রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মেঘশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

                                    



"পৌন:পুনিক"




…..(১)......


ভয়ঙ্কর একটা ঘূর্ণিঝড়। ভিতরের সমস্ত কিছুকে উথালপাথাল করে দিচ্ছে। বেরোনোর পথ নেই। এদিক থেকে ওদিকে পালিয়ে বাঁচা অসম্ভব, ঝড়টা ধাওয়া করে বেড়াবে। তারপর একসময় তোলপাড় থামবে। করাল গ্রাস খাবলা করে টেনে বের করে আনবে গর্ত থেকে। টং... টং... টং… শব্দ তুলে নিয়ে যাবে মরণের পথে। লাভার মতো গরম তেলে প্রথমে ঝরে পড়বে অবলম্বনহীন বিন্দুগুলো। তারপর গড়িয়ে পড়বে একফোঁটা, দু'ফোঁটা করে সবটা। আবার শোনা যাবে মরণের বাজনা টং… টং… টং…


হাতটা বাড়িয়ে দেয় সোমনাথ। তার মাথার উপর দিয়ে, কানের পাশ দিয়ে আরও অনেকে হাত বাড়িয়ে আছে। তাদের ঘামের গন্ধ আর অসহ্য গরমে বমি পেয়ে গেল। রুমালটা বের করে নাকে চেপে ধরে। এবারও থালাটা অন্য কারো হাতে চলে গেল। রুমাল চাপা অবস্থাতে হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল সোমনাথ। "মেসোমসাই আপনি এখনও পান নি? এই হতচ্ছাড়া রাজু, চোখ কী কপালে তুলে কাজ করিস? বুড়ো মানুষটা কখন থেকে লাইনে আছে। আপনি যান তো, ওখানটায় বসুন গিয়ে, এইবারেরটা রাজু আপনাকে দিয়ে আসবে।" 

আর ক'বছর আগে বুড়ো শুনলে বেশ আঁতে ঘা লাগত। আজকাল সয়ে গেছে। রিটায়ারমেন্টের পরে সিনিয়র সিটিজেনের তকমা এমনিতেই গায়ে এঁটে যায়। তবু বাসে উঠে রিজার্ভড সিটে যুবক দেখলে অনুরোধ করতে পারে না সোমনাথ। আজও হয়তো আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াতে পারত। কিন্তু গা গুলিয়ে মুখ দিয়ে টক জল কাটতে লেগেছে, মাথা ঘুরছে। সুধা সকালেই বলেছিল দু'টি মুখে দিয়ে নিতে। শোনে নি। 


"নাও জ্যেঠু ধোসা আর বড়া। কুড়ি টাকা।" 

খাবারের গন্ধে বমিবমি ভাবটা বেড়ে গেল। বড়াটা খাওয়া কি ঠিক হবে? লোভে পড়ে অর্ডার দিয়ে ফেলেছে। টাকা তো দিতেই হবে। রাজু চলে গেল টাকা নিয়ে। শহুরে রাস্তার ধারে মাথা ঢাকা মাঝারি চত্ত্বরে ঘেঁষাঘেঁষি খাবারের দোকান। আগে খোলাই ছিল ওপরটা। পাশে ছিল দুর্গন্ধময় আবর্জনার স্তূপ! ফিটফাট অভিজাত হসপিটালের পায়ের

কাছে এমন নোংরা ঘিঞ্জি জায়গা যেন দগদগে ঘা। বড় বড় শপিং মলের ফুডকোর্টের ধারেকাছে না এলেও একদিকে দেওয়াল তুলে, মাথা ঢেকে, চেয়ার পেতে মোটের ওপর ভালোই দাঁড়িয়েছে জায়গাটা। ওই জঞ্জালের ঢিবিটাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দু'বছর আগেও এইখানে বসে ধোসা খাওয়ার কথা ভাবতে পারত না সোমনাথ। চা-বিস্কুট, বড় জোর ডিমটোস্ট নিয়ে হসপিটালের উল্টো ফুটে উঠে যেত। 


পকেটটা কেঁপে উঠল। সুধার ফোন। ও এই ছোটো মোবাইলেই ফোন করে। কোনো ঝামেলা হল নাকি? উদ্বিগ্ন হয় সোমনাথ। স্মার্টফোনটা পেকেটেই আছে উপলব্ধি করে নিয়ে স্পিকার অন করে, 

"খেয়েছ?" 

বিরক্ত হয় সোমনাথ, "এটা জানতে ফোন করলে?" 

"না না। বলছি আমার লাঞ্চ অনেকটা বেঁচে গেছে। এত খেতে পারিনি।" 

"ঠিক আছে না পারলে রেখে দাও ট্রেতে। ওরা নিয়ে যাবে", গলাটা যথা সম্ভব নরম করে। ফোনটা কেটে দিয়েছে সুধা। বড়া দু'টো আর খেতে ইচ্ছে করছে না। থালাটা যথা স্থানে নামিয়ে রাজুকে খোঁজে,

"বাবা, একটা ঠোঙা বা কাগজ কিছু দে তো!"

বড়া দু'টো কাগজে মুড়ে ঝোলায় পুরতে পুরতে হসপিটালের দিকে এগোয়। সুধা খুব ভালোবাসে মেধুবড়া। খানিক এগিয়ে একটু ইতস্ততঃ করে। সবে একটা বাজে। বিল হতে হতে চারটে, সাড়ে চারটে। এতখানি সময় হসপিটালের ভিতরে চুপচাপ বসে থাকা। ঝোলায় একটা বই আছে বটে, তবে এসির হাওয়াটা সহ্য হয় না। 


ডানদিক বাঁদিক দেখে নিয়ে উল্টো ফুটে চলে এল সোমনাথ। একটু সামনের দিকে হেঁটে গেলে ব্রিজের নিচে থামের গোড়ায় একটা বেদী মতো আছে। এখানে রোদটা পড়ে না। হাওয়া আসে। ঝোলাটা পাশে রেখে আরাম করে থামে হেলান দিয়ে বসে। দু'পাশের রাস্তা দিয়ে হুস হুস করে গাড়ি যায়, বাসও যায়। মাঝের জায়গাটুকু নিরাপদ। সোমনাথ ছাড়া দ্বিতীয় লোক নেই। নিশ্চিন্তে বইটা বার করে পাতা ওল্টায়। গত মাসের বাসের টিকিটটাই গোঁজা। ব্যাগ থেকে বইটা বারই করা হয় নি আর। পড়তে শুরু করে। একটু পরেই চোখ জুড়িয়ে আসে। 



…….(২)......



"সুনন্দা আজ আসেনি কেন গো?" 

"তা তো জানি না মাসিমা!" মিষ্টি হাসে মেয়েটা। আজ প্রথম দেখছে একে। এই মেয়েটাই খানিক আগে হাতের চ্যানেল করে দিয়েছে। বেশ ব্যথা লেগেছে সুধার। সুনন্দার হাত ভালো। লাগে না। 

"শোনো না, একটু জি বাংলাটা চালিয়ে দাও!"

মেয়েটা অল্প হেসে চ্যানেলটা চেঞ্জ করে দিল। সুনন্দার হাত ভালো হলেও খুব কথা মুখে। যখন তখন বাকি নার্সদের আর রুগীদের ঝাড়ে। অবশ্য সুধার সাথে খুব ভাব। মাঝ বয়স পেরিয়েছে। মুখে-হাতে শ্বেতীর জন্য বিয়ে থা হয় নি। সুধা ওর তিরিক্ষি মেজাজের কারণটা বোঝে। 

"নাম কী তোমার?"

"আশা।"

"বাঃ! সুন্দর নাম। এখানে নতুন?"

"হ্যাঁ মাসিমা"

"বিয়ে থা করেছ?"

"না।" একটু যেন লজ্জা পায় আশা "চ্যানেল করতে গিয়ে আপনার লাগেনি তো?"

"না না!" দু'দিকে ঘাড় নাড়ে সুধা। মিষ্টি মেয়েটার মনে দুঃখ দিয়ে কী হবে! চ্যানেলটা তো হয়েই গেছে। আশা চলে গেল পর্দা টেনে। সুধার উল্টোদিকের ভদ্রলোকের কেমো শুরু হয়ে গেছে। বউ পাশের  টুলে ঠায় বসে। চোখাচোখি হল সুধার সাথে। মুখে ম্লান হাসি। জবাবে সুধা একটু ঘাড়টা কাত করল। এদের সাথে চেনাজানা হয়েছে এই ক'মাসে। ওর নাম কমলা। আসে দুর্গাপুর থেকে। কলকাতায় আত্মীয় আছে। আগের দিন সন্ধে নাগাদ চলে আসে, আবার কেমোর পরে দেরি হয়ে গেলে ওখানেই ওঠে। আজকাল এমন আত্মীয় পাওয়াও ভাগ্যের কথা। কমলার এক ছেলে। মাঝেমধ্যে সেও আসে। বড় মায়া কাড়া মুখ। ওদের মুখেই শোনা, কত দূর দূর থেকে লোকেরা এসে কাছাকাছি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে, শুধুমাত্র হসপিটালে আসা যাওয়ার সুবিধা হবে বলে।



"এখানে কার্টুন চলে না মা? নার্স আন্টিকে বলোনা চালিয়ে দিতে?" পার্টিশনের ওপাশ থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের গলা ভেসে আসছে, "নইলে আমি ছুঁচ ফোটাতে দেব না।" তার মায়ের গলা স্পষ্ট শোনা যায় না, চুড়ির শব্দ আসে। হয়তো হাত নেড়ে চুপ করতে বলছে মেয়েকে। আহা রে! দুধের বাচ্চা! কার কীই বা ক্ষতি করেছে ও! মনটা খারাপ হয়ে যায় সুধার। টিভিতে মিঠাই চলছে। আওয়াজটা খুবই আস্তে। এই এপিসোডটা কাল রাতেই দেখা। তাই ঘটনা বুঝে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না। সময় কাটতে চাইছে না। এখনও ওষুধ দেওয়া শুরু হয় নি। পায়ের ডানদিক বরাবর যে উঁচু বিট দিয়ে ঘেরা জায়গাটা, ওখানেই ফাইলপত্তর চেক হয়। কম বয়সী ডাক্তাররা মেপে মেপে ওষুধ মেশায় ওর লাগোয়া ঘরে। ওখান থেকেই পাউচগুলো চলে যায় খোপে খোপে অপেক্ষায় থাকা মানুষদের কাছে। আরও অনেকক্ষণ এভাবে একা একা শুয়ে থাকতে হবে। মাঝে একবার দুপুরের খাবার আসবে। রান্না এদের বেশ ভালো। মাছের ঝোলটা বিশেষ পছন্দের। শুধু মাছটা বাছতে এখন কষ্ট হয়। গেল বারে যখন কেমো চলেছিল, সোমনাথ বেছে দিত। দুয়েক গাল সুধাও খাইয়ে দিত পর্দার আড়ালে। এখন আর আসে না সোমনাথ। সুধা নিয়মমাফিক ফোন করে লাঞ্চের সময়। তবু আসে না। লোক বলতে শুধু মাঝমাঝে আশা আসবে, ড্রিপ শেষ হলো কিনা দেখে যাবে। এত ডাক্তার, এত রোগী, এত নার্সের মাঝে কেমন একা লাগে সুধার। একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে।



…..৩…..



'তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও

সে ঘুম আমার রমণীয়….'

ফোনটা সুর করে বেজে উঠল। সুধার বড় প্রিয় গান। টিম্পল সেট করে দিয়ে গেছে। বড় ফোনে মানে ওই ফোন করছে। তন্দ্রা ভাবটা এখনও কাটে নি। সবুজ তীর চিহ্নটা দু'তিনবার ঠেলেও উপরে তুলতে পারল না সোমনাথ। কেটে গেল। টিম্পল কল ব্যাক করে নেবে। স্মার্টফোন থেকে ফোন করাটা রপ্ত হয়নি এখনও। আঙুল লেগে ভুলভাল নাম্বারে চলে যায়। ওলা বুক করাটা দায় পড়ে কিছুটা শিখেছে। টিম্পল ডায়রিতে ছবি এঁকে, স্টেপ বাই স্টেপ লিখে বুঝিয়ে গেছে। ডায়রিটা ঝোলাতেই রেখে দেয়। সকালবেলা হসপিটালে আসার সময়ই হোক বা সন্ধেবেলা ফেরার সময়, ট্যাক্সি পেতে ভারি মুস্কিল হয়। গতবারে তখনও ওলাটোলা ওঠেনি, আর সুধার শরীর-স্বাস্থ্যও মজবুত ছিল, তবু এই ট্যাক্সি পেতে কী হয়রানিটাই না গেছে! কেমো না হয় তাও মাসে একটা। রেডিয়েশনের সময় পাঁচদিন টানা আসতে হত। কলকাতার বাইরে যেতেই চায় না। কেউ কেউ রাজি হলেও আবার অন্য বায়না। মিটারে যাবে না, ভাড়া চাইবে আকাশ ছোঁওয়া! এ তবু মন্দের ভালো। একটু ঠিকঠাক করে স্টেপগুলো ধরে ধরে বুকিংটা করে ফেলতে পারলেই গাড়ি একদম এখান থেকে তুলে দোর গোড়ায় নামিয়ে দিয়ে আসবে। এক পয়সাও বেশি দিতে হবে না। 


'তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম…'

এবারে একেবারেই ফোনটা ধরে ফেলে, "হ্যাঅলো…"

"হ্যাঁ বাবা! সব ঠিক আছে তো?" 

"হ্যাঁ।"

"কেমো শুরু হয়ে গেছে?"

"এতক্ষণে তো শুরু হয়ে যাওয়ার কথা।"

"ও… তুমি মায়ের কাছে নেই?"

একটু অপ্রস্তুত হয় সোমনাথ, "না… ওখানে ছোট জায়গা… ভিড়ভাট্টা...আর বড্ড ঠান্ডা!"

"হুম...! ঠিক আছে। তোমাদের হলে আমাকে একটা খবর দিও।"

"আচ্ছা দেব।"

"আজ ক্যাব বুক করতে অসুবিধা হয়নি তো?"

"না না। আমি তো শিখে গেছি এখন।"

"বেশ… গাড়িতে বসে না হয় আমাকে ফোন কোরো একটা।"

"করব।"

ফোনটা যত্ন করে পকেটে পোরে। টিম্পলের গলাটা একটু যেন বিষণ্ণ শোনালো। রেগে গেল? নাকি অফিসে কোনো ঝামেলা? হয়তো বা মায়ের জন্য মনটা খারাপ! পুনেতে চাকরি। কাছে থাকতে পারে না। দূর থেকে যতটা করা যায়, তার বেশিই করার চেষ্টা করে। তবু একেক সময় সোমনাথের মনে হয় একটা ছেলে থাকলে সাহারা হতো। এত ছোটাছুটি, বাজার-দোকান, সুধার খেয়াল রাখা - ভারি ক্লান্ত লাগে সোমনাথের। তারপরেই ভাবে, ছেলেরাও তো আজকাল চাকরি নিয়ে মাকুর মতো এপাশ ওপাশ ঘুরছে। ঘরে থেকে সরকারি চাকরি-বাকরি আর পাচ্ছে ক'জন! 


বইটা মুড়ে ব্যাগে পোরে। দু'পাশের রাস্তা ধরে অবিরাম গাড়ির স্রোত একটু স্তিমিত। যেন একটু ভাতঘুম দিয়ে নিচ্ছে। দোকানগুলো ঝাঁপ ফেলে ঝিমোচ্ছে। আবার বিকেল থেকে চায়ের তোড়জোড় শুরু হবে। আইসক্রিমের ঠেলাটার হাতল নামানো। লোকটা ফুটপাতেই গামছা পেতে শুয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে ফাঁকা রাস্তায় রুটের বাসগুলো যুমদূতের মতো ছুটে এসে খানখান করে দিচ্ছে দুপুরের আলসেমি। দূরে ওই ফুটে কতকগুলো মজুর ঝালাইয়ের কাজ করছে। এই ব্রিজটা এখনও গোটাটা তৈরি হয়নি। হলে এর ওপর দিয়ে মেট্রো চলবে। মেট্রো একবার চালু হয়ে গেলে যাতায়াতের আর অসুবিধা থাকবে না। কিন্তু সে হতে হতে তো অনেকদিন! ততদিনে কী আর সুধা… চোখটা ঝাপসা হয় এলো। একটা হিমেল হাওয়া হঠাৎ করে ঘিরে ধরল। রুমাল দিয়ে চশমাটা মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায় সোমনাথ। বেলা পড়ে এসেছে। বিলের তদারকি শুরু করে দেওয়াই ভালো। 



…….৪……..



ফোনটা কেটে দিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল টিম্পল। ওর ডেস্ক থেকে আকাশ দেখা যায়। নানা মাপের, নানা রঙের মেঘ ভিড় করে। আজ কালো মেঘের পালা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। টিম্পল দেখবে তাকিয়ে তাকিয়ে। সবটা দেখবে। মেঘ ডাকলে আওয়াজ শোনা যাবে। বাজ পড়লে আলোর ঝলকানি কাচ চিরে ওর ডেস্কের উপর নেমে আসবে। আম্রুবাঈ অথবা তারাবাঈ হয়তো পর্দা ফেলতে আসবে। টিম্পল মানা করে দেবে। কালো মেঘ সমস্ত অভিমান উজাড় করে দিয়ে ভীষণ কাঁদবে। অভিযোগের ঝুলি ফুরিয়ে গেলে দূরে চলে যাবে, অনেক অনেক দূরে। আকাশ আবার নিজের রং ফিরে পাবে। এই সমস্তটা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে টিম্পল, শুনবেও, শুধু বৃষ্টিটা গায়ে মাখতে পারবে না। কালো মেঘের সাথে গলা জড়াজড়ি করে দূরে পাড়ি দিতে পারবে না। সামনে কফির কাপটা এখনও ধোঁয়া ছাড়ছে। আর বেশিক্ষণ হয়তো পারবে না। টিম্পলের হুঁস নেই। মেঘের মধ্যে কী যেন খুঁজে বেড়ায়! যক্ষ যেমন বার্তা পাঠিয়েছিল যক্ষিনীকে, টিম্পলেরও বড় ইচ্ছে করে মা'কে এক পশলা বৃষ্টি পাঠায় মেঘের হাত দিয়ে। আগে উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রথম বৃষ্টিটায় কী ভেজান ভিজত তিন জনে। কিন্তু মা আর আগের মতো বৃষ্টি মাখতে পারে না! একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়। বুকে সর্দি জমে যায়। 


প্রিং… একটা ইমেইল ঢুকল। কোনো ইস্যু বোধহয়! একেবারেই দেখতে ইচ্ছে করছে না। চোখকে অনেক কষ্টে বাগে এনে মনিটারের দিকে তাকায়। ইনবক্স খোলে। বারবার পড়ে যায় একই ইমেইল। কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না। 

"কম সে কম কফি তো পিলে! ঠান্ডি হো গ্যায়ি ইয়ার!" কাবেরী কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করে নি। একটু হেসে কাপে চুমুক দেয় টিম্পল।

"তো ফির ক্যা চল রহা হ্যায়? এইচ.ওয়ান.বি. ভ্যর দি?"

"নেহি। ম্যায় নেহি ভরুঙ্গি!"

"তু পাগ্যল হ্যায় কেয়া? লাভন্যনে বোলা হ্যায় সাবকো ভরনা হ্যায় ইয়ার!"

"ম্যায়নে উসে কহে দিয়া হ্যায়, ম্যায় নেহি জানা চাহতি হুঁ বাহার।"

"আরে ফির ভি ভ্যর দেতি! লটরি ভি তো হোনি থি… কউনসা সবকো ভেজ দেতে!"

মৃদু হাসে টিম্পল। কাবেরী মেয়েটা বেশ! সবসময় হাসিখুশি। সবার সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে তাড়াতাড়ি। টিম্পল পারে না। কাবেরী চলে যেতেই ইমেইলটা আবার পড়তে শুরু করে। মাথাটা একটু পরিষ্কার হয়েছে। পিয়ার রিভিউয়ে কিছু কসমেটিক ডিফেক্ট ধরা পড়েছে ওর কোড সেগমেন্টে। ব্যাপারটা গুরুতর কিছু না। টাইপো গোছের। কিন্তু এটা নিয়ে লেবু কচলানো চলবে কিছুদিন। ডিপি, টিম লিড, প্রজেক্ট ম্যানেজারের সাথে দফায় দফায় মিটিং হবে। কেন ভুল হল, তার কারণ দেখিয়ে ইনোভেটিভ কিছু উত্তর দিতে হবে। অবশেষে রায় বেরোবে, ডিপির কুতকুতে চোখে হাসি ফুটবে, পি. এমের ভ্রূকুটি গভীর হবে। মশা মারতে কামান দাগা। যত্তসব!


কিছু কাজ এখন সেরে নিলে ভালো হত। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। বেরোতে বেরোতে সেই ছ'টা-সাতটা বাজবে। ইমেইল যখন এসেছে কিছু তো রিপ্লাই করতেই হয়। আর একটু দেরি হলেই বা কী ক্ষতি! এই সময়ে কিছু টিমের ক্লায়েন্ট কল থাকে। তাই উইংটা ফাঁকা ফাঁকা। এরপর কম্প্লিমেন্টরি স্ন্যাক্স খেতে যাবে বেশিরভাগ লোক। টিম্পলকেও ডাকতে আসবে কেউ কেউ। ও যাবে না। আরেক কাপ কড়া কফি খুব প্রয়োজন। ক্যাফেটেরিয়ার পিছনের দরজা দিয়ে নেমে গেলে একটা ছোট বারান্দা। এখান থেকে আকাশটা আরেকটু কাছে চলে আসে। অন্য সময় এমপ্লয়িরা এখানে সিগারেটে সুখটান দিতে আসে। এই সময়টা ফাঁকা থাকে। এই একাকিত্বটুকু খুব উপভোগ করে আজকাল।



…...৫……



উঠতে গিয়ে মাথাটা কেমন টাল খেয়ে গেল। বুকটা ধড়ফড় করছে। আজকাল প্রায়ই এইরকমটা হচ্ছে। বাড়িতে বললেই ডাক্তার দেখানোর জন্য জোরাজুরি করবে। এসব ঝামেলা আর ভালো লাগে না। তার চেয়ে একেবারে পড়ব আর মরবই ভালো! ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হসপিটালের দিকে এগোতে গেল সোমনাথ। একটা টান পড়ল। ফ্যাচ করে একটা আওয়াজ। ছিঁড়ল নাকি? ব্যাগ না বলে থলে বলাই ভালো। কাপড়ের ঝোলা। বহু বছর আগে শান্তিনিকেতন থেকে কেনা। সুধাই জোরাজুরি করেছিল। রং হালকা গেছে। টিম্পল অনেকবার বলেছে পাল্টে নিতে। চামড়ার আধুনিক একটা ব্যাগ, আরেকটা পিঠে নেওয়ার ব্যাগ দিয়েও গেছে। কিন্তু ওগুলো ব্যবহার করতে ভালো লাগে না। এই ব্যাগটার উপর একটা মায়া পড়ে গেছে। গেলবার যখন সুধার অপারেশন হল তখন প্রথম প্রথম লোকে ভরে যেত হাসপাতাল। সীমিত দু'ঘন্টায় বাড়ির লোকের সাথে দেখা হওয়া কঠিন হয়ে উঠত। তারপর শুরু হল কেমো, রেডিয়েশন, রুটিন চেক-আপ। ধীরে ধীরে লোকজনের ভিড় কমল, টিম্পলকেও কাজের জায়গায় ফিরতে হল। তারপর বিলে সই করানো, প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট নিয়ে ছোটাছুটি আর অফিসে দফায় দফায় বিল জমা দেওয়া, আর টাকার তাগাদা - এই সব কিছুর মাঝে সোমনাথ একা পড়ে গেল। সঙ্গী বলতে শুধু এই ঝোলাটা। ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে বসে অপেক্ষা করার সময় অথবা এই কেমো থেরাপির দীর্ঘায়িত দিনগুলোতে যখনই অসহায় লেগেছে, থলেটাকে বুকের কাছটায় আঁকড়ে ধরেছে সোমনাথ। প্রতিবার মনে হয়েছে যেন সুধা হাত রাখল বুকটায়। 


এক আঙুল সমান একটা খোঁচ উঠেছে। তাপ্পি মেরে একটু সেলাই করে নিলে আরও কিছুদিন চলে যাবে। খানিক নিশ্চিন্ত হয়। যেন পুরোনো বন্ধুর বদলির দিন পিছিয়ে গেছে। আরও কটা দিন সুখে-দুঃখে পাশে থাকবে দু'জনে। খোঁচটার উপর আঙুল বোলাতে বোলাতে হসপিটালের দিকে পা বাড়ালো সোমনাথ। কেমোর ওখানে যাওয়ার আগে একবার ফার্মাসিতে যেতে হবে। কিছু কিছু ওষুধ আছে,  যেগুলো শুধু এখানেই পাওয়া যায়। ঢোকার মুখে গার্ডটা কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। একটু অস্বস্তি হল। কোমরের নিচে  জামাটার শেষ প্রান্ত ধরে টান দিল অজান্তে। কোঁচ খাওয়া জায়গাগুলো এক মুহূর্ত টানটান হয়ে, পর মুহূর্তেই আগের মত কুঁকড়ে গেল। যেন তাদেরও মালিকের মত ভারি লজ্জা করছে। ব্যাগের ছেঁড়া জায়গাটায় হাত চাপা দিয়ে দরজাটা পার করল সোমনাথ। এতো আর তাদের আবাসেনের সিকিউরিটি গার্ড নয়। এরা সমান তালে বাংলা আর ইংরিজিতে কথা বলতে পারে। এদের ফিটফাট পোষাক-আষাকের সামনে কুঁচকানো আটপৈৌরে সার্ট-প্যান্টে নিজেকে কেমন খেলো মনে হয়। মনে হয় সঙ্গে একটা কেউ থাকলে বেশ ভরসা পাওয়া যায়। 


ফার্মাসিতে ঢোকার মুখে প্রচন্ড ভিড়। ভিতরে গাদাগাদি হলেও বাইরে এতটা ভিড় ভিজিটিং আওয়ার্স ছাড়া বড় একটা দেখা যায় না। এরই মধ্যে সোমনাথ একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করল। ভিড় আছে বটে, কিন্তু বেশিরভাগ লোকেরই এগিয়ে যাবার তাড়া নেই। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি মারছে। ভিড় ঠেলে এগোতে খুব বেগ পেতে হল না। দেখল দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা আছে ফার্মাসির সামনেটা।

"কী হচ্ছে ভাই এখানে?" 

"স্যুটিং হচ্ছে। দেখছেন না ক্যামেরা? রাইমা এসেছে।"

তাই বটে। ক্যামেরা দাঁড় করানো আছে দরজার কাছটায়। কতগুলো কম বয়সী ছেলেমেয়ে ব্যস্ত হয়ে ফার্মাসির মধ্যে ঢুকছে, বেরোচ্ছে বারবার। কাচের দরজার ভিতরে যতটুকু দূর থেকে নজর যায় তাতে বোঝা যাচ্ছে খুব ফাঁকা নয়। বাইরের ক্যামেরার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। সামনেও নেই। রাইমা বোধহয় ফার্মাসির ভিতর। একটা ছেলে ওইদিকের ভিড় ঠেলে দূরে সরাচ্ছে। তার মানে স্যুটিং হচ্ছে না, এবার শুরু হবে। কিম্বা হয়তো রি-টেক হবে। একসময় সিনেমা পাড়ায় কিঞ্চিৎ ঘোরাঘুরি করেছে সোমনাথ। এক লতায় পাতায় মামা ছিলেন নামকরা ক্যামেরা ম্যান। বেশ কিছু বিখ্যাত ছায়াছবির স্যুটিং হতে দেখেছে তার দৌলতে। সে সব কী দিনই না ছিল! এখন স্যুটিং দেখার আগ্রহ তার বিন্দুমাত্র নেই। শুধু ওষুধটা নেওয়া যাবে না, এটাই আক্ষেপ। ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে কারসিনোমা বিল্ডিঙের দিকে পা চালালো দ্রুত। 



….… ৬…….



সন্ধের ছায়ায় বিকেলটা নিজেকে বিলিয়ে দিতে দিতে ক্রমশ: মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে। গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার। একটা দু'টো করে তারা ফুটছে আঁধারের গায়ে। বড় রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। আটতলার উপর থেকে ক্যাম্পাসে চলাফেরা করা মানুষগুলোকে কত ছোট ছোট লাগে। ওই প্রতিটা ক্ষুদে মানুষের নিজস্ব একটা গল্প আছে, অথবা একটা অসমাপ্ত উপন্যাস। অথচ সারাদিন সবাই কম বেশি একই রকম আচরণ করে। সকালে অফিস, সারাদিন কাজ, আড্ডা, কফি, লাঞ্চ, মিটিং। তারপর হয়তো বাড়ি ফিরে ঘরের কাজ, নিউজ দেখা, ছেলেমেয়ের পড়াশুনা, পরিবারের সাথে নৈশ ভোজ সেরে শুয়ে পড়া। এই সময়ে উপন্যাসটা আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। সবার অজান্তে আরেকটা গোটা দিন যোগ হয়ে যায় ফাঁকা পাতায়। 


রেলিঙে ভর দিয়ে সামনে অনেকটা ঝুঁকে পড়ে কফিতে চুমুক দেয় টিম্পল। কাপটা কাত করে একটুখানি কফি ঢেলে দেয় নিচের দিকে। পড়তে পড়তে কোথায় যেন হারিয়ে গেল তরলটা। অনেকক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। মাটিতে পড়াটা দেখতে পেল না টিম্পল। একটা অজানা ভয়ে রেলিঙের কাছ থেকে সরে এলো। উপরে তাকাল। মেঘ কেটে গেছে। আকাশের গায়ে তারারা পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়ে খুশিতে ঝলমল করছে। ওই তারাদেরও কি নিজস্ব গল্প আছে? ছোটবেলায় শুনত, কেউ মারা গেলে নাকি আকাশে তারা হয়ে যায়। আর তারারা যখন টিমটিম করে, তখন আসলে ওরা চোখ টিপে টিপে বাড়ির লোকেদের সাথে কথা বলে। তখন এইসব গল্পে বিশ্বাস করত। আজ এত বছর পরে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খুব ইচ্ছা করছে আবার বিশ্বাস করতে। 


ফোন বাজছে। বাবার ফোন। একটু সময় নিল টিম্পল। অজান্তে চোখের কোলে জল জমেছে। গলাটা কখন ধরে এসেছে। একটা লম্বা চুমুকে অনেকটা কফি গিলে নিল, "হুম… হয়ে গেছে?"

"হ্যাঁ! গাড়ি পেয়ে গেছি। তোর মা ঠিক আছে।"

"আচ্ছা। দাও মাকে।"

"হ্যালো…"

"শরীর ঠিক লাগছে তো?"

"হ্যাঁ! ভালো আছি। ড্রাইভার ছেলেটি খুব ভালো।"

"তাই?"

"হ্যাঁ! হাওড়ায় অনেকবার গেছে বললো।"

ফিক করে হেসে ফেলল টিম্পল, "আচ্ছা বেশ। সাবধানে পৌঁছে জানিও একবার।"  

সারাদিনে এই প্রথম হাসল। মা এত সাদাসিধে! গাড়িতে উঠতে না উঠতেই এত কথা জেনে ফেলেছে।

সবাইকে এত সহজেই বিশ্বাস করে বসে। টিম্পলের মনে কাল থেকে যে অপরাধবোধের গুমোট, মায়ের গলা শুনে তা দ্রুত মিলিয়ে যেতে লাগল। মায়ের কথায় অভিমানের রেশ মাত্র নেই। অথচ টিম্পল… স্নেহ সততই নিম্নগামী। 


কফিটুকু তাড়াতাড়ি শেষ করে নিজের কিউবিকলে ফিরে এলো। মনিটরের সামনে একটা পেনসিল রাখা। টিম্পলের নয়, কেউ রেখে গেছে। এই উটোকো ঝামেলাটা কিছুদিন হলো শুরু হয়েছে। আজ পেন তো কাল ইরেজার, পরশু মার্কার! টিম্পল সবকিছু পাশের কিউবিকলে ঠেলে দেয়। গায়ত্রী চলে যাবার পর থেকে জায়গাটা খালি পড়ে আছে। যে পাঠাচ্ছে সে নিশ্চয় দেখতে পাবে ওগুলো কোথায় রাখা। ইচ্ছে হলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। এসব ফালতু ব্যাপারে সময় নষ্ট করার মানসিক অবস্থা এখন টিম্পলের নেই। তবু অভ্যাস বশে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। পুরো উইঙে গুটি কয়েক মাথা কেবল সামনের স্ক্রিনের সাথে আটকে আছে। এদের মধ্যে কেউ? 


বড্ড আলো চারপাশে। কফি খেতে খেতে যে রহস্যময় অন্ধকারটা জাপ্টে ধরছিল, তা এক নিমেষে উধাও হয়ে মাথাটা দপদপ করতে লাগল। স্ক্রিন অন করে আরেকবার ইমেইলটায় চোখ বোলায়। একটা রেসপন্স তো করতেই হয়। বাকি কাল যা হবে দেখা যাবে। তার আগে দু'টো জরুরি কাজ সেরে নেওয়া দরকার। পোর্টালে একটা ছুটির দরখাস্ত দিতে হবে আর একটা টিকিট কাটতে হবে। এ মাসের শেষে ছুটি অ্যাপ্লাই করবে ভেবেই রেখেছিল। কিন্তু এই ডিফেক্টের জন্য ম্যানেজার বেঁকে বসতে পারে। তবু ছুটি নিতেই হবে। মনে মনে তারিখটা হিসাব করে নিয়ে ইন্ডিগোর সাইটটা খুলে বসে। 



…….. ৭ ……..



পাঁচিলের গা ঘেঁষে পেয়ারা গাছটা ডালপালা মেলে  দাঁড়িয়ে আছে। পাশের কম্পাউন্ডের গাছ। দু'টো কাঠবিড়ালি তিরতির করে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। ওদের বাসায় একটা ছোট্ট কাঠবিড়ালি আছে। যেন একটা লালচে রঙের মাংসপিন্ড! এখনও গায়ে লোম ওঠে নি, ডোরাকাটা দাগ নেই। মাঝেমাঝে সেও বাবা-মায়ের পিছনে ছোটাছুটি করে। এই গাছটায় টিয়াপাখি আসে, আরও কত রকম পাখি। সব টিম্পল চেনেও না। গাছে প্রচুর ফল হয়। আশ্রিতরা ঠুকরে খেয়ে শেষ করতে পারে না। কত পেয়ারা পেকে গিয়ে ঝরে পড়ে। কেউ তোলে না। এক বুড়ো-বুড়ির বাস ওখানে। ওদের ছেলেপুলে নেই। বেশি বেরোতে দেখা যায় না। তবে উঠোনে জামাকাপড় শুকোয়, সন্ধে থেকে ঘরে টিমটিম করে হলদে আলো জ্বলে। 


শুনেছে ওই কম্পাউন্ডে খুব শিগগির ফ্ল্যাট উঠে যাবে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। চোখ মেললেই এত সবুজ আজকাল আর শহরের বুকে দেখা যায় না। তাছাড়া ফ্ল্যাট উঠলে ওদের জানলাটাও ঢাকা পড়ে যাবে। এত আলো-হাওয়া আর ঢুকতে পারবে না। তবু টিম্পলের সবচেয়ে বেশি মন কেমন করে পেয়ারা গাছটার জন্য। ওটা তো শুধুই একটা গাছ নয়। ওকে আঁকড়ে বেড়ে উঠছে কতগুলো জীবন। কোমরটা জড়িয়ে ধরে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে দেয় টিম্পল। বই পড়তে পড়তে মেয়ের মাথায় বিলি কেটে দেয় সুধা। খোলা অবস্থায় বইটা নামিয়ে রাখে মেয়ের পিঠে। আজকাল এক হাতে ভারি বই বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। এবারে বারো দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে মেয়ে। শনি-রবি ধরলে মোট ষোলোদিন কাছে থাকবে। কতদিন বাদে এত লম্বা ছুটি পেল। চেহারাটা কী মলিন লাগে আজকাল। একা হাতে সব কাজ। যত্ন-আত্মি পায় না। চুলগুলোয় তেল পর্যন্ত পড়ে না। জটের পাহাড় হয়েছে যেন।


"কী কী আনতে হবে বলো, বাজার যাচ্ছি।" গোটা তিনেক বাজারের ব্যাগ এহাত-ওহাত করতে করতে ঘরে ঢোকে সোমনাথ।

"একটা কাঁচি এনো তো, এর চুলগুলো সব কেটে দেব। ক'দিন পরে এমনিই সব পড়ে যাবে", মায়ের কথা শুনে পিঠের অগোছালো চুলগুলো তড়িঘড়ি সামনে টেনে এনে পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলল, যেন মা সত্যি সত্যি কেটে দেবে। সোমনাথ গলার মধ্যেই একটা হাসির আভাস দিয়ে আবার বলল,

"লিস্ট আছে কিছু?"

"একটু গোবিন্দভোগ চাল এনো, কাল মুড়িঘন্ট করব। আর সব্জি যা যা পাবে। পেঁয়াজটা একটু বেশি তুলো।  আর শোনো মাছের তেল আনবে মনে করে, কেষ্টকে বলবে যেন তেতো না হয়। আর লোটে মাছ পেলে এনো।"

"তেল তো থাকে মাছের পেটে, কেষ্ট কী করে জানবে তেতো কিনা!" 

"ওরা ঠিক বুঝতে পারে মাছের পেট টিপে। আর কী কী খাবি বল, দানাদার আনাবো?" 

সুধার মুখটা একটু ক্লান্ত, একটু শীর্ণ। কিন্তু এক অপার্থিব প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে। যে হাতটা মাথায় বোলাচ্ছে সেটা বেশ ফুলে আছে। মাঝে মাঝেই হয় এমন। আর অন্য হাতটা রোগা, শুকিয়ে এসেছে। এই মুহূর্তে দুটো হাত আলাদা করে দেখলে, ওরা যে একই শরীরের অঙ্গ তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে।


কোল থেকে মাথাটা তুলে একপাশে ঘোরায় টিম্পল। মা আরও কী কী সব খাবারের নাম বলছে। সব নিশ্চয়ই ওর পছন্দসই খাবার। "আর কিছু?" বাবার কণ্ঠস্বরে উষ্মা। মুখটা কাত করে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে থাকে টিম্পল। বাবাও কত রোগা হয়ে গেছে। চোখেমুখে ক্লান্তি। তার উপর কোনো কিছু না বলে টিম্পল হঠাৎ গতকাল রাতে চলে এসেছে। সারপ্রাইজ। আগে বলে এলে মা হয়তো বাজারটা করিয়ে রাখত। সাত সকালে এভাবে ছোটাছুটি করতে হতো না। বাজার এমন একটা জায়গা যেখানে টিম্পল ছোটবেলায় মরে গেলেও যেতে চাইত না। কাদা প্যাচপ্যাচে, ঠেলাঠেলি ভিড়! অথচ চাকরির জায়গায় নিজেকেই বাজার যেতে হয়, নিজেকেই রান্না করতে হয়। হঠাৎ বাবার জন্য খুব মায়া হলো। তড়াক করে খাট থেকে নামল টিম্পল, 

"একটু দাঁড়াও। আমিও যাব।"

"তুই আবার কেন? এই তো কাল এলি, বিশ্রাম নে," গলা নরম হয় সোমনাথের।

"ফ্লাইটে তো কোনো পরিশ্রম হয় নি আমার। আর তারপর তো ঘুমিয়েছি। চলো ঘুরে আসি।" বাবার মুখের খুশিটুকু নজর এড়ায় না টিম্পলের। 

"একটু মুরগির মাংসও নেব, বুঝলে? আমি রান্না করব আজ। মাংসের ব্যাগটা নিয়েছ তো?"

"ওই মাছের ব্যাগেই হয়ে যাবে।" 

বাবার আঙুলের আগাগুলো কালচে হয়ে গেছে। রোজ বেদানার রস টিপে টিপে বের করে। মায়া মাসি মিক্সিতে করে ছেঁকে দিত আগে আগে, তাতে নাকি মায়ের ঢোক গিলতে অসুবিধা হয়।

"এরপর কোথায় যাবে তুমি? অফিসে?" 

"হ্যাঁ, অফিসে যাব বিলগুলো জমা দিতে। তার আগে একবার হসপিটালে যেতে হবে সই করাতে। দুটো দুই প্রান্তে। একদিনে হবে না। তার ওপর একটা ওষুধ নেওয়ার আছে। ওটা পাব মৌলালীর কাছে"

"আমি আজ সইটা করিয়ে, ওষুধ নিয়ে আসছি। তুমি বরং কাল অফিসে যেও। আজ একটু বিশ্রাম নাও।"

"তুই আবার অতটা যাবি…" বাকি কথাগুলো আর্দ্রতায় ডুবে গেল। খুশিতে ভরপুর হয়ে উঠল টিম্পল। মনে মনে ঠিক করে নিল, যে কটা দিন বাড়িতে আছে বাবাকে যতটা পারে  বিশ্রাম দেবে। 



…... ৮ ..…..



দোতলার এই ঘরটার একটা নিজস্ব গন্ধ ছিল, একটা মা-মা গন্ধ। ড্রেসিংটেবিলের উপরে সাজানো থাকত কেওকারপিন তেল, ট্যালকম পাওডার, ডিমের মতো ছোট্ট একটা শিশির মধ্যে ফ্রেঞ্চ পারফাউম, আরও কত কী! এখন ওষুধের শিশি, বাক্স, সিরাপ, প্রোটিন পাওডার। সারাদিন মশারির দু'টো খুঁট টাঙানো থাকে। জানলাও সন্ধের পর থেকে বন্ধ রাখা হয়। পুরোনো গন্ধটা একটু একটু করে বদলে গেছে। তবু মা-মা ব্যাপারটা পুরোপুরি মুছে যায়নি। 


বেশ ধকল গেছে আজ। প্রচন্ড গরম ছিল সারাদিন। তার ওপর একটা গুমোট ভাব। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। বাজার, হসপিটাল, ওষুধ কেনা, ফিরে এসে রান্না, সব মিলিয়ে বেশ ক্লান্ত। তবু ঘুম আসছে না। মশারির মধ্যে ঘুমানোর অভ্যাসটা চলে গেছে। নাক টেনে ঘরের চেনা-অচেনা গন্ধটা আরেকবার নিল টিম্পল। 

"ক্লান্ত লাগছে না রে?" 

মা কী করে সব বুঝে যায়! টিম্পল তো একবারও বলে নি। রোজ অফিস যাতায়াত বা একার জন্য রান্না করে এত ক্লান্তি লাগে না। মোটে একটা অটোর দূরত্ব। টুক করে বসলেই পৌঁছে যাওয়া। এখানে ভিড়ভাট্টায় বাসে যাতায়াতটাই অনেকটা এনার্জি নিঙড়ে নেয়। অথচ দিনের পর দিন মা অফিস থেকে ফিরে সকলকে খাইয়ে দাইয়ে, টিম্পলের হোম ওয়ার্ক করিয়ে তবেই তো ঘুমোতে গেছে। তবে কী মাও ক্লান্ত হয়ে যেত? তেমন তো মনে হয়নি কখনও। বরং ওর নিজেরই অফিস থেকে ফিরে একেকদিন মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বিরক্ত লাগে। দায়সারাভাবে কথা বলে ফোন রেখে দেয়। একটা অপরাধবোধে বুকটা টনটন করে ওঠে,

"তুমি খুব কষ্ট পেয়েছ না মা?"

"কিসের জন্য?" 

"গতমাসে কেমোর আগে তোমার ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট এলো আর আমি জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেলাম? তুমি না মনে করালে..."

গলাটা বুজে আসে টিম্পলের। ঘর অন্ধকার। মায়ের মুখ দেখা যাচ্ছে না। সরু হাতটা শুধু ছুঁয়ে আছে ওর হাত। হাসির শব্দ ভেসে এল,

"ধুর পাগল! তুই কী ইচ্ছে করে ভুলে গেছিস নাকি! আমি জানি তোর কত চাপ থাকে। অফিসের কাজ, ঘরের কাজ সব একা হাতে সামলে কী সবকিছু মনে রাখা যায়?"

"মাংসটাও তো ভালো করে খেতে পারলে না। একটা মাত্র কাঁচালঙ্কা দিলাম, তাও গোটা। ঝাল হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।"

"রোজই তো আঝালা খাই। আজ অনেকদিন পরে  একটু মুখটা ছাড়ল। যেটুকু খেতে পারলাম খুব তৃপ্তি করে খেলাম।"


মানুষের মন ভারি অদ্ভুত। গত মাস থেকে যে গ্লানি বুকে বয়ে চলেছে টিম্পল তা মা এক নিমেষে হেসে উড়িয়ে দিল। তার উপর কোনো অভিমান জমে নেই মায়ের মনে। অথচ যে লোকটা সারাদিন বাজার-দোকান করে, ওষুধ আনে, ফলের রস করে, অফিসে বিলের জন্য ছোটাছুটি করে, ডাক্তারের সইসাবুদ নিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে, কেমোর সময় সে পাশে বসে না বলে মায়ের কত অভিমান! ভালোবাসা ভারি অদ্ভুত জিনিস। অভিমান যেন তার দোসর। অথচ অপত্য স্নেহ মিশে গেলে ভালোবাসায় আর মান অভিমানের জায়গা থাকে না। ফুঁপিয়ে ওঠে টিম্পল।

"আরে কাঁদছিস কেন? বোকা মেয়ে" পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় সুধা।

উত্তর দেয় না টিম্পল। সুধার কাঁধের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে অঝোরে কেঁদে চলে। ওর জায়গায় মা থাকলে কী এরকম ভুল করত? কক্ষনো না! 



…… ৯ …….



কত রাত কে জানে। একটা হিমেল হাওয়ার ঝাপটায় ঘুমটা ভেঙে গেল। মা ঘুমোচ্ছে। জানলাটা খুলে গেল কী করে? ছিটকিনি তো লাগিয়েছিল। আলস্যে হাত-পা চেপে ধরে। বিছানা থেকে নামতে একেবারেই ইচ্ছে করে না। কিন্তু জানলাটা না বন্ধ করলেই নয়। জোলো হাওয়ায় মায়ের ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। মশারির কোণটা জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে অল্প তুলে বেরিয়ে এল। মশাগুলো এমন সুযোগের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকে মশারির গায়ে। জানলা বন্ধ করার পর আবার বিছানায় ঢুকতে ইচ্ছে করল না। ঘরটা তেতে আছে যেন! একটু ছাতে গেলে মন্দ হতো না। হিমেল হাওয়াটুকু কী ওকেই ডেকে নিয়ে যেতে এসেছিল? মশারিটা ভালো করে গোঁজা আছে কিনা দেখে নিয়ে দরজাটা আলতো করে খুলল টিম্পল। অন্ধকারের একটা মজা আছে। একবার চোখ সয়ে গেলে অন্ধকারকে জয় করে ফেলা যায়। হার মেনে নিজেই যেন দেখেশুনে নেওয়ার একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা করে দেয়। দুটো ঘর পেরিয়ে ছাতের সিঁড়ি শুরু হওয়ার মুখে চাবি টাঙানো থাকে। আজ নেই। বাবা তো ওদের আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাহলে ছাতের চাবি কোথায়? পায়ে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে টিম্পল। ছাতের দরজা হাট করে খোলা। 


পাঁচিলের গায়ে ভর দিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে আছে সোমনাথ। হঠাৎ একটা আতঙ্ক ঘিরে ধরে টিম্পলকে,

"বাবা?"

চমকে ওর দিকে তাকায় সোমনাথ, "তুই এত রাতে ছাতে? ঘুমোস নি?"

সোমনাথের একদম কাছটায় এগিয়ে আসে টিম্পল, মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে,

"ঘুমিয়ে ছিলাম। হাওয়ায় জানলাটা খুলে গেল।"

"ও হো! তোকে বলা হয় নি। ছিটকিনিটা আলগা হয়ে গেছে। একটা চিপ দিতে হয় লাগানোর সময়।"

"পাঁচিলের অত ধার ঘেঁষে দাঁড়িও না। পুরোনো বাড়ি…"

"আরে আর বলিস না, একটা অশ্বত্থ গাছ উঠেছে। এই যে, এই দেখ।" আবার পাঁচিলের ওপারে ঝুঁকে পড়ল সোমনাথ। এবার টিম্পলও বাবার দেখাদেখি গলা বাড়িয়ে দিল।

"এটাকে ক'দিনের মধ্যে না উপড়ে ফেললে পাঁচিলে ফাটল ধরবে। রোজই ভাবি বঙ্কাকে ডাকব, আর সময়ই হয় না। এমন বিচ্ছিরি জায়গায় উঠেছে গাছটা…"

হঠাৎ বাবাকে জড়িয়ে ধরে টিম্পল। সোমনাথের কণ্ঠাটা কয়েকবার ওঠানামা করে। একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোতে গিয়েও বেরোয় না। 

"অনেক রোগা হয়ে গেছ"

"না না! বয়স হচ্ছে তো…"

"রাস্তার ওপারের বাড়িটাও ফ্ল্যাট হয়ে গেল?"

"হ্যাঁ। বাড়ি বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। সব ফ্ল্যাট হয়ে যাবে।"

"সামনের বুড়োবুড়ির বাড়িও তো বিক্রি হচ্ছে বললে"

"হুম। এই পাড়ায় শুধু আমাদের আর মিত্তিরদের বাড়িটা রয়ে গেল", একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক ঠেলে।

"তোর মা কী বলছে আমার নামে?"

হাসে টিম্পল, "বলছিল, পরশু ঘুম হয়নি তোমার। মায়ের পা টিপে দিয়েছ সারা রাত ধরে।"

হাওয়াটা বেশ এলোমেলো। হয়তো বা কাছেপিঠে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। অনেকক্ষণ পর একটা উত্তর ভেসে আসে,

"মাঝে মাঝে ব্যথাটা খুব বেড়ে যায়। পেইন কিলারে তখন আর কাজ হয় না।" 

ঘাড় নাড়ে টিম্পল, "ঘুমের ওষুধের ডোজটা কী ডাক্তার বাড়িয়েছে? মানে, এসব দিনে যদি দুটো ট্যাবলেট নিতে পারে।"

"সেরকমই বলেছে ডাক্তার। তবে চরম যন্ত্রণার সময়টা কোনোকিছুই কাজ দেয় না দেখেছি। ওটা ওকেই ভোগ করতে হয়। ব্যথাটা তো আর…" চুপ করে গেল সোমনাথ। মা আজ অনেক কথা বলছিল। বাবা কেমন আটকা পড়ে গেছে। কোথাও ঘুরতে যেতে পারে না, কতটা চাপে থাকে, কষ্ট পায়, এইসব। বাবার কথা বলতে বলতে মায়ের চোখের কোণ চিকচিক করে। টিম্পলও মা'কে বোঝালো, ছোটোখাটো ব্যাপারে বাবার উপর অভিমান না করতে।

"আর কী বলল মা?"

"তেমন কিছু না।" স্ট্রিট লাইটের আলোটা নিবু নিবু, যেন সন্ধে থেকে জ্বলে জ্বলে ক্লান্ত। বাবা কিছু একটা শুনিতে চায়, তাকিয়ে আছে ওর দিকে। একটু ইতস্তত করে আবার বলে টিম্পল, "তুমি হসপিটালে যখন মায়ের সঙ্গে যাও, সারাদিন কী করো?" 

"ওই তো প্রথমে নাম লিখিয়ে ওকে বেডে দিই, তারপর একটু কফি খাই, জলখাবার খাই, তারপর এদিক ওদিক বসে থাকি, বই পড়ি, তারপর ছুটি হলে পয়সা-কড়ি মিটিয়ে গাড়ি ধরি" পড়া মুখস্থ বলার মতো বলে গেল সোমনাথ। 

"বেশ তো। মাঝেমধ্যে মায়ের কাছে গিয়ে বসতে পারো তো। আগে তো বসতে। দুপুরে খাওয়ার সময়, বিকালে চায়ের সময়।"

চুপ করে থাকে সোমনাথ। ঝিঁঝিঁ পোকার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা ব্যাঙ ডেকে চলেছে। আরও নানারকম আওয়াজ, কিসের ঠিক ধরতে পারেনা টিম্পল। একটা অদ্ভুত ভাঙাভাঙা গলায় কিছু বলল সোমনাথ। টিম্পল ঠিক বুঝতে পারে না। কানটা বাবার মুখের কাছে এগিয়ে দেয়,


"তুই যখন হলি, তখন সুধার কী ভয়! কিছুতেই ছুঁচ ফোটাবে না। ডাক্তার রীতিমতো ধমক দিত। আর এখন দেখ, প্রতিবার কেমোর আগে রক্ত পরীক্ষা মাস্ট! আবার কেমোর সময় চ্যানেল করা। ভেইনই খুঁজে পায় না ওরা। বারবার ফোটায়, কখনও রক্ত নেবে বলে, কখনও চ্যানেল করবে বলে! কী কষ্টই না পায় মেয়েটা!"


আবার চুপ করে যায় সোমনাথ। ছাতের কোণে একটা বেলফুলের ঝোপ। মিষ্টি একটা গন্ধ চারদিকে জমাট বেঁধে আছে। ছোটবেলা থেকেই খুব রহস্যময় লাগত ঝোপটাকে। যেন হাত নেড়ে ডাকত। নিচটায় শ্যাওলা জমে থাকত। কেমন ভিজে ভিজে। খুব ভয় করত টিম্পলের। যেন কেউ ওঁত পেতে আছে ওই ঝোপের মধ্যে। নাগাল পেলেই খপ করে ধরে ফেলবে। বাবাকেও আজ ওরকমই রহস্যময় লাগছে।

এক ঝলক কান্না যা টিম্পল অনেক কষ্টে চেপে রাখছিল, সোমনাথের গাল গড়িয়ে তা ক্রমাগত ঝরতে লাগলো,

"তোর মায়ের হাতটা দেখেছিস? কেমন শুকিয়ে গেছে?" কতবার বলেছে আর চিকিৎসার দরকার নেই। সেই তো মরতেই হবে! কিন্তু আমি কী তা পারি? বল না? শেষ অবধি তো চেষ্টা করে যেতে হবে..."


পাঁচিলে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে ফেলে সোমনাথ,

"আমি দেখতে পারি না রে, ওকে ওই চ্যানেল করা অবস্থায় আমি আর দেখতে পারি না। ওরা বারবার ছুঁচ ফোটায়, আমি আর… আর নিতে পারি না!" 


বাবার পিঠে ধীরে ধীরে হাত বোলায় টিম্পল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বেলফুলের গন্ধটা ঝিম ধরিয়ে দিচ্ছে। বহুদিন পরে বৃষ্টিতে ভিজছে ওরা। আগে তিনজনে ভিজত। মা বলত মরসুমের প্রথম বৃষ্টিটায় ভিজলে নাকি অসুখ করে না। ভিজতে ভিজতে গান গাইত মা। আর কোনোদিন বৃষ্টিতে মা ভিজবে না। ভিজলেই সর্দি, তারপর নিউমোনিয়া। বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে টিম্পলের, কান্না ভেজা গলায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে গেয়ে ওঠে,


"...সব যে হয়ে গেল কালো

নিবে গেল দীপের আলো

আকাশপানে হাত বাড়ালেম কাহারও তরে

জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে

যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে…"


গানের সুরটা বেলফুলের গন্ধে ঘুরপাক খেতে খেতে

রাতের আকাশের কার্নিশ বেয়ে এগিয়ে চললো বহুতলের গা ঘেঁষে। ছায়ার দৈত্যের মতো মেঘগুলো ভেসে চললো তার পিছনে। একটা রাত-পাখি ডাকতে ডাকতে কোথায় মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। সেই অনিশ্চিতের দিকে অনিমিখে তাকিয়ে রইল সোমনাথ আর টিম্পল। নিচে দোতলার ছিটকিনিটা আবার কখন খুলে গেছে। সুধার ঘুম জড়ানো মুখটা খোলা জানলায়, মনে মনে গুণগুণ করছে সুরটা।



………… ১০ ………..



পালকের মতো ভাসতে ভাসতে মেঘেদের ছুঁয়ে যাচ্ছে টিম্পল। সামনে একটা ব্রিজ, দুই প্রান্ত মেঘে ঢাকা। ব্রিজের নিচ থেকে একটা থাম তরতর করে নেমে গেছে। কত নিচে? দেখতে ইচ্ছে করে টিম্পলের। হু হু করে থাম বরাবর নিচে নামতে থাকে। থামের তলায় একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। পিছন দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে খাল। সেখানে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে একটা লোক। বুকের কাছে একটা ব্যাগ। ঘাড়টা ওদিকে হেলে আছে। লালা গড়িয়ে পড়ছে। 

"শুনছ?"

ডাকটা ভেসে এলো পিছন দিক থেকে। এক কম বয়সী মহিলা হেঁটে আসছেন মেঘের ভিতর দিয়ে, ছায়া ছায়া মতো। মুখটা অবিকল মায়ের মতো। ছোটবেলায় মা'কে যেমন দেখত, ঠিক তেমন। মা ওকে দেখতে পাচ্ছে না। এগিয়ে যাচ্ছে লোকটার দিকে,

"শুনছ? আবার ঘুমোলে? খেলে না কিছু? একটু যদি ছেড়ে যাওয়ার জো আছে!" বলতে বলতে আঁচল দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিল মা। পবিত্র এক হাসিতে চারদিক ঝলমল করছে। এবার লোকটার ঘুম ভাঙল, মুখ ঘোরালো এদিকে। বাবা। ঠোঁটের কোণে হাসি। অপলকে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।  যেন কতদিন পরে দেখছে। বাবার মাথার সমস্ত চুল পাকা, ভাঙা গালে খোঁচা খোঁচা, কাঁচাপাকা দাড়ি। বাবা দু'হাত বাড়িয়ে মা'কে হঠাৎ জড়িয়ে ধরল। 


মায়ের মুখে বালিকা সুলভ হাসি,

"আরে করো কী! মেয়ে দেখছে তো!" এবার দু'জনে একসাথে পূর্ণ দৃষ্টিতে টিম্পলের দিকে তাকালো। কিন্তু বন্ধন আলগা হলো না। টিম্পল ভাসতে ভাসতে এগিয়ে এলো ওদের কাছে। কিছু একটা বলতে গেল। পারল না। মুখে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। বাবার পাশে একটা বড় ট্রলি ব্যাগ রাখা। মা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যাগের দিকে এগিয়ে গেল। উঁকি দিল টিম্পল। ভিতরে থরে থরে সাজানো মায়ের শাড়ি, রেডিও, সেন্টের শিশি, টেপ রেকর্ডার, বাবার জামাকাপড়, মানিব্যাগ, আলিমারির প্রায় সব বই, মাটির পুতুল আরও কত কী! মা সব একে একে নেড়েচেড়ে দেখছে আর বলছে,

"এই দেখো শরদিন্দু অমনিবাস! মনে আছে তোমার? প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে আমরা কিনেছিলাম?" মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ে বাবা,

"তখন এইটুকু টাকা জোগাড় করতে কত কাঠখড় পোড়াতে হতো!"

"আর এইটা?" হাতে টেপ রেকর্ডারটা ধরে হাওয়ায় দোলায়, "দিদিভাই যে নেকলেস কেনার টাকা দিয়েছিল বিয়েতে তাই দিয়ে আমরা কিনেছিলাম।"

"আমি তোমায় তেমন কিছুই দিতে পারিনি.." বাবার গলাটা কেঁপে ওঠে।

"কে বলল দাও নি?" অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে টিম্পলের দিকে তাকালো মা। টিম্পলের গাল বেয়ে নোনা জল। ঠোঁট দুটো একটু নড়ে উঠল। মা একের পর এক জিনিস বের করছে আর ছুঁড়ে দিছে থামের পিছনে। পাশে ছড়িয়ে থাকা জিনিসগুলো ব্যাগে ভরছে। টিম্পল উড়ে উড়ে গেল থামের পিছনে। পুরোনো জিনিসগুলো কিচ্ছু নেই ওখানে। বেমালুম হারিয়ে গেছে। বদলে রাখা টিম্পলের যাবিতীয় জিনিস। ছোটবেলার খেলনাবাটি, খাতা বই, পেনসিল বক্স, ডায়রি, জামা-কাপড়, সার্টিফিকেট, ল্যাপটপ, মোবাইলের চার্জার, আর অসংখ্য টিফিনবক্স। অস্থির হয় টিম্পল। ওদের জিনিসগুলো কোথায় গেল? মা যেন এক পলক থমকালো। খুব ধীরে ধীরে বলল,

"ওগুলো আর আমাদের লাগবে না।" তারপরেই গলায় আনন্দের সুর, "দ্যাখ, এটায় কুলের আচার রইল। গিয়েই ব্যাগ থেকে বের করে ফেলবি।"

কোথায় যাচ্ছে টিম্পল?

"এটায় দেখ মাছ ভাজা দিয়েছি কুড়িটা মতো। কড়া করে ভাজা। ফ্রিজে ঢোকাবি মনে করে।" 

টিম্পল বলতে গেল "কোথায় যাচ্ছি আমি?" আওয়াজ বেরোলো না গলা দিয়ে। 

"ল্যাপটপের চার্জারটা কোথায় যে রাখলাম!"

আবার জিজ্ঞাসা করল টিম্পল, "মা, কোথায় পাঠাচ্ছ আমাকে? আমি কোথ্থাও যাব না।" না। কোনো শব্দ বেরোলো না, শুধু ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠল। 

"এই দ্যাখ, এই সালোয়ারের পিসটা ওখানে গিয়ে বানিয়ে নিস। ওরা ফিটিংসটা বেশ ভালো করে।"

প্রচণ্ড রাগ হয় টিম্পলের। ওর কথা কেউ শুনছে না কেন? বাবাও শুনছে না। ও যাবে না। কোথাও যাবে না।

"আরে মোবাইলটা দিলি না এখনও? দিয়ে দে। ব্যাগে রাখি।"

"শুনছ না কেন তোমরা? আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাব না। কোথ্থাও না…" চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে। গোঁ গোঁ একটা শব্দ বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। 

"মোবাইলটা সুইচ অফ কর…

স্যুইচ অফ দ্য মোবাইল…" 

মা আর বাবা একসাথে বলে চলেছে, বারবার বলে চলেছে…

"স্যুইচ অফ দ্য মোবাইল…"

জোর করে কেউ টিম্পলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, ওদের থেকে অনেক দূরে। টিম্পল হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইছে বাবা-মায়ের দুটো হাত, পারছে না। ক্রমশ: থাম বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে তরতর করে…

একটা ঝাঁকুনি… 

"ম্যাম ...ম্যাম,  প্লিজ স্যুইচ অফ ইওর মোবাইল। এন্ড ফাসেন ইওর সিট-বেল্ট। উই আর অ্যাবাউট টু ল্যান্ড।" এয়ার হোস্টেস খানিকটা ঝুঁকে এসে টিম্পলের কাঁধ ছুঁয়ে আছে। ঘামে টপটা ভেজে গেছে। শরীরে কেমন একটা অস্বস্তি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। 

"আর ইউ অলরাইট ম্যাম?" যন্ত্রের মতো ঘাড় নাড়ে টিম্পল। 

"প্লিজ পুট ইওর সিট-বেল্ট অন এন্ড কাইন্ডলি স্যুইচ অফ ইওর মোবাইল।"

ঘোলাটে দৃষ্টিতে মোবাইলের দিকে তাকায় টিম্পল। স্ক্রিনে একটা সাদা-কালো ছবি। খালের ধারে একটা গাছের নিচে সুধা, সোমনাথ আর টিম্পল। হাসি হাসি মুখে লেন্সের দিকে তাকিয়ে আছে। ফ্লাইট ধরার আগে আজই অ্যালবাম থেকে ছবিটা তুলে এনেছে। 


                      --------- ০ ----------


চিত্রঋণ- পারমিতা মণ্ডল










কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন