর রুমি অরুণেশ্বর । সেই দুমাস রুমির জীবনে এক স্মরণীয় দিন । প্রতিদিন বিকালে দু থেকে তিনঘন্টা প্র্যাকটিশ ।
 ফাংশানের দিন । শাপমোচনের শেষ দৃশ্য । প্রদীপের আলোয় কমলিকা মুখ দেখে তার স্বামী অরুণেশ্বরের । রুমি মুগ্ধ হয়ে যায় নীলার অভিনয়ে । পর্দা পড়ার পরেও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীলার দিকে । নীলার খিলখিল হাসিতে চমক ভাঙে ।
‘কী রে রুমি, হাঁ করে কী দেখছিস ?’
‘তোকে নীলা । কী সুন্দর রে তুই ।’
নীলা আবার দমকা হাসিতে ফেটে পড়ে ।
 এই সময় রুমি যেন নতুন করে চিনলো নীলাকে । নীলাও যেন রুমি বলতে অজ্ঞান । আসলে রুমি দেখলো নীলা অহংকারী একেবারেই না । বরং সবার সঙ্গে মন খুলে মিশতে তার কোথাও একটা সংকোচ কাজ করে । কিন্তু যার সঙ্গে মনের মিল হয়ে যায় সেখানে নীলা সাবলীল ।  রুমি সেটা বুঝতে পেরে নিজেই নীলাকে সহজ করে নিলো ।
দুমাস পর যখন ফাংশন শেষ হলো তখন ওরা দুজনে একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । বোর্ড এক্সামের পর দুজনে চুটিয়ে মজা করা যাকে বলে তাই করেছিল । নীলা তাদের বাড়ীতে প্রায় রুমিকে ধরে আনত । জোর করে সারাদিন আটকে রাখত । খাওয়াদাওয়া, হই-হুল্লোড় করে সারাদিন পর রুমি যখন নিজের বাড়ী ফিরত তখন সে যেন নিজের মধ্যেই নেই । যেন হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে । নিজেকে তখন ভীষণ সুখী বলে মনে হতো রুমির ।
এমনই একটা দিনে নীলা হঠাৎ রুমির গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোকে আজ একটা কথা বলব । তুই শুনে যেন হেসে ফেলিস না ।’
নীলার আচরণে রুমি খুশীতে পাগল । উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে, ‘বল । বল । এক্ষুণি বল ।’
‘তুই মাঝেমাঝে বলিস তো অ্যাকাডেমীতে ঢোকা বেরোনোর সময় আমায় দেখতিস আর আমি না কী তোকে দেখতাম না । কিন্তু কথাটা সঠিক নয় রে । আমিও তোকে বারকয়েক দেখেছি ।’ বলতে বলতে নীলা নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ে ।
খুশীতে রুমি দুহাতে আঁকড়ে ধরে নীলাকে ।
সেদিন বাড়ী ফেরে রোজদিনের সাধারণ রুমি নয়, ভাললাগা খুশীতে আচ্ছন্ন রুমি ।
রুমির বাবাও মেয়ের খুশী দেখে মনে মনে একটু শান্তি পেয়েছিলেন । মা-মরা মেয়েটা আজ মন খুলে কারোর সঙ্গে মিশছে, কারো বাড়ী গিয়ে সময় কাটাচ্ছে, এই বিষয়টা তাঁকে বেশ শান্তি দিয়েছিল ।
রেজাল্ট বেরোবার পর যে যার স্কুলে ভর্তি হলেও দুজনে নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিলো, তারা আইএসসির পর এক কলেজে পড়বে । এই দুটো বছরে তাদের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয়ে উঠলো । রুমির খুশীর সীমা নেই । এক কলেজে তারা পড়বে, একসঙ্গে সারাদিন কাটাবে এই চিন্তাতেই যেন বিভোর হয়ে থাকত ।
নীলা ছাড়া তার আর দ্বিতীয় কোন বন্ধু-বান্ধবী নেই । সে চাইত নীলাও যেন তাই করে । কিন্তু নীলার বেশ কিছু বান্ধবী ছিল । রুমি মাঝেমাঝে অল্পস্বল্প রাগ দেখাত ।
‘থাক, থাক । তোর বান্ধবীদের গল্প আমার কাছে বলতে হবে না । তুই আর আমি যখন একসঙ্গে থাকব আমরা শুধু নিজেদের কথাই বলব ।’
নীলার একটু খারাপ লাগলেও চুপ করে যেত । পরে হেসে বলত, ‘ওরা তো বান্ধবী । এরপর আমার বয়ফ্রেন্ড জুটলে তোকে তার কথা বলে কান-মাথা ভোঁ ভোঁ করিয়ে দেব ।’
নীলার কথার উত্তর দিতো না রুমি । শুধু তার চোখদুটো রাগে মুহূর্তখানেকের জন্য ঝলসে উঠত ।
সেই তারা আইএসসি পাশ করে এক কলেজে অ্যাডমিশন নিলো । রুমি ভর্তি হলো ইকনমিক্সে অনার্স নিয়ে আর নীলা ভর্তি হলো জিওগ্রাফিতে অনার্স নিয়ে । রুমি কো-এড কলেজে পড়তে চায়নি । কিন্তু নীলার জোরাজুরিতে ভর্তি হতে বাধ্য হলো ।
‘দেখ রুমি, এতগুলো বছর সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে স্কুল, টিউশন করে আমি সো টায়ার্ড । কলেজটা অন্তত একটু রিল্যাক্স করে করতে দে ।’ হাসতে হাসতে বলে নীলা ।
‘ঠিক আছে । মেনে নিচ্ছি তোর কথা । তবে পড়া ফেলে যদি ছেলে দেখিস তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন ।’ চোখ পাকিয়ে রুমি উত্তর দেয় ।
রুমির কথায় নীলা হা হা করে হেসে গড়িয়ে পড়ে ।
সেই নীলা কিন্তু সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে প্রেমে পড়ল রুবাইয়ের । ওদের কলেজের পাশেই সরকারী ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট রুবাই ।  নীলা মাঝেমধ্যেই ক্লাস বাঙ্ক করে রুবাইয়ের সঙ্গে এদিক-ওদিক পালাত । আবার কলেজ ছুটির সময় ঠিক কলেজেই ফিরে আসত । নীলা ভাবত রুমি কিছু টের পাচ্ছে না । আসলে নীলা এই ব্যাপারটা রুমিকে জানাতে চায়নি । তার মনে হয়েছিল এই রিলেশনশিপটা রুমি মেনে নেবে না ।
নীলার ভাবনাই ঠিক ছিল । রুমি কিছুদিনের মধ্যেই কিভাবে যেন জানতে পেরে গেল । জানার পরেই সরাসরি নীলাকে চার্জ করলো ।
‘কী ব্যপার তোর ? এসব কী শুনছি ?’
‘যা শুনেছিস সঠিক ।’
‘তোর লজ্জা করে না । তুই এসব করে বেড়াচ্ছিস !’
‘লজ্জার কী আছে ? এটা তো জীবনের স্বাভাবিক ব্যাপার । তুইও প্রেম কর না । কেউ তো বারণ করেনি তোকে ।’
‘তোর মাথার ঠিক আছে ? যা বলছিস ভেবে বলছিস তো নীলা ?’
‘ভেবেই বলছি । একটা বয়সের পর একটা ছেলে একটা মেয়ে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হবে ভালবাসবে এটাই তো স্বাভাবিক ।’
‘তাহলে তুই আজ এতগুলো দিন পর আমার ভালবাসাকে অস্বীকার করলি !’ হতাশায় ঠিকমতো গলায় আওয়াজ ফোটে না রুমির ।
‘কী পাগলের মতো বলছিস তুই রুমি ? তোকে আমি সারাজীবন ভালবাসব । কিন্তু রুবাই আমার প্রাণ । রুবাইয়ের কলেজে ক্যাম্পাসিং হয়ে গেছে । ও জব পেয়েও গেছে । আমি বলেছি মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর বিয়ে করব ।’
‘ও ! তাহলে তো সব পাকাপাকি বন্দোবস্ত করেই ফেলেছিস । আর আমি তোকে আঁকড়ে সারাজীবন থাকার স্বপ্ন দেখে চলেছিলাম ।’ চোখে জল চলে আসে রুমির ।
‘কী বলছিস রুমি ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।’
‘তোর বোঝার কথাও না । আমিই বুঝতে ভুল করে ফেললাম রে । ভাল থাকিস । খুব সুখে থাকিস ।’
বলেই রুমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে প্রায় দৌড় দেয় ।
নীলা পিছন পিছন দৌড়ায় রুমির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে । কিন্তু আজ রুমি সাড়া না দিয়ে ছুটে বাসে উঠে পড়ে । পুরো ঘটনায় নীলা হতভম্ব হয়ে যায় ।
বাড়ী ফিরে রুমি সোজা নিজের ঘরে ঢুকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় । সপাটে বিছানায় নিজের শরীরটাকে আছড়ে ফেলে । বালিশ আঁকড়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে ।
‘হে ঈশ্বর, চেহারাটা যদি মেয়ের দিলে তাহলে অনুভূতি, চাওয়াগুলো মেয়ের মতো দিলে না কেন ? নাহলে সেই চেহারাটা দিতে পারতে । যাতে আমি নীলার প্রাণ রুবাই হয়ে থাকতে পারতাম ।’
এরপর বলুন, রুমি কী আর বেঁচে থাকতে পারে ? না সে পারেনি । ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে পড়েছিল সে ।
আপনারা হয়ত বলবেন এত ডিটেইলসে আমি কি করে জানলাম ? জেনেছি । জেনেছি । আমি জানব না তো কে জানবে ? এবার আপনারা পালান । ওই দেখুন এসে গেছে ওরা । এই কনকনে ঠান্ডা থেকে গনগনে আগুনে ফেলার মাঝের প্রক্রিয়া শেষ করবে বলে । বুঝলেন না তো ? এবার আমার মানে রুমির বডিটা কাটাছেঁড়া করে দেখবে কেসটা সুইসাইড না হোমিসাইড ? 
 
   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন