শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সমর্পিতা ঘটক

                              



আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়...


আমরা সেই সর্বনাশের পথেই যাচ্ছি। গুছিয়ে তুলছি চৌহদ্দি, ঘর। উঁকি মারছি পরজীবী পরন্মুখ কীটের মতো... সকল আছে তবু নেই নেই ভাব। আপশোশ, অম্বল দিনরাত। আলো দিয়ে সিলিং সাজাই। মিথ্যে সিলিং। টেক্কা দিই ফ্ল্যাট বি কে। হন্ডা সিটি হাঁকাই, টেক্কা দিই মেজ বৌদিকে। টুকটুকি কেমন আছে জিগ্যেস করাতে উত্তর পাই, ‘এক লাখ তিরিশ পাচ্ছে। কালিকাপুরে ফ্ল্যাট। দিব্য আছে।’ কেমন থাকার উত্তরগুলো কেবল পরিসংখ্যান এখন। ২বি এইচ কে, নাকি ৩ বি এইচ কে! সিটিতে মাইলেজ কত? সিটিসি কত দিচ্ছে? ‘পাপানকে স্কুলে ভর্তি করালে, কত লাগল? আমার তো ৮৬ হাজার লেগেছিল!’

কিছুক্ষণ পর মাথা ভোঁ ভোঁ করে। কিছুদিন পর পর গেজেট বা আসবাব না কিনলে, মোবাইল ফোন না পাল্টালে উদ্বেগ হয়... এই সমাজ আমাকে মেনে নেবে তো! কত কমে বেঁচেছিলাম এই দু বছর প্রত্যেকেই উপলব্ধি করেছি তবু মানুষ যাবেই বানের জলে ভেসে। বানের জল ঢুকেছে সর্বত্র। মেধায়, মননে, রুচি, সঙ্কল্পে... হাহাকার করে পরান... হু হু করে হৃদয়। বইয়ের থেকে বেশি দাম অন্তর্বাসের। কিনতে গিয়ে মনে হয় দু তিনটে বই হয়ে যেত! বিক্রিও অনেক বেশি। তবু পাণ্ডুলিপি তৈরি করি। যত্ন করে অক্ষর সাজাই। যে কলেজে-পড়া বেকার ছেলেটা পুরনো বই কেনে ফুটপাথ থেকে তাকে ঈশ্বরের দূত মনে হয়। ওর ময়লা শার্ট আর কম দামি জিন্সের গায়ে আমি হাজার অক্ষর দেখি। দেখি, ও এখনো পালটায়নি? কীভাবে এখনো রয়ে গেছে অন্য বলয়ে? কান্না পায়, ওই যে উঁচু বট, যেখানে তিনটি নুড়ি রেখে সাধনায় বসে ছিলেন মর্হষি দেবেন্দ্রনাথ, ওখানে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি। খাঁ খাঁ করে চারিদিক। তিন পাহাড় ওই জায়গার নাম। কিছু কান্না রেখে আসি ওখানে। ওইখানটায় সময় থমকে যায়, তারপর চলাচলে ফিরে এলে ঝাঁকের কই হওয়ার সম্ভাবনা তীব্র হতে থাকে। ভেতরের আমিটাকে তখন চেপে ধরের বাইরের খোলস। তবে আমি এখন মনে মনে বাউল হয়ে থাকতে পারি। বিচ্ছিন্ন হয়ে। প্রকৃতি আর অক্ষর সে শক্তি দেয়।  

যার কাছে আমার স্টেটাস যেমন, তেমন উপহার পাই। আসলে উপহার দেখে বুঝতে পারি নিজের স্টেটাস। অদ্ভুত এক সময়! হিজিবিজবিজকে ডেকে এসব গল্প শোনাই। আর তার সে কি হাসি! তার হাসি এমন সংক্রামক আমিও ট্র্যাজেডিকে রূপান্তরিত করে দিই কমেডিতে। উপলক্ষ্য আর উপহার... এসব নিয়ে মগ্ন থাকার বিধান দেয় অনলাইন শপিং সাইটগুলো। কোনটায় কত ছাড়! ছেড়ে দিই পুরনো অভ্যেস। বই উপহার দিলে উপহাস জোটে। কেবল প্রদর্শনী, মনে হয় গ্যালারিতে বসে আছি। আর বন্ধু, পরিজন সব অ্যাম্বাস্যাডার... এক একটা ব্র্যান্ডের। ওদের গা হাত পা জুড়ে স্টিকার। মাথা থেকে পা অবধি... এমনকি পাকস্থলী, হৃৎপিন্ড খুলে দেখাতে চাইলে ওরা দেখাতে পারে দামি মদ, ওদের মা বাবার দামি স্টেন্ট, দামি লেন্স... বুঝতে পারি...

“... কে কাকে ঠিক কেমন দেখে

  বুঝতে পারা শক্ত খুবই

হা রে আমার বাড়িয়ে বলা

হা রে আমার জন্মভূমি!


বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া

  তোমার সাথে ওতপ্রোত

নিওন আলোয় পণ্য হলো

যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।


মুখের কথা একলা হয়ে

   রইল পড়ে গলির কোণে

ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু

ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।”

(মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, শঙ্খ ঘোষ)


মানুষের মতো দেখতে এক একটা ডিভাইস্‌ তারা গুনতে শিখেছে বিল, ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, ট্যাক্স, শেয়ার, আর হিসেব কষে নির্ধারণ করতে পারে নিজের দাম। বিরাট সুড়ঙ্গ ধরেই তাদের যাতায়াত। অ্যাসেম্বল, জোড়াতালি, প্যাকেজিং, তারপর সুড়ঙ্গ দিয়ে নেমে যাওয়া বাজারে। তিন পাহাড়ের গল্পে রবীন্দ্রনাথ এসে গেলে তারা বিরক্ত হয়। আঁতেল ভাবে। তাই সুড়ঙ্গে মুখ ঢোকাই আমিও। কবিতা লিখি, আঁতেলের ছাপ লেগে গেলে আর নেবেনা কেউ দলে। কোন পথে যাব! কবি লেখকদের দলেও গুণ ভাগ যোগ লসাগু গসাগু আছে... সে অঙ্ক কাকেশ্বর কুচকুচে ছাড়া ধরতে পারবেনা কেউ। মুখে তত্ত্ব, ব্রহ্ম, অমৃত আর মনে গিটকিরি প্যাঁচ, কাকে কোন পথে আটকানো যাবে! 

এসব থেকে মুক্তি মেলে অক্ষরে... তখন এক বিরাট আকাশ আমার মাথার ওপরে। সে আকাশ ক্ষুদ্র নয়... খোপ খোপ ভাগ নেই... সেখানে মুক্তি আসে ইচ্ছে মতো। আমার চারপাশে তখন কোনো সুড়ঙ্গ থাকে না। কোনো সংখ্যা, কোনো পরিমাপ কিচ্ছু না। আমি তখন জিতেন মুর্মুর মতো কাদা পায়ে বিরাট জাল ছুঁড়ে দিই পুকুরে। হাসগুলো চই চই করে পাড়ের দিকে আসে। কাঁদা খুঁটে গুগলি ধরে। গেঁয়ো গন্ধ মেখে বসে থাকি, বিচ্ছিন্ন হয়ে। মুথা ঘাস আমার অক্ষর জমিতে। ঘেঁটু, আকন্দ, শিয়ালকাঁটা বাড়তে দিই নির্দ্ধিদায়।

সাবান কেনার পয়সা নেই জিতেনের কিন্তু মাছ ধরে নিয়ে আসে হাসি মুখে, কালো ঠোঁটের পাশে ঝিলিক দেয় আলো... দু চারটে চারাপোনা দিয়ে যায় আমার কলতলায়। কিছুতেই দাম নেবে না। আঁশটে হাতে চা খেয়ে যায়। নিয়ে যায় কুমড়োর ছক্কা আর কষা মাংস। ওর বউ নাকি এমন ভালো রাঁধতে পারে না। ওদের গ্রামে মাচার ওপর বসে ওরা জোয়ার ভাটা দেখে আর গল্প করে যা ইচ্ছে তাই। আলচিকি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলতে পারে ওর ছোটো মেয়ে। মাচার ওপর বসে দেখেছি আমি পায়ের একটু নীচেই নদীর ঢেউ, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ, আর আমার চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আরামের পাতলা বাতাস। আমার সংস্পর্শে বেশিক্ষণ থাকলে ওরাও কি যন্ত্র হয়ে যাবে? ঢুকতে চাইবে সুড়ঙ্গে, বড়ো মোবাইল আর বাকি কত যন্ত্র তো ঢুকে পড়েছে ওদের জীবনেও... তাহলে?


বিরাট প্লাস্টিকের ওপর ছড়ানো ধান পা দিয়ে ছড়িয়ে দেয় ইসমাইলের মা। পাশে বসে থাকে ওর দিদি। বিশেষভাবে সক্ষম সে। তাই বসে বসে দেখে তার চারদিকের জগৎ আর তাড়ায় দানা খেতে আসা পাখি। অপূর্ব সুন্দর সে। চোখের মধ্যে মাণিক জ্বলছিল। ওইরকম চুল আর ত্বক আমি হিমাচলের মেয়েদের দেখেছি। ঠাঁ ঠাঁ রোদে বসে থাকে ও ধানের পাশে।ওকে নিয়ে বোধকরি খানিক বিব্রত ওর বাড়ির লোক। ওদের বাড়ির সামনে বিস্তৃত উন্মুক্ত জমি, সরকার থেকে সেখানে লাগিয়ে দেবে গাছ, খোঁড়া হয়ে গেছে মাটি। ঝাঁকড়া গাছের নীচে বিরাট ডাবায় খড় বিচুলি খাচ্ছে বিরাট সাইজের ধবধবে গরু। দু তিনটে। আমাদের সনাতনী পল্লী চিত্র ফুটে উঠেছে ওইখানটায়। পা নড়ে না ওখান থেকে। সমগ্র ভারতবর্ষ আমি ওই গ্রামের ওই অংশটুকুতেই খুঁজে পেয়ে যাই। ই্সমাইলের দিদিকে দেখে মনে হয় বসে আছে স্বয়ং কমলাসনা কিংবা অবনীন্দ্রনাথের আঁকা সেই ভারতমাতা। যে মন প্রাণ দিয়ে বলতে চায় কষ্টের কথা, বোঝাতে পারে না, যে লুঠেরাদের আটকাতে চায় কিন্তু ওঁত পেতে থাকে উচ্ছিষ্টভোগীরা।

উচ্ছিষ্টভোগী আমরা সবাই। প্রকৃতি থেকে কেবল সরে সরে যাই। আমরা কি অন্য গ্রহের? কেবল পর্যটকের মতো আসি, দেখি আবার নিজের খোলসে ফেরৎ যাই! আর কিছু নিই না। পৌঁছতে পারি না কোনো উৎসমুখে। কেবল ভিড় বাড়াই। বাজারের ভিড়। প্রদর্শনীর ভিড় আর আমরা ম্যানিকিন। খুঁজে নিতে পারি না যা আমাদের নিজস্ব। যা আমাদের আছে। যা নেই তার পিছনে ছুটে মরি। ‘যা ছিল মোর গেল ঘুচে যা নেই তার ঝোঁকে/ আমার ফুরোয় পুঁজি ভাবিস বুঝি মরি তারি শোকে’। বিরাট শোকের মধ্যে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছি আর রুদালির মতো কেঁদে চলেছি নেইয়ের তালিকা হাতে নিয়ে। পকেটভর্তি স্বপ্নের ঝনৎকার নিয়ে হেঁটে যাওয়া কবির মতো কি আমরা বলতে পারব- আমি কিছুই কিনব না!


আমি কিছুই কিনবো না

শহীদ কাদরী


ঢিলে-ঢালা হাওয়ায়- ফোলানো ট্রাউজার, বিপর্যস্ত চুলে

উৎসবে, জয়ধ্বনিতে আমি

ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে, বিজ্ঞাপনের লাল আলোয়

সতেজ পাতার রঙ সেই বিজয়ী পতাকার নীচে

কিছুক্ষণ, একা

নতুন সোনালি পয়সার মতন দুই পকেট ভর্তি স্বপ্নের ঝনৎকার

আর জ্যোৎস্নার চকিত ঝলক আমার

ঝলসানো মুখের অবয়বে

সিনেমায় দীর্ঘ কিউ-এর-সামনে আমি

নব্য দম্পতির গা ঘেঁষে


চারিদিকে রঙ বেরঙের জামা-কাপড়ের দোকান

মদিরার চেয়ে মধুর সব টেরিলিনের শার্ট

ভোরবেলার স্বপ্নের চেয়ে মিহি সূক্ষ্ম সুতোর গেঞ্জি

স্বপ্নাক্রান্ত বালকের হাতেরও অধিক অস্থির রজ্জুতে- গাঁথা রাশি রাশি পুঞ্জ পুঞ্জ লাল, নীল উজ্জ্বল রুমাল

মেঘলোকে মজ্জমান রেস্তোরার দ্বারগুলো খোলা--

আমি অবহেলে চলে যাবো, যাই

আঁধার রাস্তার রানী চকোরীর মতো বাঁকা চোখে দ্যাখে

-আমি কিছুই কিনবো না! ...”



পণ্য ও বিজ্ঞাপনের মাঝে ক্রমশ একা হয়ে যাব। না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে উদ্ধত পতাকার নীচে আমি জড়োসড়, তবু অনন্যর খোঁজে ব্যপ্ত থাকব আজীবন। এটুকুই বলতে পারি। বাকি আর কিছু কি সোচ্চারে দাবি করতে পারব? গোলকধাঁধাঁয় সব একই... “আমি খুজছি, আমি খুঁজছি তোমার ঠিকানা, অলি গলি ঘুরে ক্লান্ত তোমায় পাচ্ছিনা। ... সারি বাধা সব বাড়ি যেন সারবাধা সব সৈন্য, সব এক রঙ, সব এক ধাঁচ তুমি কোথায় থাকো অনন্য?” (মৌসুমী ভৌমিক, অনন্য)। এই আর্তনাদ আছড়ে পড়ে অন্তরে। আর খুঁজতে থাকি। একেবারেই কি পাই না! পাই তো অনন্যকে। আলোর ঝলকানির মতো! তখন চিত্ত ঝলমল করে ওঠে। তারা হয়তো সংখ্যায় কম। তবু আছে এখানেই, আসেপাশে... খুঁজে নিতে হয়... তাই খোঁজ থাকুক নিরন্তর।


চিত্রঋণ- পারমিতা মন্ডল


৩টি মন্তব্য:

  1. সন্মোহিত পর্যটকের মতোই পড়লাম এ লেখা।দারুণ সুন্দর!

    উত্তরমুছুন
  2. প্রাপ্তি আমার। খুব আনন্দ হল এমন সুন্দর প্রতিক্রিয়া পেয়ে। ❤️❤️

    উত্তরমুছুন
  3. পড়ে গেলাম একটানা......কত সুন্দর লেখা ❤❤

    উত্তরমুছুন