শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

মানসী গাঙ্গুলী


ক্যাপশন

    রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বেবী। বিএ পাশ করেছে ম্যাথস অনার্স নিয়ে,এমএসসি পড়ার ইচ্ছে কিন্তু বাবা দূরে কোথাও পড়তে যেতে দেবেন না,হোস্টেলেও থাকতে দেবেন না। বেবী পড়াশুনা এখনই থামাতে চায় না,সে পড়াশুনা করতে ভালবাসে,তাই সায়েন্স স্টুডেন্ট  হয়েও কাছাকাছি ল'কলেজে ভর্তি হল। অ্যাডমিশন টেস্টে বসেছিল ৭৫০এরও বেশি ছেলেমেয়ে,সিলেকশনে বেবী চান্স পেয়ে খুব খুশি নাহলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত ওর। ৮০টা স্টুডেন্ট, তার মধ্যে ৭৫জন ছেলে ও ৫জন মেয়ে। বেশির ভাগই বয়সে অনেক বড়,চাকরির উন্নতির জন্য একটা বাড়তি  ডিগ্রি নিতে এসেছে,সদ্য পাশ করা ছেলেমেয়ে হাতেগোনা ৫-৬জন। যদিও কো-এড কলেজে পড়েছে তবু অচেনা সবার মাঝে একটু অস্বস্তি তো হতই ওর,সবে ২০পেরিয়ে ২১ চলছে,পায়ে পায়ে লজ্জা,কুণ্ঠাবোধ ওকে জড়িয়ে ধরছে বারেবারে। কারও সাথে আলাপও হয়নি তেমন ওর,অল্প কয়েকজনের সাথে একটু কথাবার্তা বলে কেবল,নিজে যেচে আলাপটা কোনোদিনই করতে পারে না ,তবে কেউ করলে মুখ ফিরিয়ে নেয় না ও। আর তাই বড় একা ও। বাড়ি থেকে রোজ টিফিন নিয়ে যায়,সবাই যখন টি-ব্রেকে নিচে ভোলাদার স্টলে গিয়ে চা খায়, ও তখন একা একা ক্লাসরুমে বসে টিফিন খায়। কারও সাথে আলাপ করবে কি,ও যখন কলেজে ঢোকে,বুঝতে পারে জোড়ায় জোড়ায় চোখ ওর দিকে দৃষ্টি দিয়ে রয়েছে। ও তাই খুব সাবধানে থাকে,শামুকের খোলের মধ্যে গুটিয়ে থাকে যেন। বিকাল ৩টে থেকে ৮টা পর্যন্ত ক্লাস,বাবাকে সেটা জানায়নি,তাহলে আর ভর্তি হতে পারত না। বিএসসি পড়ার সময়কার এক সহপাঠী বন্ধুর সঙ্গে লুকিয়ে অ্যাডমিশন নিয়েছিল ও যে ওর বাবার সইটা করে দিয়েছিল নাহলে বাবাকে নিয়ে গেলে আর হত না অ্যাডমিশন নেওয়া। ৬টা পর্যন্ত ক্লাস করেই বাড়ী চলে যেত,সন্ধ্যের পর বাইরে থাকার অনুমতি ছিল না যে। একদিন হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট ডেকে বললেন,"ভাল ক্লাসগুলো ৬-৮টা পর্যন্ত হয় আর তুমি কোনোদিন ওই ক্লাসগুলো কর না,এরকম করলে কি করে রেজাল্ট ভাল হবে?" উনি বলার পরে বেবীর উপেক্ষা করার উপায় ছিল না। প্রথম যেদিন ৮টা পর্যন্ত ক্লাস করল,বাড়ী ফিরে দেখে বাবার মুখ থমথম করছে। মাথা নিচু করে বেবী ঘরে চলে গেল যেন কতই অপরাধ করেছে ও। পরে অবশ্য তিনি সব জানলেন।
        তখন থেকে বেবী পুরো ক্লাস করেই বাড়ী ফেরে। আস্ত আস্তে জড়তা কিছুটা কেটেছে,আলাপও হয়েছে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। একদিন একজন টিচার না আসায়,সকলে ক্লাসরুমে বসে আছে,কেউ কেউ চা খেতে গেছে। সেইসময় দীপক বেবীকে অনুরোধ করল,"আগের ক্লাসে আমি অ্যাবসেন্ট ছিলাম,প্লিজ স্যারের নোটসটা একটু কপি করে দেবে?"বেবীর পড়াশোনা সংক্রান্ত যে কোনো কাজই ভাল লাগে,ও এক কথায় রাজী হয়ে যায়,"কেন নয়?নিশ্চয়ই দেবো"। বলে তখনই কপি করতে শুরু করে দেয়। এমন সময় রাজীব বাইরে থেকে ক্লাসে ঢুকে দেখে বেবী লিখছে। কি লিখছে মুখের ইশারায় জানতে চাইলে, দীপকই রাজীবকে সব বলে। রাজীব দীপককে বলে,"নোটস দেবার জন্য তোমার বেবীকে Amul chocolate দেওয়া উচিৎ"। বেবী হাসে,দীপকও হাসে। রাজীব এবার বেবীকে বলে,"Amul Chocolate এর ক্যাপশনটা জানো?" বেবী তার সহজ সরল চোখ দুটো তুলে তাকায়। বেবীর এই সরলতা রাজীবকে পাগল করে তোলে। রাজীব মিটমিট করে হাসে আর বলে,"Share it with someone you love","তুমি আমার সাথে share করবে তো?"বেবী কথার মারপ্যাঁচ অত ধরতে পারেনি,সরলভাবে বলে দেয় 'হ্যাঁ'। আবার লিখতে থাকে। এদিকে দীপক খুব হাসছে, ক্লাসের অনেকেই হাসছে। বেবী অত ভ্রূক্ষেপ করেনি,আর রাজীব ওদিকে ভেবে বসে আছে,বেবী সব বুঝেছে আর ওর ছুঁড়ে দেওয়া প্রোপোজাল অ্যাকসেপ্ট করেছে। অনেকদিন ধরেই ও বেবীর মন জয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু বেবীকে বোঝাতেই পারে না। রাজীব ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল,বেবী তাই ওকে বেশ পছন্দ করত,তার বেশী কিছু নয়। এদিকে রাজীব আর নিজেকে সামলাতে পারছে না,বেবীর ধারেকাছে বেশী থাকার চেষ্টা করে,বেশী ঘনিষ্ঠতা করার চেষ্টা করে। বেবী তাতেও ধরতে পারে না।
     একদিন টি-ব্রেকে হাত দেখার ছল করে বেবীর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ, বেবী আস্তে আস্তে হাত সরিয়ে নেয় কিন্তু তখনও মনে অন্য কিছু চিন্তা আসে না। এদিকে রাজীব তারপর থেকে রোজ বেবীকে বাসে তুলে দিতে যায়। বেবী কোনো দোকানে গেলে সঙ্গে করে নিয়ে যায় আবার দীপক যখন লঞ্চ ধরতে যায়,বেবীকে বলে,"চল দীপককে ছেড়ে আসি,আর তোমারও লঞ্চঘাটটা চেনা হয়ে যাবে।"এভাবেই চলছিল,একদিন বেবীকে বাসে ছাড়তে গিয়ে বেবীর সাথে বাসে উঠে পড়ল। বেবী মিনিবাসে বাড়ী ফিরত। তখন পাশাপাশি দুজনের সীট থাকতো। বেবীর পাশে বসে চলল ওর সাথে। বেবী ভাল করে কিছু বোঝবার আগেই বাস ছেড়ে দিল। খুব অবাক হয়েছিল ও রাজীবের এমন অদ্ভুত আচরণে,তাই বলে "তোমার মাথায় ভূত চেপেছে"। এমনিই বলেছিল। কিন্তু রাজীবের আবারও মনে হল,বেবী বুঝেশুঝেই বলেছে। রাজীব বলে,"চল,গল্প করতে করতে যাই"। বেবীর বাড়ীর আগের স্টপেজে নেমে পড়ল রাজীব যদিও কলেজের কাছাকাছি ছিল ওর বাড়ী। এই ঘটনা তারপর থেকে রোজই চলতে লাগলো।
    এইভাবে চলতে চলতে এবার বেবীও যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলো। ছুটির দিনগুলো ভাল লাগে না। ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা হয়ে গেলে অনেকদিন ছুটি,বেবী ছটফট করে,রাজীবও। সে সময় হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না,ল্যান্ড লাইনেও কথা বলার অসুবিধে,তাছাড়া বেবী নিজের মনোভাব রাজীবকে বুঝতে দিত না। মাঝে একদিন ক্লাস অ্যাসেসমেন্টের খাতা জমা দেবার ডেট ছিল,সেদিন ছিল ৮ই ফেব্রুয়ারী,অর্থাৎ প্রপোজ ডে,রাজীব আর সুযোগের অপব্যবহার করেনি। গঙ্গার ধারে বেবীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ওকে প্রপোজ করে। বলে,"তুমি যদি আমার পাশে থাকো, I'll go to the top, আর যদি না বল,তোমার সামনে আর আসবো না,কলেজ ছেড়ে চলে যাবো"। বেবীর প্রত্যাখ্যান করার কারণ ও ক্ষমতা কোনোটাই ছিল না। চলতে লাগলো বাড়ী থেকে নানারকম অজুহাতে বেরিয়ে দেখা করা। দু'জনে ভাসতে লাগলো প্রেমের জোয়ারে।

1 টি মন্তব্য: