জলপরি
চিঠিভর্তি প্লাস্টিকের প্যাকেটে ইটের টুকরো বেঁধে জলে ফেলে দেয় তুষার। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। নভেম্বরের এইসময় এদিকে লোকজন প্রায় আসেই না। পুকুরের কালো জলে ডুবে গেল চিঠিগুলো। অপলক জলের বুদবুদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
শান্তাদিদি পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, এক দমে যদি নীচ পর্যন্ত চলে যেতে পারিস, তাহলে জলকন্যার দেখা পাবি।
তুষার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ডুব দিয়েছিল পুকুরে। কিছুটা গিয়েই হাঁসফাঁস অবস্থা। জলের ওপরে উঠে এসে দেখেছিল শান্তিদিদি হাসছে। তার ঝলমলে দাঁত থেকে সূর্যের আলো ছিটকে ছিটকে পড়ছিল জলের মধ্যে।
পারলি না তো! জানতাম পারবি না। একবারে হয় না।
একবারে হয় না মানে? চেষ্টা করলে হবে বলছ?
হবে না কেন শুনি? রোজ প্র্যাকটিস করবি। ঠিক পারবি। শান্তাদিদির দিকে তাকিয়ে তুষার দেখেছিল, তার মুখ থেকে ঝলকে ঝলকে হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল, মিলিয়ে যাচ্ছিল সূর্যের আলোয়। সেও একদিন ঠিক জলকন্যার দেখা পাবে, এই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল তখনই।
তুষার অনেক গল্প শুনেছে ঠাকুমার মুখে। জলের গভীরে থাকে এক পাতালপুরি। সেখানে এক জলকন্যা চুল এলো করে ঘুমিয়ে থাকে সোনার পালঙ্কে। তার মাথায় আর পায়ে থাকে সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি। সেই কাঠিদুটো অদলবদল করে দিলেই ঘুম ভাঙে। অপরূপ সুন্দরী জলকন্যাকে দেখার খুব শখ তুষারের। কাউকে একথা বলতে পারেনি কোনওদিন। পুকুরে স্নান করতে আসার সময় শান্তাদিদিকে কথাটা বলেছিল সেদিনই। শান্তা অবশ্য সাঁতার জানে না। তুষারের মুখে পুকুরে স্নানের কথা শুনে দেখতে এসেছিল। পাড়েই দাঁড়িয়েছিল সারাক্ষণ।
শান্তাদিদিদের বাড়ি কলকাতায়। তুষারদের ঠিক পাশের বাড়িটাই ওর মাসির বাড়ি। মাসিকে শান্তাদিদি ছোটমা বলে ডাকত। শহুরে পরিবেশে থাকে বলে তুষারদের থেকে তার চলনবলন আলাদা। আগে তুষার, নীরূপ, বিমল, আবেশরা অবাক হয়ে শান্তাকে দেখত। তাদের থেকে কয়েক বছরের বড় দিদি। ঝকঝকে দাঁতে কেমন সুন্দর করে হাসে! গালে একটা টোল পড়ে। সারা শরীর যেন মোম দিয়ে তৈরি। শহরের মেয়েদের এইরকমই কোমল হয় শরীর! সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তুষাররা।
গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতে এসে কয়েকদিন এখানে থাকত শান্তা। অন্য সময় এলেও দু-একদিন বাদেই ফিরে যেত। তুষার সেই কদিন আঠার মতো লেগে থাকত শান্তাদিদির সঙ্গে। ওরা আসত সাদা একটা অ্যাম্বাসেডরে। তুষার শুনেছে গাড়িটা শান্তাদিদিদের। তাদের পাড়ায় তখন কারও বাড়িতেই গাড়ি ছিল না। দু-একজনের শুধু স্কুটার ছিল। ওর বাবারও ছিল সেইরকমই আকাশি রঙের একটা স্কুটার। তার গায়ে ইংরেজিতে লেখা ছিল ভেসপা। বাবার স্কুটারটা নিয়ে তুষারের চাপা গর্বও ছিল।
এক রবিবার সকাল সাড়ে নটা নাগাদ গাড়িটা যখন এসে থেমেছিল, জানালা দিয়ে দেখেই তুষার বুঝে গিয়েছিল শান্তাদিদিরা এসেছে। দৌড়ে চলে গিয়েছিল সেখানে। শান্তাদিদির মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়া মুক্তো গড়াগড়ি খাচ্ছিল সবুজ ঘাসের জমিতে। তুষারকে দেখে হাসিমুখে শান্তা বলেছিল, দুপুরে আসিস। অনেক গল্প করব। কালই ভোরে ফিরে যাব তো। বাবার অফিস আছে। আসিস কিন্তু!
তুষার বিকেলের দিকে যেতই ওই বাড়িতে। তার প্রিয় শান্তাদিদি এসেছে, না-গিয়ে থাকা যায়! দুপুরে যেতে বলাতে খুব আনন্দ পেয়েছিল। অনেকক্ষণ গল্প করা যাবে ভেবে খুশি উপচে পড়েছিল তখন। তুষার খুব আশ্চর্য হয়ে ভাবত, শান্তাদিদির ভাইটা কোনওদিন ওদের গল্পে যোগ দেয় না কেন? দূরে দূরে থাকে। দিদিকে ও যেন ঠিক সহ্য করতে পারে না।
পড়াশুনা, স্কুল, এসব কথা বলতে বলতেই আচমকা শান্তা বলে উঠেছিল, তুই রামায়ণ পড়েছিস তাতাই?
দু-দিকে মাথা নাড়িয়েছিল তুষার। না গো। পড়া হয়নি। তবে গল্পটা জানি।
সব গল্প জানিস? সবার? শান্তা কে জানিস?
হ্যাঁ, রামের দিদি। অনেকটা ঘাড় হেলিয়ে জবাব দিয়েছিল তুষার।
আর কিছু জানিস?
অবাক হয়েছিল তুষার। আর কিছু মানে? রামের দিদি হয় শান্তা। এর বেশি আর জানে না সে। তার মুখে ফুটে উঠেছিল না-জানার গ্লানি।
তুষারের ঠাকুমা বলত, ‘শান্তারে নিয়া মহামুনি কিছু ল্যাখে নাই। মাইয়াটার কী হইল, কোথায় গেল, তার কোনও হদিশ দেয় নাই ব্যাটা।’ ওর ঠাকুমা এভাবেই বলত। বাল্মিকী মুনির প্রতি ভীষণ রাগ ছিল ঠাকুমার। কিন্তু কেন যে রাগ, তা বুঝতে পারেনি তুষার। এইসব ভাবনার মধ্যেই শান্তা বলে উঠেছিল, শান্তা এক উপেক্ষিতা নারী, জানিস! বাল্মিকীর রামায়ণে তেমন গুরুত্ব পায়নি।
একটু বলো না শান্তাদিদি, কেন উপেক্ষিতা?
শান্তাকে ওর মাসি-মেসো দত্তক নিয়েছিলেন। ভাব একবার, নিজের মেয়ে, তাকেও মানুষ করার ইচ্ছে হয়নি দশরথের! আসলে কী জানিস, মেয়ে সন্তান তো! তাই তার জন্মে বাবা-মা খুশি হতে পারেননি। মহান রাজা দশরথ মেয়েকে তুলে দিলেন বউয়ের বড় বোনের কোলে। ঠিক আমার মতো!
‘আমার মতো’ কথাটাতে খটকা লেগেছিল তুষারের। কিন্তু অন্য একটা প্রশ্নে সেই খটকা তখনকার মতো চাপা পড়ে গিয়েছিল। ‘শান্তার মা কিছু বলেনি মেয়েকে দিয়ে দেওয়ার সময়?’
না রে। কৈকেয়ী হয়তো কিছুই বলতে পারেননি। তখন মেয়েরা কিছুই বলতে পারত না, তাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে বলে কিছু ছিল না। এখনও অনেকে পারে না।
তুষারের কেমন যেন গুলিয়ে যায়। এখনও মেয়েরা কিছু বলতে পারে না? তার বাবা তো মায়ের সব কথা মেনে চলে! না-মানলে কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে। বরং বাবার কোনও কথাই মা শুনতে চায় না, মানতে চায় না। গুলিয়ে যাওয়া মাথায় ভেসে ওঠে আগের কথাটা, তোমার মতো বলছিলে কেন শান্তাদিদি? তোমার সঙ্গে রামায়ণের শান্তার মিল কোথায়?
দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল শান্তার বুক থেকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, আমার ছোটমা আমার আসল মা। আর যাকে তুই আমার মা-বাবা বলে জানিস, ওরা আমার মেসো-মাসি। এক বছর তিন মাস বয়সে আমাকে দত্তক নিয়েছিল। তখন আমার ভাই সদ্য জন্মেছে। সেই থেকে আমি ওদের কাছেই থাকি। ওদেরকেই বাবা-মা ডাকি। ওরাই তো আমার প্রকৃত বাবা-মা, তাই না? এমনকি শান্তা নামটাও আমার নতুন বাবা-মায়ের দেওয়া। মেসো আর ছোটমা আমাকে বুড়ি বলে ডাকত।
অবিশ্বাসের চোখে শান্তার দিকে তাকিয়েছিল তুষার। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। সেইসময় শান্তা বলে উঠেছিল, শোন তাতাই, এসব কথা আর কাউকে বলিস না যেন! তুই শুধু জানলি, আর কাউকে বলিস না প্লিজ।
না না, কাউকেই বলব না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। তুষার মনে মনেও প্রতিজ্ঞা করে, এমন কথা কাউকে সে জানাবে না। তার শান্তাদিদির গোপন যন্ত্রণার কথা সে একাই জানবে। এই একা জানার মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ অনুভব করেছিল সে।
তুমি তাহলে বাবাকে মেসো বলো কেন?
মেসোই তো আমাকে এই বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল। আগে জানতাম না। যখন জানলাম কে আমার আসল বাবা, তখনও বাবা ডাকতে ইচ্ছে করেনি। ছোটবেলা থেকেই মেসো ডাকি। সেই ডাকটাই রেখে দিলাম। আমি অবশ্য কমই কথা বলি মেসোর সাথে। ইচ্ছেই করে না!
আর তোমার ছোটমা?
ছোটবেলায় মাসিই ডাকতাম। এখানে এলে খুব কাঁদত, জানিস? আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, আমাকে মাসি ডাকিস না মা, ছোটমা বলে ডাকবি। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, মনে আছে। তখন আমার মা বলল, ঠিক আছে শান্তা, ও যখন চাইছে, তুই ওকে ছোটমা বলেই ডাকিস। তখন থেকেই ছোটমা ডাকি।
খাটে শুয়ে কথা বলছিল শান্তা। তুষার বসেছিল তার পাশেই। হঠাৎই উপুড় হয়ে শুয়ে বলেছিল, আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে না তাতাই।
শুধু মাথাতেই নয়, মাথা থেকে সারা পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল তুষার। কখন যে শান্তাদিদি ঘুমিয়ে পড়েছিল, টের পায়নি সে। যখন বুঝতে পারল, তখন ঘুমন্ত শান্তাকে রেখে চুপচাপ চলে গিয়েছিল নিজেদের বাড়িতে। সেবার মাত্রই দু-দিন ছিল। তারপর পুজোর ছুটিতে এসেছিল কয়েকদিনের জন্য। সেইসময় শান্তাদিদির সঙ্গে কতকিছু নিয়েই যে গল্প করেছে প্রত্যেকটা দিন, ভাবলে এখনও ভালো লাগে তার।
একদিন শান্তা জিজ্ঞাসা করেছিল, হ্যাঁ রে তাতাই, তোর গার্ল ফ্রেন্ড আছে?
তুষারের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। তার সত্যিই কোনও গার্ল ফ্রেন্ড নেই। কিন্তু শান্তাদিদি এমন একটা প্রশ্ন করে বসবে সে ভাবতেই পারেনি। শুধু বলেছিল, না না। আমার কোনও গার্ল ফ্রেন্ড নেই গো।
ওমা, লজ্জা পেলি নাকি? গার্ল ফ্রেন্ড থাকা অন্যায় নাকি রে? তুই এখন ইলেভেনে পড়িস। গার্ল ফ্রেন্ড থাকতেই পারে। আমার তো বয় ফ্রেন্ড আছে।
তাই? আমার কিন্তু সত্যিই কোনও গার্ল ফ্রেন্ড নেই।
একদিকে বেঁচে গেছিস। আমি খুব চিন্তায় আছি রে!
কেন গো শান্তাদিদি?
রফিক আসলে মুসলিম কিনা, তাই বাবা মেনে নেবে না। সাফ বলে দিয়েছে।
কোন বাবা?
বোকার মতো কথা বলিস না তো! কোন বাবা আবার? আমার বাবা একটাই। ইনি আমার মেসো। বাবার জায়গা কোনওদিনই দিতে পারব না। এমনভাবে ধমক খেয়ে চুপ করে গিয়েছিল তুষার। আলতো করে পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল, তুমি রাগ করলে শান্তাদিদি? বিশ্বাস করো, আমি সেরকম কিছু ভেবে বলিনি। প্রমিস করছি, আর কোনওদিন বলব না।
খিলখিল করে হেসে উঠেছিল শান্তা। তড়াক করে উঠে বসে তুষারের গালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, তুই খুব ভালো ছেলে রে তাতাই। খুব সরল।
একথায় লজ্জা পাওয়ার কথা নয়। তবু তুষার লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে নিয়েছিল। শান্তা তখন তুষারের মাথাটা টেনে নিয়ে তার বুকের মধ্যে চেপে ধরেছিল। কী নরম বুকটা, হাতের থেকেও নরম, ফোলা ফোলা বুকে মাথা ডুবিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল অনেকক্ষণ। কিন্তু শান্তাদিদি কিছুক্ষণ পরেই মাথাটা দুহাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, এখন বাড়ি যা। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। তোর বাড়িতে চিন্তা করবে না? সেদিন আসার সময় আর-একটা কথাও বলেছিল শান্তাদিদি, তুই আমার থেকে অনেকটাই ছোট রে তাতাই। না-হলে রফিকের বদলে তোকেই বিয়ে করতাম। কথাটা বলে আর দাঁড়ায়নি। তুষারের আগেই নেমে এসেছিল একতলায়।
(২)
বেশ কয়েক বছর আর শান্তাদিদির দেখা পায়নি তুষার। অপেক্ষা করতে করতে প্রায় মাসখানেক পেরিয়ে গিয়েছিল। রবিবার সকালে পড়ার বই সামনে রেখে বসে থাকত সে। মন পড়ে থাকত জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। তার চোখ দেখতে চাইত সাদা রঙের গাড়িটা, তার কান উৎকর্ণ হয়ে শুনতে চাইত সেই পরিচিত গাড়িটার চাকার ঘর্ষণ। থাকতে না-পেরে একদিন গিয়ে ধরল শান্তার ছোটমাকে। অনেকদিন শান্তাদিদি আসছে না কেন গো কাকিমা?
ছোটমা চুপ করে চলে গিয়েছিলেন রান্নাঘরে, কোনও জবাব না-দিয়ে। কাকু পাশের ঘর থেকে ধীরপায়ে এসে বলেছিলেন, তোর শান্তাদিদির খুব পড়ার চাপ তো, তাই এখন আসতে পারছে না। পরীক্ষা হয়ে গেলেই আসবে, কেমন?
হতাশ তুষার ফিরে এসেছিল ঘরে। তারপর কেটে গেছে অনেকদিন। এতদিনে পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা! তাও আসছে না? আবার কি খোঁজ নেবে? কিন্তু কাকু-কাকিমার থমথমে মুখ দেখে আর জিজ্ঞাসা করতে পারেনি কোনওদিন। একদিন সে জানতে পারল শান্তার এখানে না-আসার আসল কারণ। পাড়ার অনেকেই ততদিনে জেনে গেছে।
তখন থেকেই তুষার প্রতি রবিবার পড়তে বসে একটা করে চিঠি লিখত, শান্তাদিদিকে সে তার মনের কথা বলত। কখন যেন সেই চিঠি লেখাও থেমে গেল। একসময় শান্তাদিদি পাতালকন্যার মতো জলের অতলে হারিয়ে গেল। শুধু তার বুদবুদ মাঝে মাঝে তুষারের বুকের মধ্যে গুবগুব শব্দ তুলত।
আপনাকে একবার ম্যাডামের ঘরে যেতে হবে স্যার।
ম্যাডামের ঘরে! কেন?
পেপারসে উনিই সাইন করেন। আর আপনাদের কোম্পানির চেকটাও উনিই দেবেন।
ও। আপনাদের ল্যানের সমস্যাটা মিটে গেছে। আর আপডেটেড ভার্সনের সফটওয়্যার লোড করে দিয়েছি। মিস্টার বাসু সব দেখে নিয়েছেন। কথাটা বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তুষার।
হ্যাঁ স্যার, জানি। বাসু স্যার ম্যাডামকে রিপোর্ট করেছেন। আপনি আমার সঙ্গে আসুন, ম্যাডামের ঘরে।
যে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলছিল, তাকে এত কথা বলার প্রয়োজন ছিল কিনা জানে না তুষার। মেয়েটিকে অনুসরণ করে এগোতে থাকে সে। চ্যাটার্জি ইনফোটেকের কর্মী হিসাবে তুষার এখানে এসেছে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তুষার ভৌমিক কোম্পানির হয়ে ক্লায়েন্ট মিট করে। তাদের কোম্পানির সঙ্গে যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চুক্তি করেছে, তাদের সফটওয়্যারের কোনও সমস্যা হলে চুক্তি অনুসারে কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ার পাঠায়। এই কোম্পানিতে তুষার একেবারেই নতুন। তার পূর্ব-অভিজ্ঞতা আর দক্ষতার জন্য আগের কোম্পানির থেকে বেশি পে-স্কেলে এখানে জয়েন করার সুযোগ পেয়েছে। একে একে নানা ক্লায়েন্ট মিট করছে সে। এই এনজিওতে প্রথম এল তুষার। কাচের দরজা ঠেলে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে, ওনাকে এনেছি ম্যাডাম।
চেয়ার ঘুরিয়ে ম্যাডাম তাকাতেই তুষারের ভেরতটা দুলে উঠেছিল। শান্তাদিদি! বয়স বাড়লেও চিনতে অসুবিধা হয়নি তার।
আসুন মিস্টার রয়। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। শান্তাদিদির চোখেমুখে তাকে দেখে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই বলে অবাক হয় তুষার। দ্রুত ঘরে ঢোকে সে। ইশারায় বসতে বলায় চেয়ারে বসে তাকিয়ে থাকে ম্যাডামের দিকে। ম্যাডাম তখন ড্রয়ার খুলে কিছু কাগজপত্র বের করছেন। তুষারকেও যে কিছু কাগজে সইসাবুদ করাতে হবে, সেদিকে খেয়াল নেই তার।
ম্যাডাম চোখ তুলতেই তুষার বলে ওঠে, আমি তাতাই শান্তাদিদি। চিনতে পারছ না?
তাতাই? শান্তাদিদি? কী বলছেন মিস্টার রয়, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! আপনি কি কারও সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন?
অবিকল সেই মুখ, কানের নীচে কালচে লাল রঙের তিল, সেইরকম মিষ্টি কণ্ঠস্বর! তবে চামড়ার জৌলুস কিছুটা কমেছে বোঝা যায়। সে কি বয়সের জন্য! আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি শান্তাদিদি! মনে মনে ভাবে সে।
আমার নাম পারভিন সুলতানা। আপনি হয়তো কারও সঙ্গে আমার মিল পেয়েছেন। এইরকম হয় মিস্টার রয়। কথাগুলো বলেই হাত বাড়িয়ে দেন ম্যাডাম। আপনার পেপার্স দিন। আর চেকটা রেডি করে রেখেছি, নিয়ে যাবেন। আমি আজ একটু ব্যস্ত আছি। আমাকে এখনই উঠতে হবে। কিছু মনে করবেন না।
যন্ত্রের মতো কাগজগুলো এগিয়ে দেয় তুষার। সইসাবুদ শেষে চেক ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই ম্যাডাম উঠে দাঁড়ান।
আসুন মিস্টার রয়। আজ আমাকে অন্য একটা কাজে বেরোতে হবে। অন্য একদিন আপনার সঙ্গে অনেক কথা হবে। আপনার শান্তাদিদির ব্যাপারে জানতে ইচ্ছে করছে খুব। মুচকি হেসে বলেন পারভিন।
পরবর্তী ক্লায়েন্টের ঠিকানায় বাইক ছোটায় তুষার। মাঝরাস্তায় বুকপকেটে ফোন ভাইব্রেট করতেই বের করে দেখে অফিসের নম্বর। কথা বলে তুষার অবাক হয়, পারভিন সুলতানার প্রতিষ্ঠান চাইছে না সে আর এখানে মিট করুক। অন্য কাউকে পাঠাতে বলেছেন নাকি ম্যাডাম স্বয়ং। তার চাকরি জীবনে এই প্রথম এমন একটা অভিজ্ঞতা হল। বরং আগের কোম্পানিতেও ক্লায়েন্টরা তাকেই চাইত বেশি করে। এই কোম্পানিতেও কয়েকজন ক্লায়েন্ট তাকে খাতির করে খুব। তাহলে কি ম্যাডামকে শান্তাদিদি ভেবে বসায় রেগে গেলেন! কীভাবে অফিসে এই ব্যাপারটা ফেস করবে ভাবতে ভাবতে বাইক চালাতে থাকে তুষার।
(৩)
হ্যালো, আমি কি মিস্টার রয়ের সঙ্গে কথা বলছি? অচেনা নম্বরে মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠ বেজে ওঠে ফোনের ওপারে। রাত তখন সাড়ে নটা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ বাদে একপাক ক্লাবে ঘুরে আসে প্রতিদিন। ক্লাবে যাওয়ার পথেই ফোনটা বেজে উঠেছিল।
হ্যাঁ বলছি। গম্ভীর কণ্ঠ তুষারের। মিস্টার রয় নামে ক্লায়েন্টরা ছাড়া আর কেউ তাকে ডাকে না। অফিসেও তুষার বলেই ডাকে বয়স্ক মালিক। অন্যরা কেউ তুষার, কেউ-বা তুষারদা। তাকে সরাসরি কোনও ক্লায়েন্ট সাধারণত ফোন করে না। অফিস মারফত কাজের কথা জানতে পারে। তাই খানিকটা বিরক্ত হয় সে।
আমি শান্তাদিদি বলছি তাতাই!
ম্যাডামের মুখটাই ভেসে ওঠে প্রথমে। শান্তাদিদি! মানে সেই পারভিন সুলতানা? তাই তো?
হ্যাঁ তাতাই, তুই ঠিক চিনেছিলি। আমি ধরা দিতে চাইনি ওখানে। রফিকের কথা বলেছিলাম তোকে, মনে আছে নিশ্চয়ই। ওর সঙ্গে বিয়েটা টেকেনি রে তাতাই। হয়তো দোষ আমারই। তখন থেকেই আমি পারভিন সুলতানা। এই এনজিওতে আছি বছর ছয়েক আছি। আমি চাইনি আমার অতীত উঠে আসুক। পুরনো জীবন আমি ভুলে যেতে চাই। এভাবেই ভালো আছি।
তুমি কেন আমাকে তোমাদের ওখানে যেতে বারণ করেছ? অভিমান ঝরে পড়ে তুষারের গলা থেকে।
বললাম তো, আমার অতীত ঢেকে রাখতে চাই। নীচু কণ্ঠে জানায় শান্তা।
তুমি বারণ করলে আমি সেসব কথা কাউকে বলতাম না! কিন্তু তার বদলে আমার অফিসে…
এতে তোর চাকরির কোনও ক্ষতি হবে না তাতাই। আমি সেরকম ভাবেই কথা বলেছি। তোর নামে খারাপ কথা বলিনি। শুধু বলেছি, এত অল্পবয়সী কাউকে চাই না আমরা। আমাদের এনজিওর পক্ষে বয়স্ক মানুষই ভালো হবে। আরও কিছু কথা বলার পরে তুষার বলেছিল, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই শান্তাদিদি। তোমার ঠিকানা দাও।
আজ থাক তাতাই। কিছুদিন পরে আমি জানাব। কথাটা বলেই ফোন কেটে দিয়েছিল শান্তাদিদি। তারপর থেকে যখনই সেই নম্বরে ফোন করেছে, শুনেছে সুইচড্ অফ। নিজেও আর কোনওদিন ফোন করেনি শান্তা নামের জলপরি।
মাস দুয়েক পরে ওদিকেই এক ক্লায়েন্টের কাজ সেরে ফেরার পথে মরিয়া হয়ে বাইক থামিয়ে দিয়েছিল তুষার, তরতর করে উঠে গিয়েছিল দোতলায়। ম্যাডামের খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পারভিন সুলতানা প্রায় দেড় মাস আগে লেকের জলে ডুবে মারা গেছেন। পুলিশ জানিয়েছে আত্মহত্যা। বিধ্বস্ত তুষার ফিরে এসেছিল সেদিন।
তারপর থেকে প্রতি রবিবার সারা দুপুর বিছানায় আধশোয়া হয়ে শান্তাদিদিকে চিঠি লিখত তুষার। অফিস ব্যাগের একটা কোণে জমা হত সেগুলো। জমতে জমতে অনেক হয়ে গেছে। এবার নতুন কোম্পানিতে জয়েন করবে সে। এই ব্যাগটা ফেরত দিতে হবে। তাই সে সমস্ত চিঠি বের করে পুকুরধারে এসে বসে। আজ রবিবার। আজও সে চিঠি লিখেছে। হয়তো শেষ চিঠি।
চিঠিগুলো জলের নীচে ক্রমশ ডুবে যেতে থাকে। আকাশভরা তারার মেলা। অর্ধচন্দ্রের আলো এসে পড়ছে পুকুরের জলে। তুষার সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। সে নিশ্চিত, একসময় চিঠিগুলো পুকুরের তলদেশে পৌঁছে যাবে। সেখানে শান্তাদিদি জলকন্যা হয়ে শুয়ে আছে, তার চিঠির অপেক্ষায়।
সহজ সরল অথচ কি ভীষণ গভীর, খুব ভালো লিখেছেন।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো যুগান্তর
উত্তরমুছুনগল্পের বিষয়টি ভালো ছিল।
উত্তরমুছুন