শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সৌমী আচার্য্য

                   


শরৎ অনুসঙ্গ


সুজনেষু,

আকাশে কালো মেঘ কেটে শরতের সাদা মেঘের আহ্বান স্পষ্ট দেখা দিয়েছে।বেগে বয়ে যাওয়া জলধারার পাশে উঁকি দিতে শুরু করেছে কাশেরা।এখন রোজই এক সাজি ভর্তি শিউলি ফুল বাগানের বড় গাছটার নীচ থেকে তুলে আনে রূপকথা।আমি লাল শানের ছাদ বিহীন গোল বারান্দায় বসে বিদ‍্যাপতি পড়ি আর ও ফুলের মালা গাঁথে।মাঝেমাঝে কৌতূহল নিয়ে আমার দিকে তাকায়।আমি কালো অক্ষরে গভীর মনোযোগ দিয়েও বুঝতে পারি।নাটমন্দিরে দোমাটি চাপাচ্ছে সতীনাথ পাল।এ বছরের পর ও বোধহয় আর ঠাকুর গড়বে না।হাত কাঁপে চোখেও কম দেখে।এবারেও মাতৃমূর্তি গড়ার আগে আপনার কথা আমায় জিজ্ঞাসা করেছে।

-দিদিমণি,পোফেসার বাবু এবার কি আসবে?বোধনের সময় কেমন মন্তর বলতো।আহা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়।মনে হল মা দুগ্গা দুহাত বাড়িয়ে তার থেকে অস্তর নিচ্ছে।

সত‍্যি আপনার সংস্কৃত উচ্চারণ স্পষ্ট নিঁখুত।পারলে সস্ত্রীক আসুন এবার।আপনার জন‍্য দোতলার ঝুল বারান্দাওয়ালা ঘরটা রাখা আছে।আপনার ব‍্যবহারের বহু জিনিস রয়ে গেছে।নাহ্,ওখানে কাওকে থাকতে দেওয়া হয়নি এখনো।মাঝেমাঝে যাই অতীতের মাঝে গিয়ে দাঁড়াই।আপনার বেশ কয়েকটা বই রয়ে গেছে।আমি পড়ি কখনো কখনো।মনে হয় হয়তো এখানেই আঙুল রেখেছিলেন,ছুঁয়ে যাই।পড়তে পড়তে আপনি উদাস হয়ে বারান্দায় তাকিয়ে থাকতেন আমি পিছন থেকে দেখতে পেতাম।খুব ইচ্ছে করতো জানতে চাইবো কি ভাবছেন?রাত জেগে থিসিস লিখতেন আমি টের পেতাম।টুপটুপ করে শিউলি ঝরে পড়তো,শিশির নামতো বাসন্তী বৃন্তে আর আমিও ঘুমিয়ে যেতাম।

আমাদের বাড়ির কলমিপিসি আপনার ঘরখানা মুছে দেয়।আমি তালা খুলে ঝুল বারান্দায় দাঁড়াই।কলমিপিসি একাই বকবক করে।

-পণ্ডিতের খবর পাওনা কোনো?দিনের পর দিন এই ঘর বন্ধ রেখে লাব কি বুঝিনা বাপু।সে তো শুনি বিয়ে করে সংসার ধম্ম করছে।তা তোমার চুল আর কতটা সাদা হলে তুমি বিয়ে করবে?তোমার মা যে কেঁদে কেঁদে অসুখ বাধিয়ে নিল।বুড়ো বাপটার কথাও কি ভাববে না?

গেল মাসে সেই যে চুলে তেল দিতে গিয়ে কয়েকটি রূপোলি তার পেল,সেই থেকে ওর মাথাটাই গেছে।কি করে বোঝাই বলুন তো আপনি বিয়ে করলেই আমার সমস‍্যার সমাধান হয়না।এই একটি বিষয় নিয়ে আমি মা বাবার বিপক্ষে আজো দাঁড়িয়ে আছি।বাবা আজকাল আমার সাথে ভাববাচ‍্যে কথা বলেন।তার মতো নরম মানুষের পক্ষে এই যথেষ্ট রাগ প্রকাশ।তবে আমি মনে মনে হাসি।এটুকু রাগ না করলেই বরং কষ্ট পেতাম।হাজার হোক আমি তার একমাত্র মেয়ে।

এই দেখুন আমার পড়াটড়া সব শিকেয় উঠলো আজ।অতীতের ভেতর থেকে কত দৃশ‍্য যে চুপিচুপি এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ায় কি আর বলি!প্রথম এলেন আমাদের নাটমন্দিরের সামনে সেদিন অষ্টমী।আপনার পাকা গমের মতো রঙ ধূপের অস্বচ্ছতাতেও স্পষ্ট।চৌকো গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা আর মুখ চাপা হাসি।কী বুদ্ধীদীপ্ত চাহনি।আমি তখন অঞ্জলীর ফুলের বাটা হাতে শাড়ি সামলাতে ব‍্যস্ত।হাত বাড়িয়ে বললেন,"আমায় দেবেন?"আমি কিন্তু তখনি উজার করে দিয়েছিলাম।সবটুকু।নিঃস্ব হয়েছিলাম সে মুহূর্তে।পুজো শেষে বড়োরা ভোগের থালা বাড়ির ভেতরে নিচ্ছে আর আমি কলমিপিসির সাথে যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা ফুল কুড়িয়ে বেড়াচ্ছি।বাবা এসে বললেন,"এসব ছেড়ে এনাকে দোতলার ঝুল বারান্দাওয়ালা ঘরটি দেখতে নিয়ে যাওয়া হোক"আপনি বোধহয় হাসছেন তাইনা?আসলে সেদিনো ভাববাচ‍্যের দিন ছিলো।আমি যে উপোস করেছি প্রথমবার।বাবার মোটেই পছন্দ নয় মেয়ে উপোস করুক।আমি কিন্তু উপোসের ফল পেয়েছিলাম সেদিনই।অভিলাষ দাদু আপনার থাকার কথা বলেছিলেন বাবাকে।আমাদের শহরে কলেজে পড়াতেন এসেছেন একথা শুনে বাবা এক কথায় রাজি হয়েছিলেন।

মনে হয় এই তো সেদিনের কথা।দশমীর দিন মায়ের বিসর্জন সেরে এসে দেখলাম ফাঁকা মণ্ডবে সাদা ধুতি পরে বসে আছেন।মাটিতে দুটো বড় ব‍্যাগ।বুঝলাম এসেছেন আমাদের বাড়ি।আমি তখন সদ‍্য কলেজে উঠেছি।প্রত‍্যকদিন সকালে আপনার কন্ঠে পাঠ শুনে ঘুম ভাঙতো।নিজের মনে ডুব দিয়ে পাঠ করে যেতেন সারা বাড়ি যেন হাতজোড় করে বসতো আপনার কাছে।যাওয়া আসার পথে সিঁড়ির বাঁকে,খাবারের টেবিলে সর্বত্র দৃষ্টি বিনিময় হতে লাগলো।আমার বুকের ভেতরের যন্ত্রটা এত জোরে আওয়াজ করতো মনে হতো সবাই শুনছে ওর আনন্দ উল্লাস।বছর ঘুরতেই প্রথম শরৎ শিউলি কচুপাতায় করে এনে এক ভোরে দিলেন আমায়।

-ইন্দুলেখা তোমার প্রথম শারদ উপহার আমি দিলাম মনে রেখো।

মনে রেখেছি।রূপকথা এবারেও প্রথম শিউলি আমায় কচু পাতায় করে এনে দিয়েছে।ওর চোখের ভাষায় বুঝেছি আপনার কথা মনে পড়ছে ওর।সপ্তমীর দিন সকালে স্নান সেরে নীল ঢাকাই পরে আপনার ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় আপনি এসে দরজায় দাঁড়ালেন।বলে বোঝাতে পারবো না কি ভীষণ সুন্দর লাগছিলো আপনাকে বাদামী পাঞ্জাবী, সাদা পাজামায়।চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন কেন কে জানে?রূপকথা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী।ওকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলনা।ঠিক বুঝে গেল কেন আমি এত আনমনা হয়ে রয়েছি।কতটুকু বয়স অথচ কি ভীষণ বুদ্ধিমতী।আপনি বাড়ি গিয়েছেন।মাকে বলে গেছেন কালীপুজোর পর ফিরবেন।আমার কেবল অস্হির অস্হির লাগে।খেয়ে,স্নান করে,ঘুমিয়ে কিছুতেই স্বস্তি পাইনা।অকারণে চোখে জল আসে।রূপকথা কোমড়ে হাত দিয়ে বেশ রাগ রাগ গলায় বললো,"আমি কিন্তু মাকে এবার সব বলবো দিদি,তুমি এভাবে চললে আবার যদি অসুখটা বাড়ে তখন!তখন কি হবে?পণ্ডিতবাবু তোমায় দেখতে আসবে তো?"

অসুখ!হ‍্যাঁ আমার গভীর অসুখ।মাথার ভেতর সব তার ঠিকঠাক জোড়া নেই,মাঝেমাঝেই সব বিদ্রোহ করে ওঠে আর আমি তখন গোঁগোঁ করে আওয়াজ করি,হাত পা বেঁকে যায় দিন তিনেক কাওকে চিনতে পারিনা,কিছু বুঝতে পারিনা।ডাক্তার বলেছিলো মেন্টাল স্ট্রেস যেন কখনো না হয়।আপনাকে বোধহয় বাবা দুঃখ করে সব বলেছিলেন।সব।কিন্তু বাবা এটা বলেননি বাকি সময় আমি এক স্বাভাবিক নারী।ভীষণ স্বাভাবিক।আমার ভালোবাসতে ইচ্ছা করে,ভালোবাসা পেতে মন চায়।বিশেষ ভালোবাসা যা আমার বন্ধুরা এ বয়েসে ভরপুর পাচ্ছে ঠিক তেমন।রূপকথা কাওকে কিছু বলেনি।আমিও নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করেছি।পারিনি।আপনি ফিরলেন।ব‍্যস্ততা বাড়লো আপনার।পড়াশোনা বাড়লো।তবু রোজ সন্ধ‍্যারতির সময় ঠিক নাটমন্দিরে আসতেন।

আমি জানতাম ঈশ্বর ভক্তি,আধ‍্যাত্ম চেতনা এসবের ঊর্ধ্বে আপনার সবচেয়ে প্রিয় এই আবহ।তাই যখন আপনার ঘরে ধূপ রেখে যেত নকুলকাকা আপনি ঐ ধোঁয়ার ভেতর স্হির হয়ে বসে থাকতেন।আমাকে কতবার বলেছেন,"জানো ইন্দুলেখা,শরৎ আমার বড় পছন্দ।কবিরা প্রেম বলতে বর্ষা আর বসন্তকে যত গুরুত্ব দিয়েছেন ততটা শরৎকে দেননি।শরৎকালের মতো এত আনন্দ এত শিহরণ আমি কখনো অনুভব করি না।"

-বেশ তো আপনি লিখুন তেমন এক প্রেমের কাব‍্য।

-কি করে লিখি প্রেম যে কিছুতেই ধরা দেয়না আমায়।

আপনার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে তাকিয়েছিলাম।আমি তো সর্বস্ব উজার করে দিয়ে রেখেছি।সে কি আপনি দেখতেই পাননা?ঠোঁট কেঁপেছে,চোখে জল এসেছে ছুটে বেরিয়ে গেছি।দেখতে দেখতে বর্ষা নেমেছে বাড়ি জুড়ে।বৃষ্টিতে ভিজে ঝুপুস হয়ে ফিরলেন।একগোছা চুল কপালের উপর আদরে লেপ্টে ছিল।গরম চা আর মেঘদূত।দূরে থাকা কোনো নারীর বিরহে কেঁপে উঠছেন ভেতর থেকে,আপনার দুহাতের আঙুল বাতাসের শূন‍্যতাকে আঁকড়ে ধরছে।পারলাম না সংযত হতে।বাইরে প্রবল বৃষ্টি,ভেতরেও।আপনার হাতে হাত রাখলাম আলগোছে।হাত ধরলেন না আমার কেবল স্পর্শ টুকু নিলেন।সেদিনের পর আমায় এড়িয়ে যেতে লাগলেন ভীষণ ভাবে।আমিও দূরে রয়ে গেলাম।

শনিবার করে সন্ধ‍্যায় বাগানে বসে আমরা সারা সপ্তাহে কে কোন গল্পের বই পড়েছি তাই নিয়ে আলোচনা করতাম কিন্তু আপনি প্রতি শনিবার বাড়ি যাওয়া শুরু করলেন।রবিবারের জলখাবার থেকে মাছের কচুরি বাদ পড়তে লাগলো।এবার আর প্রথম শারদ উপহার আপনি দিলেন না।ষষ্ঠীর দিন অস্ত্রদানের মন্ত্র উচ্চারণ করছেন গমগম করছে আমাদের বাড়ি।মনে মনে ভেবেছি এবার জিজ্ঞাসা করবোই ঐ উদাস চোখের গভীর আমাকে দেখার সময় যে কথাগুলো জন্মাতো সেগুলো কি?আমি আপনার কে?এবার পুজোয় সাহসী হবো।এদিকে গভীর রাতে দরজায় টোকা পড়লো।মেঝেতে তোশক পেতে রূপকথা ঘুমাচ্ছে।

-ইন্দুলেখা আমি,একবার বাইরে এসো।

আপনি এসেছেন?এতদিন পর!আমি দরজা খুলে বাইরে এলাম।বাইরে আকাশে ফিকে রঙ।দুজন দুদিকে দাঁড়িয়ে আছি।অনন্ত সময় বয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝে।

-আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে ইন্দু।তোমাকে আমি কখনো কোনো ভুল বার্তা দিইনি তবু কেন তুমি আমায় নিয়ে ভাবলে জানিনা।একটা অদ্ভুত বিষন্নতা আমায় ঘিরে থাকে আজকাল।আমি তো কেবল,কেবল...

-দয়া করেছেন তাইনা?

-না দয়া নয় একি বলছো।

-আপনি আর কিছু বলবেন?

-জানিনা তুমি কি ভাবছো তবে আমার মনে হলো তোমাকেই প্রথম বলি,আমি চলে যাচ্ছি।উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে যোগদান করছি।

-বাহ্ জোড়া অভিনন্দন আপনাকে।

আপনি আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু ততক্ষণে আমার মাথার ভেতর আলোর ভেলকি শুরু হয়ে গেছে।ছবির মতো সরে সরে যাচ্ছে বিচিত্র সব রেখা।রূপকথার কাছে শুনেছি আমার প্রবল কাঁপতে থাকা শরীর দুহাতে নিয়ে আপনি চিৎকার করছিলেন।ছুটে এসেছিল সারা বাড়ির লোকজন।চারদিন পর আমি যখন স্বাভাবিক হলাম মা বিসর্জনে চলে গেছেন।নাটমন্দির শূন‍্য,শূন‍্য আপনার ঘর।চলে গেছেন আবার ফিরবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে।আর ফেরেন নি।হয়তো কোনো আশঙ্কা থেকেই ফেরেন নি।

আপনার বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়ে বাবা যখন মাকে বলছিলেন ,"সুস্থ স্বাভাবিক একটি মেয়েকে বিয়ে করে সুখি হতে চাওয়াটা কি খুব অন‍্যায় অরু?তুমি অকারণ মন খারাপ করছো।আমাদের মেয়েকে বিয়ে করে যেচে বোঝা বাড়াবে কেন?তাছাড়া ভেবে দেখো মেয়ের কোনো সর্বনাশ তো করেনি।ভদ্রতার সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছে।সুযোগ তো কিছু কম পায়নি।" আমি শুনলাম।মনে মনে খুব হাসলাম।তাইতো কেন যে ভুলে গিয়েছিলাম আমি স্বাভাবিক নই।আর এও তো সত‍্যি আমার কোনো সর্বনাশ আপনি করেন নি।একটা মেয়ের শরীর ছোঁওয়াটাই বড় সর্বনাশ তা আপনি করেন নি।


ভাববেন না কোনো অভিযোগ জানাতে লিখতে বসেছি।দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর পেরিয়ে গেলো।এবার একবার আসুন।ঘুরে যান।নাটমন্দির,এই শিউলি বিছানো বাগান,আপনার ঘর দীর্ঘকাল অপেক্ষা করছে।একবার আসুন।এখন তো আপনি বিবাহিত কেউ জোর করে আমার বোঝা আপনার উপর চাপাবে না।আসুন একবার।মণ্ডবে মায়ের সামনে মন্ত্রোচারণ করুন শুনি।এখানে কেউ আপনাকে ভোলেনি।সবাই শরৎ এলেই আপনার জন‍্য অস্হির হয়ে ওঠে।আসবেন?

                                ইতি
                                 ইন্দুলেখা

চিত্রঋণ- পারমিতা মন্ডল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন