শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

                       


মেটামরফসিস 





অবশেষে এক আশ্চর্য ছায়াসম্ভব আলো আমায় নিষ্কৃতি দেয়- বেতস সুষুম্না ভিজে উঠছে স্নানজলে, শৈবলিনী চোখ বুজে সদ্যোজাত তাপে স্বস্তি খুঁজছিলেন অথবা আঁকতে চাইছিলেন। একাই যে পথ পেরিয়ে এলেন এতোদিন, যার শুরু ছিলো যৌথতার প্রতিশ্রুতি দিয়েই, এমনও বলা যায় যৌথতার নিমিত্তেই মন্ত্র দিয়ে গেঁথে যে জীবন নির্মাণের চেষ্টা হয়েছিলো, শুধু কি তার একারই দায় ছিলো তাকে ধারণের? বহমান রাখার ? এমনকী হয়তো শেষ সমাগত, এই শ্বাসেরও? প্রশ্ন আসে না আর। পথ দীর্ঘ হলে তার ক্লান্তি পথিককে গন্তব্য প্রসঙ্গে উদাসীনতা দেয়, যে কোনো দীর্ঘতর দৈর্ঘ্যের এইই সাফল্য। 




খুব সহজ ছিলো না। অনভিজ্ঞ ষোড়শী ছিলেন। সতেরোতে মা, উনিশে দ্বিতীয় সন্তান, তেইশে কাশের রঙে প্রায় সাংবিধানিক স্বীকৃতি। এও এক রহস্য। যে মেয়েটি লাল রঙ ভালোবেসে বড় হলো, আমিষ গন্ধ ছাড়াও যে ভাত মাখা যায়, বিশ্বাস করতে শিখলো না, তার নর্ম সহচর পঞ্চভূতে বিলীনের সঙ্গে সঙ্গে সেই রঙ সেই অন্নঘ্রাণই তার কাছে নিষিদ্ধ, কী করে যে এই ফতোয়া দেওয়া যায়...কই জায়া বিয়োগে তো এমনটি হয় না, এমনকী প্রভু-ভৃত্য পরম্পরাতেও নয়, তাহলে এই অদ্ভুত নীতি শুধুমাত্র এক ব্যতিক্রমে কেন? শৈবলিনী এভাবে ভাবেননি, তার সন্তানেরা ভেবেছিলো। ধ্রুপদী সুন্দর মা'কে বোধ হওয়া ইস্তক শুধুই শুভ্রতায় দেখতে দেখতে তাদের ক্ষোভ এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছিলো বিস্তীর্ণ বাগান আলো করে থাকা জুইঁ আর কুন্দ ঝাড়ের একটি ফুলকেও রোদ্দুর ওঠার পরে গাছে দেখা যেতো না। ঋজু ব্যক্তিত্ব অভেদ্য প্রাচীর হয়ে তার সঙ্গে তার সন্তানদের অনাবিলে বাধা হয়ে থেকেছে বরাবর। মা'কে তারা তাদের হাস্য পরিহাসের অংশে পায়নি কখনো। ভাবতে ভাবতে শৈবলিনী ভিজে ওঠেন ভিতরঘরে। তিনি অপরাধী কি? বিশাল এক জীর্ণ অট্টালিকা, অকালপ্রয়াত স্বামীর অপরিকল্পিত সামান্য সঞ্চয় দিয়ে দুই সন্তানকে যে নারীর একা হাতে 'মানুষ' করে তুলতে হয়েছিলো সত্তরের দশকে, চৈতন্যে পুঁতে দিতে হয়েছিলো অর্থের সঙ্গে আভিজাত্যের কোনো সম্পর্ক থাকে না, থাকে আত্মাভিমানের- এই দর্শন, শুধু সেইই জানে নিরেট গাম্ভীর্য কোনো বর্ম বা মুখোশের মতো আত্মরক্ষার অধিক প্রত্যাঘাতের নাম। এ বাসরে ছিদ্রের অধিকার তিনি দেবতাদের দেননি ফলত দানবেরা অনুপ্রবেশের পথ পায়নি। 



মাটি যে কতদূর ভারী ঠেকলে কেউ স্বেচ্ছায় জলজ হতে চায় শৈবলিনী সেদিন টের পেয়েছিলেন যেদিন তার বাইশ বছরের ছেলে ইণ্ডিয়ান নেভির  নিয়োগপত্র হাতে মায়ের অনুমতি নিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। শৈবলিনী বন্দরের থেকে বেশী বাতিঘর হতে চাওয়ায় সে বাধা পায়নি কোনো। তিনি জানেন, সামান্য বিরোধ প্রত্যাশিত ছিলো মায়ের তরফ থেকে স্বয়মের, অপত্য হলেও সে পুরুষ, যাদের দৃষ্টি বুঝতে তার এক পল মাত্র লাগে। কিন্তু শৈবলিনী বিশ্বাস করেন বিচ্ছেদ তুল্য মায়াবিস্তার কোনো বন্ধনই নির্মাণ করতে পারে না, সুতরাং অবিচল ছিলেন। 



 গত বছর শ্রী'কে সম্প্রদান করেছেন। সেই শূন্যতায় পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে ওঠার আগেই স্বয়ম তাকে জানিয়ে গেলো ঘোর অরণ্যেও প্রতিটি বৃক্ষের একাকী থাকাই বিধি। এখন তার দিলরুবায় অসীম নৈশব্দ্য। অবশ্য এই দেওয়ালেরা প্রগলভতার অভিজ্ঞতা পেলোই বা কখন? বড় শান্ত মেয়ে ছিলো তার শ্রী। মায়ের কাঠিন্য তার নরমে আঁচড়ের অবসর পায়নি কোনোদিন। কথা সে প্রায় বলতোই না। তার আনন্দ অভিমান যে কোনো তরঙ্গের সামান্য সরণ তাকে রেওয়াজে বসাত। সেই সুরই সম্ভবত তাকে নীলাদ্রীর কাছেও পৌঁছে দিলো, ভাবছিলেন শৈবলিনী। যতটুকু তিনি তাকে দেখেছেন, শ্রী যতই অনিন্দ্যসুন্দরী হোক, "রূপে তোমায় ভোলাবো না" এই স্বীকারোক্তির জায়গা অন্তত নীলাদ্রী নন, এইটুকু বুঝেছেন তাই আশ্বস্ত বোধ করছেন। রিপুজয়ের কথা যারা বলে থাকে তারা সম্ভবত প্রথম ইন্দ্রিয়টিকে নিরীহ জ্ঞানে রাখে। অথচ যাবতীয় ভ্রম ও ভ্রমভঙ্গের দায়ভাগ যদি কিছুকে দেওয়া যায় তবে তা 'চোখ'ই। শৈবলিনীর ব্যক্তিগত বিচারে গান্ধারীর অপরাধ অনেক বেশী ধৃতরাষ্ট্রের সাপেক্ষে। জন্মান্ধের অজুহাত যদিও বা গ্রহণীয় কিন্তু সক্ষমের ভাণজনিত বিকার কোনোভাবেই নয়।




বেলা গড়াচ্ছে। স্বয়ম আর শ্রী থাকার সময় বহুসময় তার উনুনের আঁচে কাটতো। রন্ধনশিল্পে বিক্রমপুরের মেয়ের নৈপুণ্যের খ্যাতি মূলত লক্ষ্মীপুজোর ভোগ হেতু পাড়ায় সুবিদিত ছিল। অবশ্য সে এক এমন সময়ের কথা যখন কোনো সংসারের সব ক'টি তৈজস দিনান্তে নিজের আস্তানাতেই থেকে গেছে, এ'ঘটনাকে বিরল মানা হতো। প্রতিবেশীরা শুধু একটি তথ্য জানতো না, একটা সময়ের পর হাজার চেষ্টাতেও শৈবলিনী তার হেঁসেলে আমিষ রাঁধতে পারেননি। এই একটি বিষয়ে ভাই-বোন দুজনেই অসম্ভব জেদে তাকে হারিয়ে দিয়েছে বারবার এবং প্রতিবার। সামান্য বোধের বয়সে পৌঁছে যেদিন থেকে তারা বুঝতে শিখেছে কী এমন অসুস্থ তাদের মা রোজই এমন হয়ে পড়ে যে তাদের রান্না সেরে স্নান করে ভিজে কাপড়ে নিজের জন্য একটা পাত্রে সিদ্ধ ফুটিয়ে নিতে হয় সারাদিনের নামে, তারা সেই সমস্ত কিছুর স্বাদকে অস্বীকার করতে চেয়েছে যাতে মায়ের অধিকার নেই। ফলে শৈবলিনীকেও হার মানতে হয়েছে। আঁশহীন অজস্র প্রণালীতে সেই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করতে হয়েছে। 'ঘাটতি' - সঠিক শব্দ হলো কি? শৈবলিনীর অহং জাগল। কখনো 'ভালোবাসি' শব্দ উচ্চারণ করেনি তার কাছে তার সন্তানেরা। হাজারো প্রাপ্তিতে উচ্ছল হয়নি। সহস্র অপ্রাপ্তিতেও অভিযোগ আনেনি। অথচ তাদের সংবেদন এতো সূক্ষ্ম যে কীভাবে কবে হয়ে উঠলো তিনি কর্তব্যের ভারে ঠাহরই করে উঠতে পারলেন না। পিতৃহীন সন্তানদের সব মা'ই কি পৃথা?



ভাবতে ভাবতে উঠছিলেন, প্রায়োবেশনে স্পৃহা নেই প্রমাণে পুরনো একাহারী অভ্যাসে ফিরতে। সিংদুয়ারের কড়া তাকে বিচলিত করল। প্রাচীন আবলুশ, লোহার ভারী শিকল, নির্জন ছিঁড়তে যথেষ্ট সক্ষম। হতেই পারে আত্মীয় পরিজন অথবা ফেরিওয়ালা কিন্তু নৈঋতে কাকের কর্কশ তাকে অদ্ভুত অসামঞ্জস্য দিয়ে গেলো। এমনটি যেন হওয়ার কথা ছিলো না। আয়ুর প্রথমার্দ্ধে সামর্থ্য, দ্বিতীয়ার্দ্ধে প্রয়োজন তাকে পরিচারকহীন করেছে। সুতরাং কিছু সময় লাগলো জানতে সদর সংবাদ।


-- " একী ! শিয়া তুমি? চিঠি দাওনি তো আজ আসবে... কী হয়েছে? "


বরাবরের ধীর মেয়ে তার বরফ এখনো


--" ভিতরে আসি? "



হাজারো ঝঞ্ঝাতেও যে নন্দিনীকে তিনি অভিভাবকহীন চারণের অনুমতি দেননি বহু শঙ্কায়, অনেক দ্বিধায়, সে আজ আটপৌরেতে তার সামনে দাঁড়িয়ে। চোখের দীঘল বলে ঘুম হয়নি বিগত বেশ কিছু প্রহর, অবিন্যস্ত চুল হাতপ্যাঁচে ঘাড়ের উপর ফেলা। সঙ্গে সামান্য হাতব্যাগটিও অনুপস্থিত। তার বুক বসে যেতে লাগলো চোরাবালির গতিতে।



স্নান সেরে শ্রী ঘুমোতে চাইলে শৈবলিনী জিজ্ঞাসার চৌহদ্দিও পেরোননি। কুম্ভক তার নিয়ন্ত্রণে। ঘুমোক, যতক্ষণ সম্ভব। যে কোনো বিপর্যয়ে এইই বিশল্যকরণি শরীর মনের ভারসাম্য রাখতে। সন্ধ্যায় শ্রী জানিয়েছিলো অতি সংক্ষেপে। মধুপুরের চ্যাটার্জি ফ্যাক্টরি আর সংলগ্ন বাগান ঘেরা বাংলোটি গত রাতে রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়েছে। বোমা, গুলি কিছুই বাদ থাকেনি। বিশ্বস্ত এক সূত্র সামান্য আগে খবর পেয়ে তাদের কাছে লুকিয়ে রাখায় নীলাদ্রি ও শ্রীয়ের প্রাণ দুটি রক্ষা পেয়েছে মাত্র। বাকি সর্বস্ব নিতান্তই ভগ্নস্তূপ এখন। ভোর রাতের প্রথম ট্রেনে শ্রীকে তুলে দিয়ে নীলাদ্রি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে গেছেন অনির্দিষ্ট কাল সময় চেয়ে নিয়ে। বেনারসের আদি বাড়ি অথবা আসানসোলে দাদার কাছে যাবেন, এমন শিরদাঁড়া তার নয়। সুতরাং, তিনি কোথায়, শ্রী জানে না।



কিছু রাত কুরুক্ষেত্রের, কিছু জোনাকির, আর কিছু সংজ্ঞাহীনতার। শৈবলিনী জানতেন না ঠিক কোন স্তরে সে রাতকে ফেলা যেতে পারত। শৈশবে শ্রী'র জ্বর হলে যেভাবে রাতপাহারা দিতেন শিয়রে, ফিরে গেলেন সেই সময়ে। হঠাৎ শিয়ার ঘুমন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে জন্মদাত্রীর অভিজ্ঞ স্নায়ু তাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করল। এই প্রবল অন্ধকারের ভিতরে কি কোনো তীব্র আলোর সংকেত লুকিয়ে যা তিনি অনুমান করছেন? ডাক্তার এসেছিল। ধারণা অভ্রান্ত, আনন্দে জানিয়ে ফিরে গিয়েছিল।  




শৈবলিনী ঠিক তিনদিন আগের মতো, আজও সেই সময় একই ভাবে দাঁড়িয়ে। শুধু সেদিন যে 'নিষ্কৃতি' শব্দোচ্চারণ করেছিলেন, তাকে প্রত্যাহার করছেন আজ সজ্ঞানে। যার লগ্নে সংগ্রাম, এত সহজে কি তার মুক্তি আসে? অনির্ধারিত অজ্ঞাতবাসে যাওয়া নীলাদ্রির আগামীকে গর্ভে ধারণ করে শ্রী এসেছে তার কাছে। তার যাবতীয় ছায়া আজ আলোময়। আজ সত্যিই তিনি সিংহের প্রয়োজন বোধ করলেন, রাশি থেকে খুবলে হৃদয়ে প্রতিস্থাপন নিমিত্তে। সন্তান সংকটাপন্ন হলে কোন গর্ভধারিণী অবিকল সিংহবাহিনী নয় আর তিনি তো শৈবলিনী, গায়ত্রীজল সবিতাকে অর্পণ করে বীজস্বার্থে মহাতেজা রূপ পরিগ্রহ করলেন।

চিত্র - অন্তর্জাল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন