শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সমিত মজুমদার

                              


বারোয়ারি পুজোর প্রথম আয়োজন 


সামনেই বাঙালির মহোৎসব - দুর্গাপূজা।  পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন।  বর্তমানে অতিমারির সময়কালে এই আয়োজনে কম পড়েছে আড়ম্বরপূর্ণতার ছাপ।  তবু বাঙালির আনন্দ উচ্ছ্বাস লেগে থাকে এই উৎসবকে ঘিরে।  পাড়ায় পাড়ায় যে পুজোর আয়োজন তা সর্বজনীন বা সার্বজনীন, অর্থাৎ সবে মিলে, সকলের উপস্থিতি আর পরিচালনায়, সকলের জন্য, সকলের কল্যাণে।

বাংলায় দুর্গা পুজোর প্রচলন হওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ঐতিহাসিক বলেন ষড়োশ শতকের শেষে, কেউবা বলেন সপ্তদশ শতকের শুরুতে।  কারও মতে আবার ১৬০৬ সালে নদীয়ার রাজা ভবানন্দ মজুমদার প্রথম দুর্গা পুজোর প্রচলন করেন।  পরবর্তী সময়ে অনেক রাজা-জমিদাররা এই পুজোর আয়োজন করেছেন।  তবে এই সকল দুর্গাপূজাই সম্পূর্ণভাবে ছিল পারিবারিক।  উচ্চবিত্ত - ধনী - জমিদার পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।  পুজোর প্রচলন থেকে সমস্ত - তাঁর কার্যাদি, নিয়ম সবই সেই সকল পরিবারগুলির উপর নির্ভর করত।  আর সেই পরিবারগুলির অনুমতিতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ ছিল, অনেক ক্ষেত্রে তাও ছিল না।   কোনও কোনও ক্ষেত্রে শুধু সেই পরিবারের অতিথিরাই যোগদান করতে পারতেন।

বেঙ্গল গেজেটের মতে, প্রথম বারোয়ারী পুজোর প্রচলন শুরু হয় হুগলির গুপ্তিপাড়ায়।  গুপ্তিপাড়ার এক ধনী পরিবারে হত দুর্গাপূজা (মতান্তরে জগদ্ধাত্রী)।  গ্রামের কিছু মানুষ দুর্গাপূজা দেখার জন্য উপস্থিত হন সেই ধনী পরিবারের মূল ফটকের সামনে।  কিন্তু দ্বাররক্ষক তাদের প্রবেশের অনুমতি না দিলে অপমানিত হয়ে তারা গ্রামে ফিরে আসে।  গ্রামের সকলে জানে বিষয়টি।  গ্রামের বারোজন বন্ধু মিলে ক্ষোভে প্রতিবাদে ঠিক করেন তারা সমবেত হয়ে দুর্গাপূজার আয়োজন করবেন।  কিন্তু ধনীদের মতো অর্থের উৎস না থাকায় তারা গ্রামে চাঁদা তোলার বন্দোবস্ত করেন।  শুরু হল প্রথম বারোয়ারি পুজোর।  

বেঙ্গল গেজেটের তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক বাংলা ১১৬৬ সনে (ইং ১৭৫৯ সাল) সর্বপ্রথম শুরু হয় বারোয়ারি পুজো। 'বারো' ও 'ইয়ার' থেকে হয় 'বারোয়ারি পুজো'। সমিতির নাম দেওয়া হয় ‘গুপ্তিপাড়া শ্রী শ্রী বিন্ধ্যবাসিনী পূজা সমিতি’। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এই স্থানই বারোয়ারি দুর্গা পুজোর সৃষ্টিস্থান।  পরবর্তী সময়ে বাংলা ১৩৪৬ সনে (ইং১৯৩৯ সাল) সতীশ চন্দ্র সেন এই স্থানে বিন্ধ্যবাসিনী মাতার মন্দির নিজ অর্থে গড়ে তোলেন।




ধীরে ধীরে এই পুজোর সংবাদ অন্যত্র ছড়াতে থাকে।  এভাবে বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হতে কিন্তু বেশ সময় লাগে।  কলকাতায় কিন্তু বারোয়ারি পুজোর আয়োজন আরও অনেক পরে।  কলকাতার প্রাচীন পুজো বলতে ধরা হয় বেহালার সখের বাজারের সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের পুজোকেই।  ১৬১০ সাল থেকে সেই পুজোর সূত্রপাত।  কিন্তু বারোয়ারি পুজোর প্রথম আয়োজন করে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে আদিগঙ্গার তীরবর্তী বলরাম বসু ঘাট রোডের বাসিন্দারা।  এখানকার কিছু যুবক ও ব্যবসায়ী মিলিত হয়ে ১৯১০ সালে ‘ভবানীপুর সনাতন ধর্মোত্সাহিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করে  আরম্ভ করলেন দুর্গাপুজো। শহর কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পুজো।  ১৯১১ সালে শ্যামপুকুরে, ১৯১৩ সালে সিকদার বাগানে, ১৯১৯ সালে বাগবাজারে বারোয়ারি দুর্গাপূজার আয়োজন হয়।  তবে প্রকৃত অর্থে বারোয়ারি থেকে দুর্গাপূজা সার্বজনীন রূপ দেয় ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতি।

যদিও এখন বারোয়ারি শব্দের প্রয়োগ কমে সার্বজনীন বা সর্বজনীন ব্যবহারের প্রয়োগ বেড়েছে।  সারা বাংলা জুড়ে এই পুজোর সংখ্যা বেড়ে কয়েক হাজারে পরিনত হয়েছে।  সীমাবদ্ধতা নেই শুধু দুর্গাপূজায়, কালী থেকে জগদ্ধাত্রী, গনেশ থেকে সরস্বতী পুজো সবই আজ বারোয়ারি থেকে পরিনত হয়েছে সর্বজনীন বা সার্বজনীনে। 

ছবিঃ লেখক 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন