শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

তিমিরণ দত্তগুপ্ত

সিঁড়ি

দোতলা বাড়ির ডানধারে আমলকি গাছের গা  ঘেঁসে লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি উঠে এসে ঠিক জায়গায়  শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।অথচ অদ্ভুত খেয়ালে দোতলা ছাড়িয়ে উঠে গেছে আরো খানিকটা,একদম উপরের  ন্যাড়া ছাদ পর্যন্ত।বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে এমন সিঁড়ি দেখে জয়া অবাক হয়েছিল।কয়েকটা দিন কেটে যাওয়ার পরে অপূর্বকে জিজ্ঞেস করেই বসল,তোমাদের বাড়িতে এমন অদ্ভুত সিঁড়ি কেন?
অপূর্ব খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে বলল,অদ্ভুত কেন?
‘অদ্ভুত নয়?সবার বাড়িতে দেখেছি একতলা বাড়ির ভিতর থেকে সিঁড়ি উপরে ওঠে।’
অপূর্ব হাসতে হাসতে বলল,অনেকের বাড়িতে বাইরে থেকেও সিঁড়ি থাকে।তুমি দেখোনি তাই বলছো।উত্তর কলকাতা ঘুরলেই দেখতে পেতে।
জয়া হার মানতে রাজি নয়।তর্কের সুরেই বলল,তাই বলে ছাদ পর্যন্ত।ন্যাড়া ছাদ,ওঠারও তো উপায় নেই।
অপূর্ব বিজ্ঞের মতো বলল,কখনো তিনতলা করবো না?ভবিষ্যতটাও তো ভেবে রাখতে হবে।
জয়ার  রোজ রোজ বাইরের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নামা একেবারেই পছন্দ নয়।যখনই ওঠে বা নামে তার মাথা ঘুরতে থাকে।শ্বশুর-শাশুড়ি নিচে থাকেন।রান্নার ব্যবস্থা উপরে।রোজ দু’বেলা নিচে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসা,এছাড়াও খুচখাচ অনেক কারণে নিচে নামতে হয়।অপূর্বকে  বলেও কিছু লাভ হয়না।তার ওই ঘুরে ঘুরে ধাপ গুনে গুনে দোতলায় ওঠা আর নামা  ভাল লাগে।শ্বশুর,শাশুড়ি ছেলেকে একতলায় চলে আসতে বলা সত্বেও সে গা করেনি বাবা-মায়ের কষ্টের কথা ভেবে।
জয়া সাধারণত সকাল সকাল উঠে পড়ে।আজ ছুটির দিন,একটু দেরি করেই বিছানা ছাড়ল।রাত পোষাকের ভাঁজে ভাঁজে তখনও আলস্য জড়িয়ে।অগ্রহায়ণের শেষ,শীত এসে গেল প্রায়।হাওয়া দিচ্ছে শীতের।বাতাসে আমলকির গন্ধ।গাছের মাথার পাশ থেকে সূর্য উঠে এসেছে খানিকটা।এখন আর শীতের কনকনে ভাবটা নেই।সকালে ছিল।ক’দিন ধরে সকাল সন্ধেতে গা শিরশির করে।রাত্রে শীতই করে।গাছের পাতা টুপটাপ করে খসে পড়ে এদিকে সেদিকে।জয়া বালতি করে জল এনে উপর থেকে সিঁড়ি ধুয়ে দেয় রোজই।

আগের দিন রাতে শ্বশুর মশাই খেতে বসে বলেছিলেন,বৌমা,বাবুকে কাল বাজার থেকে ট্যাংরা মাছ আনতে বোলো তো।বড়ি দিয়ে রেঁধো।
অপূর্বকে বাজারের থলে হাতে নিচে নামতে দেখে জয়ার মনে পড়ল।ঘর থেকেই চেঁচিয়েই বলল,বড় দেখে একটু ট্যাংরা মাছ নিয়ে এসো।আর ডালের বড়ি।বাবা খেতে চেয়েছেন।
একটু পরেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে অপূর্বকে উপরে আসতে দেখে জয়া অবাক হয়ে গেল।বলল,কি হল।ফিরে এলে যে?
যন্ত্রণাকাতর মুখে যতটা সম্ভব হাসি ফুটিয়ে অপরাধীর মতো মুখ করে অপূর্ব বলল,পড়ে গিয়েছি সিঁড়িতে।
জয়া দেখল সাদা পায়জামার হাঁটুর কাছে রক্তের দাগ ফুটে উঠেছে।
 ফুটে উঠেডেটল লাগিয়ে পোষাক পাল্টে দ্বিতীয় দফায় অপূর্ব যখন বাজার গেল,জয়া দেখল সেই দুরদার করে সিঁড়ি ভাঙা নয়।বরঞ্চ সন্তর্পনে রেলিং ধরে ধরে এক পা এক পা করে নিচে নামা।আগের সেই আত্মবিশ্বাস যেন টাল খেয়েছে আচমকা।

সন্ধেবেলা অপূর্বর হাঁটুতে মলম লাগাতে লাগাতে জয়া জিজ্ঞেস করল,সিঁড়িতে ওঠা নামার সময় তুমি বিড়বিড় করো কেন বলো তো?
অপূর্ব মুখ তুলে অবাক হয়ে তাকাল,আমি?
জয়া বলল,আমি স্পষ্ট শুনেছি।
অপূর্ব কিছুতেই বলবে না।জয়াও ছাড়বার পাত্রী নয়।শেষমেষ অপূর্ব বলেই ফেলল,সিঁড়ির ধাপ গুনি।সেই কবে থেকে গুনছি।
জয়াকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপূর্ব বলল,এ আমার বহুদিনের অভ্যেস।তোমার বাপের বাড়িতে চব্বিশটা ধাপ।অফিসে মোট চল্লিশটা ধাপ পেরোলে তবে আমাদের সেকশন।এই যেমন ধরো গঙ্গার ঘাট।তুমি উপর থেকে নামলে………।
অপূর্বকে শেষ করতে না দিয়ে জয়া বলল,কী হয় এইসব গুনে?
অপূর্ব বলল,তেমন কিছুই নয়।আত্মবিশ্বাস বাড়ে।আমি চোখ বন্ধ করেও ওঠানামা করতে পারি।অন্ধ মানুষদের দেখো না?
জয়া উঠে যাচ্ছিল।অপূর্ব হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল,ওদের সবার নাম আছে জানো?
জয়া হাসি চেপে বলল,তুমি রেখেছো?
অপূর্বও হেসে ফেলল,হ্যাঁ তো।এই যেমন নিচের ধাপের নাম ইতি।আর একদম উপরের ধাপ,ওর নাম ছুটি।অন্যদেরও নাম আছে।আজ যখন পড়ে গেলাম,অলিককে বললাম,দেখেছিস সকাল সকাল তোদের বৌদি কেমন জল ঢেলে রেখেছে।
জয়া মুখ চেপে হাসতে হাসতে বলল,তুমি বদ্ধ পাগল।
অপূর্বও হেসে ফেলে বলল,হ্যাঁ পাগলই তো।কোন মানুষ পাগল নয় বলো।
জয়া আচমকাই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে বলল,দেখো,এই সিঁড়িই আমার সর্বনাশের কারণ হবে।

মাসখানেক বাদে জয়ার জেদাজেদির ফলেই হোক বা অন্য কোন কারণে অপূর্ব ঠিকই করে ফেলল কন্ট্রাক্টর ডেকে ভিতর থেকে সিঁড়ি তুলতে হবে।তবে তার জন্য কতটা কী ভাঙতে হবে আগে দেখা দরকার।এছাড়া বিস্তর টাকারও প্রয়োজন।অপূর্ব চিন্তিত মুখে বলল,প্রভিডেন্ট ফান্ডে হাত পড়বে।
জয়া বলল,পড়ুক গে।

সেই রাত্রে জয়া স্বপ্ন দেখল,লোহার সিঁড়িটা বটগাছের মতো শাখা প্রশাখা বিস্তার করে দোতলার ন্যাড়া ছাদ ছাড়িয়ে আরও অনেকটা উপরে উঠে যাচ্ছে।আর এদিক সেদিক থেকে বটের ঝুড়ির মতো শিকড় বেড়িয়ে সারা বাড়িটা কিরকম আঁকড়ে ধরে আছে।উপর থেকে অপূর্ব ডেকেই চলেছে,জয়া আমার নীল শার্টটা কোথায় রেখেছো?
জয়া আপ্রাণ চেষ্টা করছে উপরে ওঠার।যতই উঠতে চাইছে,ততই কেউ যেন তার পা আঁকড়ে ধরে আছে।
বাড়ির কাছেই পায়ে হাঁটা পথে গঙ্গার ঘাট।অনেকদিন সংস্কার হয়নি।সাবেক বাঁধন আলগা হয়ে গেছে।পইঠের কিছু কিছু হেলে গেছে।এইবার যে কোনও দিন জোয়ারের গাঙে গা ভাসিয়ে দেবে। পথের মাঝে মা কালীর  মন্দির।ছুটির দিন ছাড়া অপূর্ব  রোজ ভোরবেলায় জয়াকে নিয়ে গঙ্গায় স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিয়ে বাড়ি ফেরে।
সেদিন জয়ার  জ্বর।ঘাটের একবারে উঁচু ধাপে বসে দেখলো গঙ্গায় জোয়ার এসেছে।কোমর পর্যন্ত জলে অপূর্ব যতটা সম্ভব সাবধানে ডান পা নিচের দিকে বাড়াল।পা ক্রমশ নিচের দিকে নামছে তো নামছেই। বা পা ঘাটের পইঠেতে,ডান পা নেমে চলেছে অতলে।বিব্রত মুখে যেন কিছু খুঁজে চলেছে।শেষ পর্যন্ত দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে উঠেই এলো।জয়া বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,কী হলো,স্নান করলে না?
অপূর্ব অদ্ভুত গলায় বললো,পনেরোটা ধাপ শেষ করে মাটি পাওয়ার কথা।অথচ,আজ তেরো পর্যন্ত গুনলাম…….।বাকিদুটো কী জলের তোড়ে ভেসে গেছে?
জয়া বলল,এত ভারী বাঁধানো জিনিস জলের তোড়ে ভেসে যাবে?হয় কখনো?তোমারই ভুল হয়েছে।
অপূর্বর তখনও যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা।কেমন ঘোর লাগা গলায় বলল,সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি।প্রত্যেকটা ধাপ আমার চেনা।ভুল হওয়ার তো কথা ন   
ফেরার পথে মন্দিরে গেলো না।জয়ার সাথে কথাও হলো না।বাড়ি ফিরে জয়া শাশুড়ির সথে দেখা করতে নিচের তলায় ঢুকেছে।হঠাৎ বিকট শব্দে বেরিয়ে এসে দেখলো সিঁড়ি থেকে অপূর্ব পড়ে গেছে।যে মানুষটা  গুনে গুনে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতো,সে কী করে পড়ে গেলো,বুঝেই পেলোনা জয়া।

ছয় মাস হাসপাতালে কাটিয়ে যমে মানুষে লড়াই করে অপূর্ব যখন বাড়ি ফিরল,তখনও তার শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষতের দাগ স্পষ্ট।স্বামীর চলাফেরা,চোখের চাউনি দেখে জয়া বুঝল বিপর্যয় শুধু শরীরে নয়,শরীর ছাড়িয়ে মনেও শিকড় গেড়েছে।
মাঝে একদিন শ্বশুর মশাই কষ্ট করে উপরে উঠে এসে বললেন,বৌমা তোমরা বরং নিচে চলে যাও।বাবুর সুবিধে,তোমারও ভাল লাগবে।আমি আর তোমার মা তো ঘর থেকে বিশেষ বেরোই না।
জয়া ঠান্ডা মাথায় বলে দিল,না বাবা,আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না।আপনার ছেলে গেলে যাক।
অপূর্ব কাঠ হয়ে শুনছিল দু’জনের কথা।জয়ার মুখে আপত্তির কথা শুনে যেন স্বস্তি পেল।ঘরের অন্য দু’জনের কারুরই চোখ এড়াল না।

এই বাড়ির ঘরে,দেওয়ালে,বারান্দায়—সবটাই জুড়ে ঘন,মিশকালো একটা অসুখ ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দিন রাতের যন্ত্রণাকর অনুভুতি সকলের মনের সব বৃত্তিগুলোকে কীরকম স্থূল আর নিস্প্রভ করে দিয়েছে।জয়া সারাদিনের বেশিরভাগ সময়  পাশের ঘরে একলা থাকে,যন্ত্রের মতো কাজ করে।দু’বেলা শ্বশুর-শাশুড়িকে খাবার দিয়ে আসা ছাড়া পারতপক্ষে নিচেও নামে না।ওই সিঁড়ি তার দু-চক্ষের বিষ।অপূর্ব সারাদিন ঘরে শুয়ে,বসে থাকে।বিছানায় যেন একটা কঙ্কাল।এক একদিন হঠাৎ এই দৃশ্য চোখে পড়ে যায় জয়ার।চোখে চোখ পড়লে অপূর্ব কিছু বলার চেষ্টা করে।জয়া বুঝতে পারে না,বোঝার চেষ্টাও করে না।বেরিয়ে চলে আসে বাইরে।রাতে বিছানায় পাশাপাশি দু’জনে কাঠ হয়ে শুয়ে থাকে।জানলা দিয়ে বাইরে থেকে চাঁদের আলো এসে বিছানার চাদরে আঁকিবুঁকি কাটে।তবুও অপূর্ব মৃত মানুষের মত বোধহীন হয়ে শুয়ে থাকে।জয়া বুঝতে পারে  অপূর্বর সমস্ত ইচ্ছে লোপ পেয়েছে।

মাস দুয়েকের মাথায় অপূর্ব অনেকটাই সুস্থ।ঘরের ভিতর হেঁটে চলে বেরায়।কখনও সখনও এক পা  টেনে নিচে নামে,বাবা-মায়ের সাথে গল্প করে।রাতে বাইরে চেয়ার টেনে অন্ধকারে বসে কস্তুরী আভার মতো চাঁদ ওঠা দেখে।যৌনার্ত কোন পশুর ডাক শোনে অন্ধকারে।ভিতরের ঘরে জয়া পুড়ে ছাই হয়।সেই তোলপাড়  বাইরে বসেও টের পাওয়া যায়।

ভোররাতে জয়ার ঘুম ভেঙে গেল টানা বৃষ্টির মতো কান্নার শব্দে।একটা হাত বিছানার পাশে রেখে বুঝল অপূর্ব  নেই।
নিচের তলা,আশপাশ খুঁজেও যখন পাওয়া গেল না,তখন আলো ফুটেছে।মন্দিরের কাছে এসে দাঁড়াতে পূজারী বললেন,কারে খোঁজো বৌমা? সে তো অনেকক্ষণ আগেই ঘাটের দিকে গেছে।
বুকটা ধক করে উঠলো জয়ার।প্রায় দৌঁড়তে দৌঁড়তে ঘাটের কাছে গিয়ে দেখল একদম নিচের একটা ধাপে ভিজে শরীরে অপূর্ব বসে।উপর থেকে নাম ধরে ডাকতেই ঘাড় ঘুরিয়ে  শিশুর মতো হেসে বলল,আমারই ভুল হয়েছিল জয়া।তেরোটা নয়,পনেরোটাই ধাপ।ভাগ্গিশ পনেরোটা, না’হলে হয়তো আমাকে আর খুঁজেই  পেতেনা।
ভোরবেলার একঝলক ভেজা হাওয়া এসে জয়ার শরীর ছুঁয়ে দিল।এখন আশপাশ কি মনোরম লাগছে।এক্কা দোক্কা খেলার মতন পা ফেলার ভঙ্গিতে জয়া ধাপ ভাঙতে ভাঙতে ছুটে গিয়ে ভেজা ঘাটেই অপূর্ব পাশে বসে পড়ল।
গঙ্গার জলে কাঠ,কুটো,ফুল,পাতা ভেসে চলেছে সামনের দিকে।সময়ের ভাটিতে ভেসে চলা কালের স্রোতের মতো।একটু আগেও জয়া অসীম শূন্যতায় কাটা ঘুড়ির মতো একা,ভাসমান ছিলো।এখন গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে।অনেকদিন পরে ভারহীন হয়ে।
অনেকক্ষণ ওইভাবে বসে থাকার পরে জয়া অপূর্বর হাত ধরে টেনে তুলল,বুকে ঠান্ডা বসে যাবে।চলো এবার বাড়ি ফিরি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন