মলয়ের ঠাকুরদা লক্ষ্মীনারায়ণ আর ঠাকুরমা অপূর্বময়ী
বাবা, মা ও দাদার সঙ্গে মলয়
ছোটোলোকের জীবন ( ধারাবাহিক )
আমি আজও আমার প্রথম বইটা লেখার চেষ্টায় বাংলা ভাষাকে আক্রমণ করে চলেছি ।
ইমলিতলায় ছিলুম বামুনবাড়ির মহাদলিত কিশোর ।দেখি খুল্লমখুল্লা লেখার চেষ্টা করে কতোটা কি তুলে আনতে পারি উপন্যাস লিখতে বসে ঘটনা খুঁড়ে তোলার ব্যাগড়া হয় না জীবনকেচ্ছা লিখতে বসে কেচ্ছা-সদিচ্ছা-অনিচ্ছা মিশ খেয়ে যেতে পারে তার কারণ আমি তো আর বুদ্ধিজীবি নই জানি যে মানুষ ঈশ্বর গণতন্ত্র আর বিজ্ঞান হেরে ভুত ।
ক্লাস টেন-এ পড়ার সময়ে ক্লাসটিচার অধিকারী স্যারের সঙ্গে ; সিঁড়ির দ্বিতীয় সারিতে বাঁদিক থেকে দ্বিতীয় মলয়
ঘোঁচু ছিলুম স্বমেহন বলুন ম্যাস্টারবেশান বলুন আমাকে শুরু করতে হয়েছিল কলেজে ঢুকে আসলে জানতুমই না একদিন পাটনার গান্ধি ময়দানে বসে রুমালে চিনেবাদাম রেখে আমি সুবর্ণ তরুণ আর বারীন খাচ্ছিলুম সুবর্ণ তরুণকে বলল এই তুই বড়োগুলো খেয়ে নিচ্ছিস জবাবে তরুণ বলল কি করব বল চিন্তায় আছি আজকাল দিনে তিন বার হাত মেরে ফেলছি আমি জানতে চাইলে হাত মারা আবার কি ব্যাপার সুবর্ণ বললে শালা হাত মারা জানিস না নুনুর খোসার তলায় যে নোংরা থাকে তা পরিষ্কার করিস না বারীন বলল বাঞ্চোৎ মেয়ে ফাঁসিয়ে বেড়াচ্ছিস হাত না মারলে খোসার তলার নোংরা যদি কোনো মেয়ের লাবিয়া মাইনরায় ঢুকে যায় তার লাইফ হেল হয়ে যাবে বললুম আরে শালা চুতিয়া কাহিঁকা হাত মারা কী জিনিস সেটাই বলবি তো তাহলে খোসার তলাকার নোংরা পরিষ্কার করব সুবর্ণ বলল নুনুতে সাবান লাগিয়ে ডান হাতটা এইভাবে নিবি আর নুনুকে সাবান মাখাতে থাকবি ব্যাস ফণফণিয়ে বেরিয়ে পড়বে তোর লিকুইড ডায়মণ্ড কি লজ্জা কি লজ্জা নাইটফল নিয়েই ছিলুম মজায় নিজেই পায়জামা পরের দিন সকালে কেচে ফেলতে হতো নয়তো ধোপাটা “ই কাহেকা দাগ লগলই” বলে টিটকিরি মারবে তাই কলেজে ঢুকে চেককাটা গাঢ় রঙের লুঙ্গি পরা শুরু করেছি যাক শুরু হয়ে গেল আমার ম্যাস্টারবেশানের কালখণ্ড সমস্যা হল যে বুড়ো বয়সে প্রস্টেটের জন্যে ইউরোলজিস্টকে দেখাতে গেলে ডাক্তার জিগ্যেস করলে আর ম্যাস্টারবেশান করেন না বললুম না কেন দরকার হয় না বউ আছে তো বউয়ের মেনোপজ হয়ে গেছে ডাক্তার বললে আপনাদের লোকে ভুল বুঝিয়েছে ম্যাস্টারবেশান পঞ্চাশ বছরের পর আবার শুরু করতে হয় যাতে প্রস্টেট গ্ল্যাণ্ড মরে না যায় আপনি ভাবলেন বউয়ের সঙ্গে শুলেই কাজ হয়ে গেল তা ঠিক নয় শোয়াটা মনের ব্যাপার দেহের ব্যাপার হল ম্যাস্টারবেশান যাকগে আপনি তো যে বয়সে পৌঁছেচেন আর ম্যাস্টারবেশান করে লাভ হবে না কেননা প্রস্টেট গ্ল্যাণ্ড অলরেডি মরে গিয়ে ফুলতে আরম্ভ করেছে শুধু ওষুধ খেয়ে ওর ফোলা থামিয়ে রাখতে হবে বছরে একবার সোনাগ্রাফি আর পেচ্ছাপের রিপোর্ট আনবেন তাহলেই হবে মনে রাখবেন ম্যাস্টারবেশনে প্রমোদকর লাগে না।
সেক্স ? চিরকাল দিনের আলোয় চোখ খুলে রেখে আমার ভালো লাগে রাতের অন্ধকারে নয় রাতে হলে জোরালো আলো চাই । হাড়কাটা হোক, সোনাগাছি হোক, কালীঘাট হোক, খিদিরপুর হোক, পার্কস্ট্রিটের সন্ধ্যা হোক, ফ্রিস্কুল স্ট্রিট হোক, সব দিনে কিংবা আলোয় । খাটে নয়, চোটে ।
যখন প্রথম পর্ণোগ্রাফিক ফিল্ম দেখলুম তখন ভাবলুম যে কেন এদের ম্যাজিক রিয়্যালিস্ট ফিকশান বলা হয় না ।
বাঙালি সাহিত্যিকদের চাঁদমারি ভাগ্য যে তাঁদের ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় না বাংলা পাল্প ফিকশন হল ঘোলা জলের আয়নায় মুখদর্শন ।
সাহিত্যজগত থেকে ছিঁড়ে নিজেকে আলাদা না করলে লেখালিখি করা যায় না আমাকে বোঝার চেষ্টা করা হেঁয়ালি তাই আমার লেখালিখিকে বুঝুন ।
আমি সাহিত্যিক লাউডগাগিরিতে ভুগি না বুঝলেন তো আমার লেখালিখি নিছক সাহিত্য নয় গণপাঠককে আনন্দ দেবার জন্যে নয় তা পাঠককে চৌচির করে তার ভেতরে সমাজরাষ্ট্রের গুগোবর ভরে দেবার জন্যে আর আমি শিল্প ব্যাপারটার বিরুদ্ধে কেননা আমাকে সারিয়ে প্রাচীন গ্রিক হেলেনিক সমাজের যোগ্য করে তোলা যাবে না আমি চাই না যে আমার শবযাত্রায় কবি-লেখকরা ভিড় করুক একজনকেও চাই না সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হলো যখনই মরি না কেন যুবাবস্হায় মারা যাবো মাঝে পনেরো বছর মরে গিয়ে যাচাই করে নিয়েছিলুম আমি লেখালিখি বেছে নিইনি লেখালিখি আমাকে বেছে নিয়েছে লেখকদের একেবারে তলায় নেমে গিয়ে ধাঙড় হতে হয় জানি পরের জন্মে ঘুর্ণিঝড় হয়ে জন্মাবো ।
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর কপি কৈলাস পর্বতে তুলে রেখে এসেছি দেখলুম আগেই কেউ মনুস্মৃতি রেখে গেছে ।
প্রথম আদিম মানুষ যেমন পাথরের ছোরা আবিষ্কার করেছিল তেমনই আমি নিজের লেখালিখির অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছি কিন্তু সার্কাসে যে লোকটা সিংহদের আগুনের ভেতর দিয়ে লাফাতে বাধ্য করত তাকে আমি ছোটোবেলায় মাফ করতে পারিনি আমার সবক’টা দুঃস্বপ্ন চোখ খুলে কেননা ঘুমে সবচেয়ে রসালো স্বপ্নগুলো দেখি ভোরের পুকুরে মৌরলা-ঝাঁকের মতন সুন্দুরীদের দল আমার উচ্চাকাঙ্খা ছিল একটা বিশাল বেশ্যালয় কিনি আর চোরাকারবারের মালিক হয়ে লুকিয়ে বেড়াই কিন্তু যখন ভারতীয় বাস্তবে পচতে থাকি তখন মগজে লেখা আসেনা মনে হয় সেসময়ে কেউ একজন আমাকে একটা শ্মশান বা গোরস্তান উপহার দিক হোমো স্যাপিয়েন মানুষের প্রথম যে করোটি পাওয়া গিয়েছিল তা যে আমার লেখালিখিই তার প্রমাণ।
দেশটা দিনকেদিন চুতিয়ায় ভরে উঠেছে গুয়ের সমুদ্রে ডানে পড়ি বা বাঁয়ে । একজন কমিউনিস্ট নেতাকে জিগ্যেস করেছিলুম, দেশভাগের সময়ে তো ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ধর্ম বাঁচাবার জন্য, তা এখানে এসে নাস্তিক হয়ে গেলেন যে ? ঢাকাতেই নাস্তিক থাকতে পারতেন, এই ধর্ম হোক বা সেই ধর্ম, নাস্তিকের আবার ধর্ম হারাবার ভয় আছে নাকি । শুনে, তাঁর চটি হয়ে উঠলো স্পোর্টস শু ।
আমার দু’রকম চোখ নিয়ে রাস্তায়-রাস্তায় হাঁটতে আমার ভালো লাগে আমি তখন তাকিয়ে থাকি কিন্তু দেখি না অন্য সময়ে তাকাই আর দেখি পৃথিবীর কতো-কতো শহর গ্রাম গঞ্জের পথে-পথে এই ভাবেই চকরলস কেটেছি ।
আমাকে নিয়ে ঠাকুমা অপূর্বময়ীর অতিকথায় বলা আছে যে আমি দু’বছর বয়সে ‘কুজঝটিকা’ স্পষ্ট উচ্চারণ করেছিলুম কিন্তু কনভেন্ট ইশকুলে ভর্তি হবার পর আর পারতুম না বলে রামমোহন রায় সেমিনারিতে ভর্তি হলে বাংলার মাস্টারমশায় এক্ষুনি নাম মনে পড়ছে না ও হ্যাঁ কর্মকারবাবু তবে ওই ইশকুলে টিচারদের পদবি বা নামে বাবু যোগ করতে হতো ব্রাহ্মধর্মের ফিকে-রেশ হিসেবে বলেছিলেন “শব্দটা অরুন্ধুতী নয় রে অরুন্ধতী তুই কি ঘটি ” সহপাঠী তরুণ শূরকে জিগ্যেস করি ঘটি কী রে গাণ্ডু ঘটি জানিস না পাটনাইয়া বওড়াহা ভঁয়সালোটন কোথাকার বাঙালের বিপরীত সমাস বাঙাল-ঘটি দ্বন্দ্বসমাস নীলাংশুবাবুর ক্লাসে জানতে পারবি উনি চাটগাঁর সত্যিই জীবনকে মরচে-পড়া থেকে বাঁচাতে হলে জিভে পালিশ দিয়ে রাখতে হবে ভালোবাসা এক রকমের কল্পনার অসুখ আর আমার ঠাকুমার নাম জানেন তো “অপূর্বময়ী” তাঁর শাশুড়ির নাম “মাতঙ্গিনী”। ঠাকুমার ছোটো বেয়ানের নাম বিবসনা । এমন অসাধারণ নামগুলোকে লোপাট করে দিয়েছে কসমোপলিটান আধুনিকতা ।
তিন বছর বয়সে মহাদলিতদের পাড়া ইমলিতলার গলিতে লেত্তি দিয়ে লাট্টু ঘোরাতে শিখে যাই হাতের তালুতে কেয়া চকরলস কাটিস হ্যায় বাঙালিয়া গিল্লি-ডাণ্ডা বা ড্যাংগুলি খেলার চেষ্টা করতে গিয়ে কপালে আলু নিয়ে ফিরি তিন বছর বয়সেই কনভেন্টে ভর্তি হবার জন্য নটিবয় শু কিনতে গিয়ে জানতে পারি যে আমার বাঁ পায়ের চেয়ে ডান পা বড়ো পায়ের কড়ে আঙুলের পাশের আঙুল ছোটো জানতে পারি যে আঁস্তাকুড়ের দিকে একবার তাকালেই যেমন টের পাওয়া যায় তা বাতিল জঞ্জালের জমঘট তেমনিই অনেক লোকের দিকে এক পলক তাকিয়েই বুঝতে পারি যে তার জীবনের গর্তে আছে শুধুই টাকাকড়ি শুধুই শুধুই ইমলিতলায় বসবাস না করলে ইমলিতলাকে জানতে পারা অসম্ভব ইমলিতলার নানা রঙের নানা কাপড়ের নানা পোশাকের তাপ্পি মারা ক্যাঁদরায় আমি মোড়া সমস্যা হল যে আমি আবার খোলের ভেতরে ঢুকে যেতে পারি না আর তো গুটিপোকা নই বদলে গেছি তবু আজও সুন্দরীদের দিকে তাকালে মন দুঃখে ভরে ওঠে ।
স্ত্রী সলিলার সঙ্গে মলয় । বিয়ের পরের দিন, ১৯৬৮ সালে
বাংলা অ্যাকাডেমিতে মলয় । দাদা, বউদি, স্ত্রী, নাসের হোসেন প্রমুখের সঙ্গে
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন