হিন্দু কলেজ ও ডিরোজিয়ানরা
কলেজ স্কোয়ারের ভেতরে ঢুকে ওয়াই এম সি এ-র ক্যান্টিনে কখনো চিকেন স্টু আর পাঁউরুটি খেয়েছেন? অথবা গোলদিঘির পাড় ঘেঁষে দুপা হেঁটে যেতে যেতে কখনো তাকিয়েছেন হিন্দু স্কুলের বারান্দার দিকে? কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন এই গোলদিঘির পাড় ঘেঁষে কলকাতা তথা নব্য বাংলার নবজাগরণের ঢেউটার দিকে? দেখেননি তো? চলুন একটু দেখে আসি। কলেজ স্কোয়ারে পায়চারি করতে করতে কখনো তাকিয়ে দেখেছেন উত্তর দিকে উঁচু ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যে তৈরি কলেজ ভবনের একটা ত্রিকোণ চূড়ার দিকে? পূর্বে বিখ্যাত হিন্দু স্কুল আর পশ্চিমে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের ঠিক মাঝখানে আজও আপনি খুঁজে পেতে পারেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একখণ্ড জলজ্যান্ত ইতিহাস। বুঝতে পারছেন না তাইতো? সঙ্গের ছবিটিতে দেখুন। দেখতে পাচ্ছেন সেই চূড়া? গাছগাছালি ভেদ করে উঁকি মারছে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায়। বাংলার নব্য আধুনিক যুগে স্কুল কলেজগুলো স্বাভাবিক ভাবেই ভিক্টোরীয় স্থাপত্যরীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বেথুন কলেজ ভবন, শ্রীরামপুর কলেজ ভবনে আজও সেই রীতি স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বাংলার নবজাগরণে যে ভবন কলকাতার যুবক সমাজে ঝড় হয়ে আছড়ে পড়েছিল, যে ভবনে একসময় প্রতিদিন পা রাখতেন ডিরোজিও সাহেব, রিচার্ডসন সাহেব, টাইটলার সাহেবদের মতো রেনেসাঁসের কান্ডারীরা, কোথায় গেল সেই আস্ত বাড়িটা? হ্যাঁ, আমি ১৮১৭ সালে গোলদিঘির পাড়ে স্থাপিত হিন্দু কলেজের কথাই বলছি। পরে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের সাথে কলেজ কতৃপক্ষের গোঁড়া হিন্দু কর্তাব্যক্তিদের বিবাদের ফলে যা ভাগ হয়ে যায় দুটি ভাগে। কলেজ বিভাগটি আজকের প্রেসিডেন্সি কলেজ আর স্কুল বিভাগটি কলেজ স্কোয়ারের পাশে হিন্দু স্কুল। সে নয় হল। কিন্তু হিন্দু কলেজের ভবন?
ভিক্টোরীয় স্থাপত্যে নির্মিত একটা বিরাট বাড়ি একেবারে ভেঙে ফেলা হবে তা আবার সম্ভব নাকি। তাই প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতোই। আর উত্তরও মিলে গেল একদিন। সেই কলেজ স্কোয়ারের উত্তরে ও সংস্কৃত কলেজের পিছন দিকে পরিত্যক্ত পড়ে থাকা সুউচ্চ ত্রিকোণ আর্চটি। কখনো দেখেছেন যে একটি কলেজ ভবনের পিছনে আর একটি মুখ্য দরজা। লম্বা লম্বা স্তম্ভ, আকাশছোঁয়া দরজা। পা ফেলে ওঠবার সিঁড়ি। যেন সংস্কৃত কলেজের পিছনদিকে আরো একটি কলেজ। কিন্তু সামনে কলেজ স্কোয়ারের পাঁচিল দিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ, আর দরজাটির আশপাশে উদ্বাস্তু ঠাঁইখোঁজা মানুষের বাস। কলেজ স্ট্রিটের মাঝখানে আজও পড়ে থাকা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলার সামাজিক মানচিত্রে ঝড় তোলা একটা জীবন্ত অধ্যায়। কেউ ফিরেও তাকায় না সেদিকে। গাছগাছালির মধ্যে উঁকি মারা ত্রিকোণ আর্চ আর হিন্দু কলেজের মুখ্যদরজা আজ কেবল লোককথা। দরজা বুজিয়ে তা আজ সংস্কৃত কলেজের পিছনের দেয়াল। তিন বছর ধরে পড়ে যাওয়া আজকের ছাত্রদের অনেকে হয়ত জানেই না লুকিয়ে থাকা এই স্থাপত্য আর ইতিহাস। কিন্তু কলেজ স্কোয়ার থেকে আজও স্পষ্ট দেখা যায় ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বাঙালির নবজাগরণের প্রথম পথিকৃৎ ও রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদারদের স্মৃতিবিজড়িত সেকালের হিন্দু কলেজের মেনগেট। যার বাকি অংশ আজ কেবল স্মৃতির পাতায়। সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু স্কুলের বর্তমান বাড়ির সঙ্গে মিশে গেছে কালের চাকায়। কিন্তু সংস্কার কই? যা হয়ত কলকাতার প্রধান দ্রষ্টব্য হবার দাবী রাখে তা পড়ে আছে একেবারে অবহেলায়? যার ঐতিহাসিক চূড়া আজ ভেঙে পড়ছে একটু একটু করে। কলেজ স্ট্রিটের বেশিরভাগ মানুষ তথা বইবিক্রেতাই জানেন না এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের কথা।এমনকি সংস্কৃত কলেজের গেটে বসা নিরাপত্তারক্ষীও উড়িয়ে দিলেন এই স্থাপত্যের কথা। বিখ্যাত ইংরেজ শিক্ষাবিদ ও মিশনারী ডঃ রেভারেন্ড উইলিয়াম কেরী প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজ যদি ১৮১৮ সাল থেকে আজও সমান গরিমায় বাঁচিয়ে রাখতে পারে তাদের পুরনো ভবন (যদিই কলেজ ভবন ১৮২২ সালে তৈরি), তবে হিন্দু কলেজের পুরনো ও ঐতিহাসিক ভবন কেন নয়? বাঙালিকে কী দেয়নি হিন্দু কলেজ। গোঁড়া ঘুণ ধরা একটা সমাজকে দিয়েছে পাশ্চাত্যের তীব্র আলো। যে আলোয় একদিন ভেসে গেছে শহর কলকাতা। কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হাইড ইস্ট সাহেব, শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব, রাজা রামমোহন রায়, দেশবরেণ্য ডেভিড হেয়ার সাহেবদের মতো ব্যক্তিত্বদের আলোয় আর ডিরোজিও, রিচার্ডসনের শিক্ষায় এই ভবন একসময় বাঙালিকে শিখিয়েছিল প্রথা ভেঙে বেরোনোর কৌশল। সকলের আড়ালে হিন্দু কলেজের পাশ্চাত্য স্থাপত্যরীতির থামগুলো আজও জানান দিচ্ছে সেই দিনগুলোই। এবার কলেজ স্ট্রিটে গেলে অবশ্যই একবার কলেজ স্কোয়ারে ঢুকে প্রত্যক্ষ করে নিতে পারেন সেই জীবন্ত জীবাশ্মটিকে।
অতিরিক্ত গোমাংস ভক্ষণের ফলে মৃত্যু। তাও আবার গোঁড়া হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল এক পরিবারের সদস্যের। মৃত্যুর এহেন রিপোর্ট যাঁর কথা স্মরণ করাচ্ছে, তিনি একসময়ের ভারত বিখ্যাত ল্যান্ড সার্ভেয়র রাধানাথ শিকদার। আবার গোঁড়া হিন্দু পরিবারের ছেলে হয়ে বন্ধুদের পার্টিতে গোমাংস ভক্ষণ। পরিণামে হিন্দু সমাজে একঘরে করে দেওয়া। কিন্তু উদ্যম না হারিয়ে ধর্মত্যাগ করে সোজা খ্রীষ্টমন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণ ও কলকাতায় খ্রীষ্টধর্মের প্রচার। যাঁর কথা বলছি তিনি রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা সকলেই হিন্দু কলেজের ডিরোজিয়ান। পলাশী যুদ্ধের পরে কলকাতায় গোড়াপত্তন হয় এক নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপট। যেখানে ইংরেজ তাঁবেদারির পুরস্কার হিসাবে খুব তাড়াতাড়ি মিলে যেত রাজাবাহাদুর বা রায়বাহাদুর খেতাব। উদযাপনও ছিল আশ্চর্যের। মা দূর্গাকে উপলক্ষ্য করে কলকাতার বহু বড়লোক বাড়ি মোচ্ছব দেখেছে সেকালে। দেখেছে বাইজী নাচ, ধুলোর মতো টাকাখরচ। এই তোষামোদীর প্রতিযোগিতা অসুস্থতায় পরিণত হলে ও আপামর কলকাতাবাসীর মেরুদণ্ড ভেঙে দিলে ভীষণ ভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একদল একদম নব্য শিক্ষিত যুবকের। হয়ত হিন্দু কলেজ তৈরির আগে কেউ পাশ্চাত্য শিক্ষার আঙ্গিক নিয়ে ভাবেই নি। ভেবেছিলেন রাজা রামমোহনের মতো কিছু দেশীয় মহানুভব মানুষ আর ডেভিড হেয়ার সাহেবের মতো ভারতপ্রেমী ভিনদেশী। মহাত্মা রামমোহনের কথা আর কি বলবো, কিন্তু যে মানুষটা বিলেত থেকে ঘড়ির ব্যবসা করতে এসে সব বাদ দিয়ে লেগে পড়েন শুধু নেটিভ এডুকেশনকে লক্ষ্য বানিয়ে, যে মানুষটার পালকির পিছনে একসময় ছুটতেন শিক্ষার্থী থেকে অবিভাবকের দল, সেই ডেভিড হেয়ার সাহেবের ঋণ কি বাঙালী একজন্মে শোধ করতে পারবে? কলেজ স্কোয়ারের পাশে মেডিকেল কলেজের উল্টোদিকে তাঁর সমাধিও আজ মানবচক্ষু উপেক্ষিত। আশপাশের দোকানদাররাও ব্যস্ত সময় থেকে একটু সময় বের করে চেয়ে দেখেন না আর সেদিকে। যাই হোক, অনেক পরিশ্রমের ফল সেকালের হিন্দু কলেজ। কলকাতায় কলেজ তৈরির পটভূমিটা খুব আকর্ষণীয়। বিলেত থেকে ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের কলকাতা শহরে হঠাৎ আগমন হলেও তারা এদেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতির বিষয়ে ছিল একেবারেই অন্ধকারে। লর্ড ওয়েলেসলী প্রথম এই অভাব অনুভব করেন। আর তারই ফলস্বরূপ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। যা কলকাতার মাটিতে পাশ্চাত্য শিক্ষার এক ম্যাসিভ রেভলিউশন। কে পড়াতেন না সেখানে। শ্রীরামপুর মিশনারীর বিখ্যাত উইলিয়াম কেরী সাহেব থেকে উড়িষ্যাদেশীয় বিখ্যাত পন্ডিত মৃত্যুঞ্জয়ী বিদ্যালঙ্কার ও চুঁচুড়ার আদ্যোপান্ত বাঙালি রামরাম বসু। ইংরেজ সিভিলয়ানদের বাংলা, ফার্সী, আরবি শিখিয়ে পড়িয়ে কোম্পানির দপ্তরের অফিসিয়াল কাজে লাগানোটাই একমাত্র উদ্দেশ্য। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একটা অধ্যায়। খুব বেশিদিন না চললেও কলকাতার পাশ্চাত্য শিক্ষায় এই কলেজ একটা মাইলস্টোন। বাংলা গদ্য সাহিতে এই কলেজের অবদান সুবিদিত। কলেজে পড়ানোর জন্য দরকার বাংলা গদ্য বই। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে পরপর সেসময় প্রকাশিত হয় কেরী সাহেবের 'কথোপকথন'। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের 'রাজাবলী', 'হিতোপদেশ'। রামরাম বসুর 'প্রতাপাদিত্য চরিত্র'। বাংলা সাহিত্যে এইসব গদ্য বই আজও সম্পদ। যাই হোক, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কলকাতার মাটিতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বীজটা বুনে দিলেও তা একান্তই ছিল বিলিতি সিভিলিয়ানদের জন্য। কিন্তু এদেশের বাঙালি হিন্দু সমাজের তরুণ যুবসমাজে গোঁড়ামি আর অবক্ষয়ের দিকটা নিয়ে ভাবেনি কোম্পানি বাহাদুরের উচ্চপদস্থ অফিসাররা। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা তাই বাংলা পাশ্চাত্য শিক্ষায় একটা প্রবল ঝড়। যে ঝড়ে খড়কুটোর মতো উড়ে গেছিল বাঙালির গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদ। গোলদিঘির পাড়ে ভিক্টোরীয় স্থাপত্যে তৈরি এই ভবনেই দলে দলে ভর্তি হয় বাঙালি যুবকের দল। হেয়ার সাহেব তৈরি করেন স্কুলবুক সোসাইটি। স্কটল্যান্ড থেকে জাহাজে এদেশে আসার পর কলকাতায় ঘড়ির দোকান করেন হেয়ার সাহেব। এদিকে ওপরদিকে খানাকুলের বাড়ি থেকে বহিস্কৃত রামমোহন রায়ও থাকতেন কলকাতায়। ডেভিড হেয়ারের সাথে ঘটনাচক্রে বন্ধুত্ব হয় রামমোহনের। আর তখনই সকলের অজান্তেই তৈরি হয় হিন্দু কলেজের ভিত। এদেশীয় বাঙালি যুবকদের ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত করবার ব্যাপারটা নিয়ে প্রবলভাবে চিন্তা করতেন দুজন। এমনকি হেয়ার সাহেবের ঘড়ির দোকানে আসা ক্রেতাদের সাথেও তিনি আলোচনা করতেন নতুন কলেজের বিষয়ে। কলকাতায় ইংরেজি কলেজ একটা ভীষণ দরকার। গোঁড়ামির অন্ধকারে ডুবে যাওয়া বাঙালি যুবসমাজ যদি আলোর পথ না পায় তবে আর রক্ষে নেই। কারণ ইতিমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ধর্মের গোঁড়ামি। আর তার ফল হল সতীদাহ, সাগরে শিশু নিক্ষেপের মতো বর্বর সামাজিক প্রথা। বিভিন্ন দিক থেকে কেরী, মার্শম্যান, হেয়ার সাহেবরা দৌড়ে বেড়াতেন বটে, কিন্তু তাঁরা বুঝেছিলেন যে বাঙালি হিন্দুর সামাজিক অবস্থান না পাল্টালে তা কখনোই ফলপ্রসু হবার সম্ভাবনা নেই। এর আগে সঠিক ইংরাজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেনি একটিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর আগে কলকাতায় কলেজ বলতে ওয়ারেন হেস্টিংসের হাতে তৈরি মাদ্রাসা (বর্তমানে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িটি) এবং ওয়েলেসলীর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। কিন্তু উভয়ই ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের দেশীয় শিক্ষালাভের কেন্দ্র। তবে বাঙালি যুবকদের ইংরাজি শিক্ষার জন্য কয়েকটি প্রাইভেট উদ্যোগ যে হয়নি তা নয়। ফিরিঙ্গীদের উদ্যোগে বসেছিল কয়েকটা ছোট বিদ্যালয়। সারবার্ণ নামে এক ফিরিঙ্গী চিৎপুর রোডে খুললেন স্কুল। দ্বারকানাথ ঠাকুর এক স্কুলেই পড়েছিলেন কিছুদিন। এছাড়াও মার্টিন বোউল, আরাটুল পেট্রাস নামক সাহেবরা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মালিকানায় সেযুগেই খুলে ফেলেছিলেন প্রাইভেট স্কুল। সেযুগে ইংরাজি শিক্ষা ছিল বড় অদ্ভুত। ছড়ার মতো করে শেখানো হত ইংরাজি শব্দ। আর পাস করবার পরে ছাত্র কতগুলো ইংরাজি শব্দ জানে তার ওপর দেওয়া হত শংসাপত্র। যেমন ধরুন -
"গাড্ ঈশ্বর, লাড্ ঈশ্বর, কাম মানে এস
ফাদার বাপ, মাদার মা, সিট মানে ব'স
ব্রাদার ভাই, সিস্টার বোন, ফাদার সিস্টার পিসি
ফাদার ইন ল শ্বশুর, মাদার সিস্টার মাসী
আই মানে আমি, আর ইউ মানে তুমি
আস্ মানে আমাদিগের, গ্রাউন্ড মানে জমি
ডে মানে দিন আর নাইট মানে রাত
উইক হল সপ্তাহ আর রাইস মানে ভাত
পমকিন্ লাউ কুমড়ো, কোকম্বর শসা
ব্রিঞ্জেল বার্ত্তাকু আর প্লোমেন্ মানে চাষা।"
আজকের দিনে সত্যিই বড় অবাক হবার বিষয়। তাই না? অর্থাৎ ব্যকরণের দিকে জোর না দিয়ে শব্দের ভাণ্ডার বাড়ানো। আর বাঙালিদের ইংরাজিও ছিল তেমনই। শুধু নাউন জুড়ে বাক্য ঘটনার মতো। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' বইতে একটা মজার ইংরাজি বলার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। একজন ইংরেজ সাহেব তার বাঙালি কর্মচারীকে ঘোড়ার দানা চুরি করার অপরাধে ভর্ৎসনা করছেন। বাঙালি পরিচারক জবাব দিচ্ছেন - "ইয়াস শার্, মাই হাউস মর্নিং অ্যান্ড ইভনিং টুয়েন্টি লীভস্ ফল, লিটিল লিটিল পে, হাউ ম্যানেজ?" অর্থাৎ এই সামান্য আয়ে তাঁর বাড়িতে ২০ টি পাত পড়ে। এটি সাহেবকে বোঝানোই প্রধান উদ্দেশ্য। এই ছিল তখন শিক্ষিত বাঙালিসমাজের ইংরাজি আওড়ানো।
এরপরে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর হিন্দু কলেজ এমন এক প্রতিষ্ঠান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলো যেখানে শুদ্ধ ইংরাজি শিখিয়ে ও নীতিগত শিক্ষাদানের মাধ্যমে বাঙালি যুবসমাজকে আদর্শগত ভাবে তৈরি করা হত একটু একটু করে৷ ধর্মীয় গোঁড়ামির ওপরে উঠে মানবতার ধর্মে দীক্ষা নেবার শিক্ষা এখানেই তিল তিল করে বুনে দেওয়া হত সমাজের গোড়ায়। আর সেই শিক্ষাটুকুর আলো ছড়িয়ে পড়ত আসমুদ্রহিমাচল। নব্য ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি যুবকরা যে একেবারেই বিশৃঙ্খলা করতেন না তা নয়। এবং স্বভাবতই সেই সমাজে তা অত্যন্ত দৃষ্টিকটুও ঠেকেছিল একটা বড় অংশের। কিন্তু তার অনেক ওপরে উঠে হিন্দু কলেজের স্কলাররা যে ছিলেন এক একটা রত্ন, তা তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই পরবর্তীতে প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন।
আবার শেষ করার আগে পৌঁছে যাই কলেজ স্কোয়ারের পাড়ে আজও দাঁড়িয়ে থাকা সেই ত্রিকোণ ভিক্টোরীয় আর্চের তলায়। আজও সকলের চোখের আড়ালে যার প্রতিটি সিঁড়িতে লেগে আছে সেইসব কৃতি বাঙালি সন্তানের পায়ের ছাপ। কিন্তু ছুঁয়ে দেখছে কে? কে একবার দাঁড়িয়ে আপামর গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলছে - "নিজেরা চিন্তা কর। বেকনের উল্লিখিত কোনও দেবতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ো না। সত্যকেই জীবন এবং মৃত্যুর অবলম্বন ধরে নাও" - হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন