শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

তপন কুমার বসু


গল্প :

দলিল
   আমি ছোটবেলা থেকেই বাবাকে একদম পছন্দ করতুম না। আমার সবসময়ই মনে হয় বাবা খুব নীচু মনের মানুষ। ঠাকুর্দা ঠাকুমার যত্ন আত্তির কোন ত্রুটি ছিল না। মাকেও খুব ভালবাসত। কিন্তু আমার বাবার কিছু দোষ ছিল। জমি বাড়ির  ওপর বাবার একটা ভয়ানক লোভ বা আকর্ষণ ছিল।
   সেবার পিসির বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আমি তখন ছোট। ঠাকুর্দা ঠাকুমা পিসিকে একজোড়া হালকা কানের দুল ছাড়া কিছুই দিতে পারেননি। বাবাকে দেখে মনে হয়  পিসিকে যেন কত ভালবাসে। কিন্তু আসলে তা নয়। কারণ ঠাকুর্দা যখন  বাবার কাছে রাখা গ্ৰামের এক টুকরো জমিসহ বাড়ির দলিলটা চাইল (যেটা আমার দাদু যৌতুক হিসেবে বাবার বিয়েতে বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন) তখন বাবা কিছুতেই দিতে রাজী হল না। ঠাকুর্দা ভেবেছিলেন ওটা বন্ধক দিয়ে পিসির জন্য আরও দু-একটা গয়না গড়িয়ে দেবেন। কিন্তু বাবার এক কথা- ওই দলিল আমি দিতে পারব না আমার খুব দৃষ্টিকটু ও খারাপ লাগত বাবার এই ধরণের আচরণ। বাবাকে খুব ছোট ও নীচু মনের মানুষ মনে হত। এরপর অবস্থা আরও খারাপ হল যখন মা একটা কঠিন অসুখে পড়ল। পেটে একটা বড় টিউমার ধরা পড়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা। এবার ঠাকুর্দা বাবাকে বললেন- গ্ৰামের ওই বাড়িটা বিক্রি করে দে বৌমার চিকিৎসার জন্যে। না হলে বৌমাকে বাঁচানো যাবে না। বাবার এক জেদ। ওটা বিক্রি করব না। এদিকে দিনরাত এক করে বাবা মায়ের সেবা করতে লাগলো। অফিস থেকে ও আরো দু-এক জায়গা থেকে লোন করে যথাসাধ্য মায়ের চিকিৎসা হতে থাকল। কিন্তু অপারেশন ছাড়া তো মাকে বাঁচানো যাবে না। শুধু সেবায় কি প্রাণ বাঁচে। কিছুদিনের মধ্যে মা আর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমি ঠিক করলাম, যে করেই হোক পড়াশোনা করে আমাকে দাঁড়াতে হবে। একটা ভাল চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ইতিমধ্যে ঠাকুর্দা ঠাকুমা গত হয়েছেন। বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। টাকা পয়সা খুব একটা কিছু পায়নি। ধার দেনা শোধ করে হাতে খুব একটা কিছু ছিল না। বাবা টিউশনি শুরু করল। কোনরকমে সংসার চলত। লেখাপড়া শেষ করে আমি একটা মোটামুটি চাকরি জোগাড় করলাম। এসে জানালাম, এও বললাম তার সাথে আর এক ছাদের তলায় থাকার ইচ্ছে নেই। বাবাকে যে আমি ঘৃণা করি সেটা বাবা ভালই বুঝতে পারতো। সেদিন প্রথম মাসের মাইনে পেলাম। বাবাকে জানালাম যে  একটা ঘর দেখে এসেছি। আমি এবার থেকে সেখানেই থাকব। বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বলল, তুই কেন এ বাড়ি ছেড়ে যাবি। আমিই বরং কা সকালে চলে যাব। বাবা এই কথা বলে ঘরে চলে গেল। রাতে আমরা একসাথে খাওয়া দাওয়া করলাম। কেউই কোন কথা বললাম না। বাবা খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আমিও মনে মনে একটু হালকা হলাম। কাল থেকে আর বাবার সঙ্গে থাকতে হবে না। ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম।
     পরদিন ঘুম ভাঙ্গাতে একটু দেরি হয়ে গেল। নতুন চাকরি, তাড়াতাড়ি দু কাপ চা করে এক কাপ বাবাকে দিতে গিয়ে দরজা ঠেলে দেখি সিলিং ফ্যানের আশংকায় কাপড় বেঁধে বাবা ঝুলছে। চীৎকার করে লোক ডাকতে গিয়ে দেখি বিছানার উপর একটা চিঠির ও সেই দলিল। চিঠিটা আলতো করে তুলে নিলাম যাতে লেখা--
"কুর্চি,
  আমি জানি তুই আমাকে পছন্দ করিস না,কেন করিস না তাও জানি।আমি লোভী, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর। তার কারণ আমার  শ্বশুরমশায়ের মানে তোর দাদুর দেওয়া গ্ৰামের বাড়ির দলিল। চরম বিপদের দিনেও এটা আমি যখের ধনের মত আগলে রেখেছি। কারো হাতে তুলে দিই নি। সব সম্পর্কগুলো আমার নষ্ট হয়ে গেছে এক এক করে এটার কারণে। অবশেষে তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলি। তাই তোকে সত্যটা জানিয়ে দেওয়া শ্রেয় মনে করলাম। আমার এই দলিলটা নকল। তোর ঠাকুর্দার কথা অনুযায়ী যৌতুক দেবার ক্ষমতা আমার শ্বশুরমশায়ের, মানে তোর দাদুর ছিল না। তাই তাই ঐ বাড়ির একটা নকল দলিল আমার হাতে তুলে দিয়ে কন্যাদায়গ্ৰস্ত পিতা অসহায়ের মত আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন যেন আমি ওনার মান বা লজ্জা রাখি। আমি সেদিনের সেই অসহায় মুখ দেখে আমৃত্যু শ্বশুরমশায়ের লজ্জা ঢেকে রেখেছি। হয়ত আজও রাখতাম। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর তোর নতুন সংসারে তুই যাতে এগুলো নিয়ে কোন বিপদে না পড়িস তাই সবকথা জানালাম। ভাল থাকিস। --বাবা।"
   জীবনে সেইদিন প্রথম বাবার জন্য হাউ হাউ করে কাঁদলাম।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন