রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার

                             



ন হন্যতে       



কি মিষ্টি একটা পাখির ডাক বহুদূর থেকে ভেসে আসছে আর চেতন অবচেতনের মধ্যবর্তী একটা জায়গায় এসে তিরতিরিয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে সুষুপ্তির মগ্নতায় থাকা আয়ত নয়নের ঘন সুদীর্ঘ পশমী ঘেরা টোপকে।  বনানী চোখ বন্ধ করেই অভ্যস্ত  হাত বাড়ায় মাথার পিছনে মোবাইলের অ্যালার্ম  বন্ধ করতে। সাড়ে পাঁচটার এই অনিবার্যতাকে বড় নির্মম মনে হয় প্রতিদিন। কোন অতলান্তিক গভীরতা থেকে যেন ভেসে ওঠে এই ভোরবেলায়। অন্যান্য দিনের মত আজও শেষ রাতের আদুরে ঘুমটুকুকে বালিশে অসমাপ্ত রেখেই নেমে আসে বিছানা থেকে। মাটিতে পা দিতেই পলকে উধাও ঘুমের রেশ। হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় তড়িৎ গতিতে বনানী এগিয়ে যায় স্টাডি রুমের দিকে।


দ্রুত বইপত্র আর জমে থাকা খবরের কাগজের স্তূপ সরিয়ে বনানী খুঁজে চলেছে কাঙ্খিত বস্তুটি। সাধারনতঃ জিনিসপত্র গুছিয়েই রাখে সে। কিন্তু কোথায় যে রাখে সেটাই আর মনে করতে পারে না। কতবার ভেবেছে কোন জিনিস কোথায় রাখছে সেটা একটা ডায়েরীতে লিখে রাখবে। ওর এই পরিকল্পনা শুনে শোভন গম্ভীর মুখে বলেছিল, “আর ডায়েরীর ঠিকানাটা দেওয়ালে সাঁটিয়ে রেখ”।  

রেগে গিয়েছিল বনানী, ‘সেই তো ! তুমি নিজের ঠিকানাটা মনে রেখ তাহলেই হবে’। পুরোনো আমলের বাড়িটা রকমারি ফার্নিচারে ভর্তি। যত বেশি রাখার জায়গা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি। কিন্তু কোনটাকেই তো বাদ দিতে পারে না। জিনিসপত্র কি কম ! এক শীতের পোশাকই অজস্র। বিশেষ করে শোভনের। শীত এলেই আতঙ্ক হয় বনানীর। সবার সব জিনিসপত্র প্রয়োজন মতো বের করে দিতে হবে। হঠাৎ হঠাৎ শোভন বলবে, “ বনি, আমার লাল জ্যাকেটটা কোথায় বলত ? কিংবা “গত বছর যে উলেন মোজা গুলো কিনলাম সেগুলো?” 

নয়তো বলবে “রাঙাপিসী সেই যে সিমলা থেকে একটা পুলওভার এনেছিল না ; ওটা কোথায় রেখেছ ?” বাড়ির বাকি সদস্যরাও কম বেশি শোভনকেই অনুসরণ করতে অভ্যস্ত। সুতরাং বনানীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কোন আলমারীতে কোন সোয়েটার, কোথায় কোন মাফলার, চাদর ! উফ্ বনানী পুরোনো ট্রাঙ্ক, ডিভান, লফট্ সব তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেরায় সেই মুহূর্তের মহার্ঘ্য বস্তুটিকে। আর এই খোঁজাখুঁজির সময় বনানী কদাচিৎ যদি মুখ ফসকে বলে ফেলে “কোথায় গেল বলত”? ব্যস শোভনের সেই গা জ্বালানো উক্তিটি প্রস্তুত, “ঐ তো অমুক জায়গায় দেখ!’’ কিন্তু আজ কি হবে ! বাড়ির পুরোনো সব ট্যাক্সের বিল একটা হলুদ ফাইলে থাকে। আগে শ্বশুর মশাই রাখতেন। বিয়ের পর অন্যান্য দরকারি কাগজ পত্রের সঙ্গে এই ফাইলটাও বনানীকে রাখতে দিয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকে বারো – তেরো বছর ধরে সে রাখছে। বছর দু’য়েক আগে খুব পুরোনো বিলগুলোকে অন্য একটি ফাইলে রেখে শেষ দশ বছরের বিল  হলুদ ফাইলেই রেখেছিল। আর এই শেষ বিলগুলোই খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির মালিকানার পরিবর্তন, জায়গা – জমি বিক্রি সব এই বছরগুলোতেই হয়েছে। বাড়ি ও জমিজমা সংক্রান্ত শরিকি ঝামেলার সমাধানে ঐ বিলগুলি খুব জরুরী। শোভন কয়েকদিন হাঁটাহাঁটি করে ওর বন্ধুর সুত্রে পৌরসভার এক অফিসারের  আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে। উনি সব কাগজপত্র ও বাড়ির দলিল নিয়ে দেখা করতে বলেছেন। কাল রাতেই সব গুছিয়ে রাখার কথা। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে বনানী ঘুমিয়ে পড়ায় সব কাজ পড়ে আছে। আর ঘুম ভেঙে এটা মনে পড়তেই ও দৌড় লাগিয়েছিল স্টাডি রুমের দিকে। কিন্তু দরকারি ফাইলটাই তো পাচ্ছে না। টেনশনে রীতিমত ঘাম হচ্ছে বনানীর। প্রাক্ বসন্তের  এই সকালগুলো    উজ্জ্বল আলো মেখে ভালোলাগায় ভরে থাকে। ছুটির দিন গুলোয় এই সময়টা বনানী বাগানেই কাটায়। শুধুই যে গাছে জল দেয় কিংবা আগাছা পরিষ্কার করে তা নয়; গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে দেয় সে, কখনও কখনও মৃদু স্বরে কথাও বলে ওদের সঙ্গে। যদিও খুব সন্তর্পণে ঠিক যেমন দিদা বলত বাগানে ফুল তুলতে তুলতে।  বনানীর মায়ের তখন লিউকোমিয়া ধরা পড়েছে। বাঁচার আশা নেই। বনানী দিদাকে দেখেছে মায়ের হাতে লাগানো গাছেদের কাছে গিয়ে রোজ ভোরে সন্তানের আরোগ্য কামনা করতে। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। তারপর থেকে বনানীও সবুজ পাতায় হাত দিয়ে খুঁজে পেয়েছে সখ্যতা। গেটের সামনেই উপুর হয়ে আছে  মাধবীলতা। একরাশ সবুজ পাতা আর নরম রঙের ফুলগুলোর মিষ্টি গন্ধে বনানী হঠাৎই যেন পৌঁছে যায় তিরিশ বছর আগের মামার বাড়ির বাগানে। সেই গন্ধ। সেই ছবি। মাধবীলতার কাছে গিয়ে চোখ বন্ধ করে শুষে নেয়  পুরোনো সেই নির্যাস। আর আজ ! টেনশনে ঘাম হচ্ছে বনানীর। পেট ব্যথা করছে। শোভন এখনও ঘুমচ্ছে। উঠেই চিৎকার করবে। যার প্রথম বাক্যটাই হবে,” একটা কাজও তুমি গুছিয়ে করতে পারো না”। শোভন যা খুশি বলুক তাতে নতুন করে আর  খারাপ লাগার কিছু নেই। বরং এই কাজটা আটকে যাওয়া মানে ওদের ব্যাঙ্কের লোন পাওয়ার সম্ভাবনা আরো ফিকে হয়ে যাওয়া। সেই সঙ্গে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া দোতলা বাড়ির স্বপ্ন। কান্না পাচ্ছে বনানীর। দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে। এখনও সবাই ঘুমোচ্ছে। এরপর শাশুড়ি, শ্বশুর, মেয়ে সবাই একে একে উঠে পড়বে। আরো একবার প্রকট হবে গৃহিণী হিসেবে বনানীর ব্যর্থতা। শুধু বইয়ের স্তূপে মুখ গুঁজে থাকলে যে সংসার চলে না সেটা স্পষ্ট হবে সবার নীরব চাহনি আর মৌখিক অভিব্যক্তিতে। কিন্তু এসবও তুচ্ছ এখন। বনানীর আফশোস হচ্ছে আজ ঐ অফিসারের সঙ্গে দেখা করলে যে সমাধানের রাস্তাটা পাওয়া যেত সেটা হারিয়ে যাবে ভেবে। মাথার উপর একগাদা কাজ। কাল রাতে মিনতি রান্না করতে আসেনি। ও স্কুল থেকে ফিরে শুনেছিলো । আজ সকালের রান্না, মেয়েকে তৈরি করে স্কুলে পাঠানো সব সামলে ওকে আর শোভনকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে পৌঁছাতে হবে পৌরসভায়। যাওয়ার পথে উকিল কাকুর বাড়ি থেকে ওয়ারিশন সার্টিফিকেট গুলো নিতে হবে। পর পর কাজ গুছিয়ে রাখা আছে। মাথাটা দপদপ করছে। ফাইলটা খুঁজে না পেলে দুজনের ছুটিই নষ্ট হবে। মার্চ মাসের এই চরম ব্যস্ততার সময়ে শোভনের ছুটি নেওয়া খুব কঠিন। তাও নিয়েছে বেচারা। আর সত্যি  বলতে কি দোতলার ভূতটা তো বনানীর মাথাতেই চেপেছে, শোভনের তো নয়। বনানী চোখ কচলে চারপাশে তাকায়। কি হবে আর ! এই অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে থাকার সময়টা দীর্ঘতর হবে। নাহ্ এতটা হতাশ হওয়া ঠিক নয়। বনানী নিজেকে শক্ত করতে থাকে। বিকল্প একটা উপায় ভাবতে হবে। উকিল কাকু বলেন, “আমাদের কাছে হয় না বলে কিছু নেই”। শোভনের জামাইবাবুও সেদিন বলেছিল, “বনি, আমাদের দেশে নিয়ম কানুন মেনে কিছু করতে গেলে তোমায় কাঠ ও খড় দুটোই পোড়াতে হবে আর বেআইনি কিছু করলে ইটস্ টু ইজি টু বিলিভ...” । কিন্তু শোভন বা বনানী কেউই বাঁকা পথে কিছু করবে না। তাই ব্যাঙ্কের লোন পাওয়ার জন্য সোজা পথেই হেঁটে সমস্ত কাগজ পত্র জোগাড় করতে গিয়ে সেই  সোজা পথের গোলক ধাঁধায় ওরা ঘুরে ঘুরেই মরছে কেবল। পদে পদে বাধা। যেটা পাওয়া যাচ্ছে না সেটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। শোভন বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে বলে। “ দূর এসব অভিশপ্ত সম্পত্তি । কিস্যু হবে না এখানে। চল দু’ কাঠা জমি কিনে নিই এসব বিক্রি করে। বনানী কিছুতেই হাল ছাড়বে না। এই বাড়িতে  তার কি যে মায়া সে নিজেও জানে না ! 

এভাবে হাল ছেড়ে দিলে হবে না। বনানী যখনই কোন জিনিস খুঁজে পায়না ক্লাস নাইনে পড়া একটা গল্পের কথা মনে করে সেখানে একটা দরকারী চিঠি সামনেই ছিল অথচ সবাই সেটাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। এমনটাই নিশ্চয় এই ফাইলটার ক্ষেত্রে হবে। পাশের ঘরগুলোর সমস্ত জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজবে বলে আশায় বুক বেঁধে উঠে দাঁড়ায় বনানী, আর উঠে দাঁড়াতেই ওর পায়ের উপর ছড়িয়ে পড়ে একগাদা কাগজপত্র। খুব বিরক্ত হয়ে কাগজগুলো তুলতে গিয়ে বনানীর চোখ আটকে যায় একটা পুরোনো খামে।  মনে পড়ে বিয়ের প্রথম দিকে বাপের বাড়ি থেকে ওর পুরোনো বইপত্রের সঙ্গে আরো কিছু প্রিয় জিনিস নিয়ে এসেছিল। যেমন বন্ধুদের দেওয়া গ্রিটিংস কার্ড, প্রথম স্কুলের ছাত্রীদের দেওয়া উপহার।

তেমনই কিছু পুরোনো জিনিস, টুকরো ছবি, নরম কিছু মুহূর্ত ফাইল কিংবা ব্যাগবন্দি হয়ে পড়েই আছে কেবল ডানা মেলার অবসর ও উপযুক্ত স্থানের অভাবে। ফাইল খোঁজার ব্যস্ততা হালকা হয়ে যায় এক লহমায়। খামের ভেতরের কাগজগুলোকে বের করে। তারপর সিলিং ফ্যান বন্ধ করে মেঝের উপর একে একে মেলে ধরে, ‘তুই আগে কথা বল’ – তুমুল ঝগড়ার পর ভাইয়ের লেখা চিরকুট। “দিদি, তোর পুতুলের জামাটা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম, রাগ করিস না” – মামাতো বোন টিঙ্কা। একটা ইনল্যান্ড লেটার। ছোট মাসি, বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থেকে লিখেছে বনানীর মাকে। সঙ্গে ‘স্নেহের বনি’ বলে তার জন্যও দু চার লাইনের আদর। সাদা পাতায় বড় মাসিমনি। তিনটে স্টেশনের দূরত্ব। দেখা হত প্রায়শই। ল্যান্ড ফোন এসেছে ততদিনে। সেটা এক সপ্তাহ খারাপ থাকায় কারখানার কর্মচারীর হাতে এসেছিল, ক’দিন খবর নিতে না পারায় উদ্বেগ। সেই ছেলেটির হাতেই পাঠাতে হয়েছিল তার উত্তর। সেই একই মায়া–মমতার শব্দ বুনন। আজ কত সহজ হয়েছে যোগাযোগ কিন্তু দূরে থেকেও সেই যে ছুঁয়ে থাকার আকাঙ্ক্ষা তা কি আজও এমন তীব্র ?  এবার সবচেয়ে হলদেটে কাগজ। হ্যারিকেনের আলোয় বসে কোনো এক ঝিঁঝিঁ ডাকা নিশুতি রাতে লিখেছে বনানীর দিদা,

 “ তোদের জন্য মনটা বড় কাঁদে। আমার এই ভাঙা বাড়িটাও কচি মুখগুলোর পথ চেয়ে থাকে। কি দিই আমার সোনা মানিকদের তাই হাতড়ে বেড়াই সর্বক্ষণ।  আজ কটা ক্ষীরের লুচি করেছি। দেখি যদি কারো হাত দিয়ে পাঠাতে পারি। আদর নিস তোরা।”

 বনানীর মনে আছে কারো হাত দিয়ে নয়; এই চিঠি আর এক কৌটো ক্ষীরের লুচি নিয়ে পরের দিন সকালেই এসেছিল তাদের দিদা, দিদিভাই।  কত দূরে আজ ! যেখান থেকে শুধু চিঠি কেন কোন সংকেত বার্তাই আর পৌঁছয় না এই রক্ত-মাংসের পৃথিবীতে। সেই নরম সাদা শাড়ির অপার স্নেহ যেভাবে আগলে রেখেছিল ওদের তিন ভাইবোনকে মায়ের মৃত্যুর পর তা ভাবনার অতীত !

অথচ কিই বা প্রাপ্তি ছিল তাঁর এই জীবনের কাছে। বনানীর মনে হয় অন্তরালে থাকা এমন সব চিরকুটেই শিউলি হয়ে ফুটে রয়েছে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া কিংবা বদলে যাওয়া সম্পর্কের স্মৃতিচিহ্ন। কে জানে আজও কোন অনন্ত লোকে বসে মানুষটা মাতৃহীন নাতি নাতনীদের জন্য চোখের জল ফেলছে কিনা! না কি দেহ মুক্ত আত্মা এই মায়া ভুবনের কথা ভুলে যায় একেবারে?

কি গো পাখা বন্ধ করে কি করছ এই গরমে ? আচমকা পিছনে শোভন ! বুজে আসা গলাটায় কোনরকমে ঢোক চিপে বনানী বলে, “ওহ্ না, মানে ঐ একটা ফাইল. . . ট্যাক্সের বিলের ফাইলটা খুঁজছি”।

“ আরে ওটা নিয়ে গতকাল সন্ধ্যে বেলায় মলয় দার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। অফিসারকে  ঠিক কিভাবে বিষয়টা বোঝাবো তার একটা মকশ করে নিলাম।  বুঝেছ’’? 

বনানী বলে, “ ও আচ্ছা”। 

শোভন বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “খামোকা সকাল সকাল তোমার সময় নষ্ট হল। তাড়াতাড়ি চায়ের জল চাপাও তো”। 

বনানী তখনও মেঝেতে সেভাবেই বসে আছে। কতগুলো টুকরো কাগজের কোলাজে তৈরি হওয়া একটা ধূসর ছবির সামনে। অগুনতি দৃশ্যপট বদলে কিছতেই যেন আর ফিরতে পারছে না এই জমি – বাড়ি – লোনের সত্যি মিথ্যে গল্পে।      




    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন